গল্প
আবু সাঈদ যখন শহিদ হয়েছিল
আহমেদ মাওলা
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চুলার পাতিলে টগবগ করে ফুটতে ছিল ভাত।
কাঠির আগায় তুলে একটা ভাত দু’আঙুলে টিপে জাহানারা গ্যাসের আগুনটা একটু কমিয়ে দিল।
হামিদের চোখ টিভির পর্দায়। পুলিশ ছাত্রদের বেদম পেটাচ্ছে। প্রচণ্ড হইচই, চিৎকার, চ্যাঁচামেচির শব্দ হচ্ছে।
‘সাউন্ডটা একটু কমিয়ে দাও না।’ জাহানারার কণ্ঠে ঝাঁজ।
স্ত্রীর অনুরোধ হামিদের কানে পৌঁছায় না। টানটান উত্তেজনায় সে ধনুকের সিলার মতো বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে সে সহ্য করতে পারছে না। ছাত্রদের ওপর এমন নির্মম অত্যাচার!
জাহানারা এবার কিচেন থেকে এসে হামিদের হাত থেকে রিমোটটা কেড়ে নিয়ে নিজেই টিভির সাউন্ডটা কমিয়ে দেয়।
‘তোমার কান একেবারে গেছে! দিন দিন বহেরা হয়ে যাচ্ছ, সেদিকে খেয়াল আছে?’
জাহানারার কথায় উষ্মা। চোখে ক্রোধের আগুন। চোখে চোখ পড়তেই হামিদ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তার চোখের দৃশ্যপট এখন শাহবাগে। রক্তে সমুদ্র ঢেউ। পুলিশের নির্মম লাঠির বাড়ি, টিয়ার শেলের ধোঁয়া, সাউন্ডগ্রেনেডের আওয়াজ, রাবার গুলি, ছররা গুলিতে ঝাঁজরা ছাত্রদের বুক। হামিদের মনে হয় তার বুকই ঝাঁজরা হয়ে গেছে। ফিন্কি দিয়ে বেরোচ্ছে রক্ত। অজান্তে হাতটা বুকের ওপর চলে যায়। গায়ের লাল জামাটা যেন রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। শরীরটা তার বাসায়, সে মনে মনে হাজির হয়ে আছে ছাত্রদের জমাটবাঁধা আন্দোলনে।
আবদুল হামিদের মনে পড়ে যায়, নাৎসিবিরোধী ‘হোয়াইট রোজ’ মুভমেন্টের কথা। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র অ্যাডলফ হিটলারের বর্বরতার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল। খুনি নাৎসি সরকারের বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণের দায়ে ছয় ছাত্রকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাসের খলনায়ক হিটলারকে ফ্যাসিস্ট হিসাবে সাব্যস্ত করেছে।
১৯৭৬ সালে জোহানেসবার্গের সোয়েতোর এক কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল বান্টুনীতির বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের ভাষা এবং শিক্ষার ভাষা কী হবে? ১৬ থেকে ১৮ জুন, মাত্র তিন দিনে নিহত হয়েছিল ১৭৬ জন। থেমে থেমে এ আন্দোলন জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ আন্দোলনে রূপ নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার এ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলা। স্মৃতি হাতড়ে হামিদ চলে আসে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। সেই সময়ও ছাত্ররা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বুক পেতে দিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানি সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ হয়েছিল রফিক, শফিক, বরকত, সালাম, জব্বার-বাঙালির সূর্যসন্তানরা। ইতিহাসে অমর চরিত্র হয়ে আছে তারা।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্ররা কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নেমে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল আসাদ, মতিয়ুর। নব্বইয়ে স্বৈরাচারকে হটানোর জন্য সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আন্দোলনের মুখে রাজপথ প্রকম্পিত স্লোগান ছিল-‘স্বৈরাচার নিপাত যাক/গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে পুলিশের গুলিতে মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল ডাক্তার মিলন। জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন দ্রোহে জ্বলে উঠে উদোম গায়ের পিঠে-বুকে-‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক/স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রাজপথে। ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ নূর হোসেনের রক্ত বৃথা যায়নি। স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছিল দেশ।
‘এবারের ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন কী ব্যর্থ হবে?’
জাহানারার এ কথার উত্তর দেয় হামিদ-
‘ছাত্র-যুবকদের আন্দোলন কখনো বৃথা যায়নি। ইতিহাস তো সে কথা বলে না।’
রান্নাঘরের আগুনের তাপে ঘর্মাক্ত হয়ে জাহানারা ওড়নায় হাত-মুখ মুছতে মুছতে স্বামীর পাশে বসে। টিভির স্কিনে চোখ রাখে। রিমোটটা হাতে নিয়ে এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে যায়। বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে শান্তিমতো টিভি দেখার জো নেই। চেহারায় বিরক্তিভাব নিয়ে আবার ফিরে আসে খবরের লাইফ শোতে। মিরপুর-১০ নম্বর থেকে রাশেদ নিজাম বলছে-
‘দর্শক, আপনারা দেখছেন, কোটাবিরোধী বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এগিয়ে আসছে। বিপরীত দিক থেকে আসছে হেলমেটপরা বাহিনী, তাদের হাতে আছে লাঠি। পুলিশ তাদের সঙ্গে আছে। এই মাত্র পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করল। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন রাস্তা। কোটা আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। হেলমেট বাহিনী আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে ধরে পেটাচ্ছে। উভয়পক্ষের সংঘাত চলছে। ঠি-ঠি-ঠি ঠাস ...দর্শক, আপনারা দেখছেন। এ মাত্র পুলিশ গুলি ছুড়েছে। কেউ আহত-নিহত হয়েছে কিনা, আমরা এখনো কিছু বলতে পারছি না। জনতার ঢল মেট্রোরেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে..
খবর পাঠক বলছেন-রাশেদ, আপনি থাকেন আমাদের সঙ্গে, খবর সংগ্রহ করেন। আমরা এবার যাচ্ছি যাত্রাবাড়ীর তাহমিনা মাহমুদের কাছে...’
জাহানারার ভাত রান্না হয়ে গেছে আগেই। চুলায় তরকারির পাতিল বসিয়ে এসেছিল। টেলিভিশনে তুমুল উত্তেজনাকর লাইফ দৃশ্য দেখতে গিয়ে চুলায় তরকারির কথা ভুলে যায়। সময় কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে বলতে পারে না। তরকারি পাতিলের পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে। সে ছুটে কিচেনের দিকে গেল। পোড়া পাতিলটা দ্রুত খালি