Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

জীবনানন্দ দাশের ‘সূর্য-অসূর্যলোক’

Icon

শাহাবুদ্দীন নাগরী

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশ প্রকাশ করেছিলেন তার পাঁচটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ও প্রকাশিত হয়েছিল তার মৃত্যুর আগে আগে। জীবনানন্দ-গবেষকরা বলেন, ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ তারই পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ, যা পরে ‘রূপসী বাংলা’ নামে প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে (নাম পরিবর্তনের দায়ভার প্রকাশক সিগনেট প্রেস লিমিটেডের)। ১৯৬১ সালে ভাই অশোকানন্দ দাশ প্রকাশ করেছিলেন ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ নামের কাব্যগ্রন্থটি, এটিও পাণ্ডুলিপি আকারে সাজানো ছিল জীবনানন্দের। ফলে, হাজারের অধিক কবিতা লেখার পরও মাত্র এ মৌলিক সাতটি কাব্যগ্রন্থের পেছনে জীবনানন্দ দাশের সম্পাদনা, পরিকল্পনা ও সংযুক্তি সম্বন্ধে জানা যায়। পরে আরও সাতটি কাব্যগ্রন্থ কবির শুভাকাঙ্ক্ষী, সম্পাদক, প্রকাশক ও গবেষকদের উদ্যোগে ২০২০ সাল নাগাদ প্রকাশিত হয়েছে।

জীবনানন্দ-গবেষক ও কথাসাহিত্যিক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সম্পাদনায় ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে কবির অগ্রন্থিত ১১৭টি কবিতার সংকলন ‘সূর্য-অসূর্যলোক’। এটি জীবনানন্দ দাশের পঞ্চদশ কবিতার বই। তার পাঠকমাত্রই অনুধাবন করেন একটি আশ্চর্যসুন্দর পৃথিবী ছিল জীবনানন্দের। এ পৃথিবীতে তিনি একা পরিভ্রমণ করতেই পছন্দ করতেন বেশি। তার কবিতার ভেতর এক নিমগ্ন পথচারী, ভাবুক অথবা দর্শকের উপস্থিতি তার কবিতাকে আলাদা সুর, লয়, ছন্দ ও মৌলিকত্ব দান করেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন এবং তার প্রকৃতি-জলবায়ু-ঋতুচক্র গভীর অভিনিবেশসহকারে ও মুগ্ধতায় জায়গা করে নিয়েছে তার কবিতায়। খোলা চোখে দেখা দৃশ্যমান জড়-জীবনের ভেতরেও যে একটি ঘোরলাগা সুন্দর লুকিয়ে থাকে, তা তিনি নিজস্ব ভাষায় ও যত্নে তুলে এনেছিলেন তার কবিতায়। ‘সূর্য-অসূর্যলোক’ কাব্যগ্রন্থে যে কবিতাগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলোর কোনো শিরোনাম নেই। একটি ক্রমিক নম্বর এবং কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি বা কোথাও অংশবিশেষ শিরোনাম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। পাঠক ভাবতেই পারেন, জীবনানন্দ দাশ কবিতা লেখার পর কবিতার শিরোনাম দিতেন না। নাকি তার পাণ্ডুলিপির খাতায় শিরোনামহীন কবিতাই লিখে রাখতেন?

‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ প্রকাশকালে (যা জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থেরই একটি বিকল্প সংস্করণ) ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ‘সম্পাদকের কৈফিয়ৎ’ অংশে বলেছেন যে, ‘জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপির অধিকাংশ কবিতার ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়, রচনাকালে খুব কম কবিতারই শিরোনাম রেখেছেন জীবনানন্দ দাশ। শিরোনামের প্রশ্নটি এসেছে কোনো সাহিত্যপত্রে বা গ্রন্থে কবিতা প্রকাশকালে।’

এ নতুন কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই প্রায় ২৩ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘কবি জীবনানন্দ দাশ : একটি ভূমিকা’ শিরোনামে সম্পাদক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী জীবনানন্দ দাশের কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তির বিশ্লেষণ, তাৎপর্য ও তত্ত্ব এবং একই সঙ্গে সমসাময়িক ও পূর্বসূরি কবিদের কাব্যভাবনার সঙ্গে তার ভাবনা-চিন্তার একটি তুলনামূলক প্রেক্ষাপট উন্মোচন করে জীবনানন্দ দাশকে আরেকটু বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছেন, যা এ কবির কবিতা বিশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জীবনানন্দের কবিতার উদ্ধৃতি টেনে তিনি বলেছেন, ‘কা’র কবি জীবনানন্দ, কবেকার? কীসের কবিতা তার? জীবনশিল্পী তিনি? ছদ্মবেশী ইতিহাসবিদ? নৃতত্ত্ববিদ কোনো? নিঃসঙ্গ পরিব্রাজক? এসব অনিবার্য প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের ‘বনলতা সেন’ আর ‘রূপসী বাংলা’-র গণ্ডি অতিক্রম করে যেতে হবে আরও উজানে, যেখানে শব্দের খেলা গাঢ়তর হয়ে স্পর্শ করেছে অলৌকিক অদৃষ্টপূর্ব দিগন্ত এক...।’

জীবনানন্দের কাব্য জগতের আলো-আঁধারির যে ঝুলনা সামনে-পেছনে ক্রমাগত আসা-যাওয়া করে তার থেকে নিষ্কৃতি পেতে এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে আপাত তেমন কোনো কাব্যিক-বিশ্বাস খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো, তবে পাওয়া যাবে তার নগরকেন্দ্রিক আত্মমগ্নতা। কবিতাগুলো থেকে যে কয়েকটি কবিতার হস্তলিপি (পাণ্ডুলিপি-চিত্র) মুদ্রিত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এগুলো জীবনানন্দের হাতে আরও পরিশীলিত ও পরিমার্জিত হতো। কবিতার ক্ষেত্রে এমন পরিমার্জনা ছিল তার কাছে নেশার মতো। এ গ্রন্থের কয়েকটি কবিতার হস্তলিপিদৃষ্টে যা কিছু সংশোধন চোখে পড়ে, তাকে ঠিক সংশোধন না বলে বিকল্প ব্যবহারের চিন্তা বলা যেতে পারে। তিনি মূল শব্দের ওপরে যেসব বিকল্প শব্দ লিখেছেন সেখানে মূল শব্দটি কেটে দেননি, দুটোকেই রেখেছেন, কিছু কিছু শব্দের নিচে নিম্নরেখা (underline) দেখা যায়, হতে পারে পরিমার্জনের সময় তিনি যেন ওইসব শব্দ নিয়ে ভাবেন তারই চিহ্ন সেটা! ফলে শেষাবধি মুদ্রণের জন্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতের সময় তিনি কোন শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহারে স্থিত হতেন, নাকি সব ফেলে দিয়ে নতুন কোনো শব্দ ব্যবহার করতেন, তা কারও পক্ষেই এখন আর বলা সম্ভব নয়।

হতে পারে জীবনানন্দের এত এত কবিতা অমুদ্রিত ও অপ্রকাশিত থেকে গেছে শুধু কবির সন্তুষ্টির অভাবে, পরিমার্জনার জন্য হাতে না তোলায় (!)। ফলে জীবনানন্দের গ্রন্থ প্রকাশের সময় সম্পাদনার কাজটি যে এখন অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাতে সন্দেহ নেই। তার এক্সারসাইজ খাতায় লিখিত সব কবিতাই যে জীবনানন্দের কাছে মুদ্রণযোগ্য কবিতা হয়ে ওঠেনি তা আঁচ করে নেওয়া যেতে পারে। তবুও তার কবিতা শ্রীমণ্ডিত, ঘোমটা টানা নারীর মতোই আঁচল সরিয়ে দেখার মতো, নিশ্চুপ মধ্যরাতের নিস্তব্ধতার মতোই রহস্যমোড়া, যার অনুসন্ধান আজ অবধি শেষ হয়ে ওঠেনি। আমাদের গবেষকদের অব্যাহত জীবনানন্দ-চর্চা জীবনকাব্যের মূল সুরের অভিজ্ঞান রপ্ত করার সুযোগ করে দেবে, ‘সূর্য-অসূর্যলোক’ কাব্যগ্রন্থটির পরিকল্পিত যাত্রায় আমরা পাঠক হিসাবে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করব ভিন্ন কোনো জীবনানন্দকে, তিনি আমাদের কতটুকু পরিতৃপ্তি দান করলেন নতুন কাব্যরসে।

বইটির প্রকাশক সূচীপত্র। প্রচ্ছদ করেছেন সঞ্জীব ওয়ার্সী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম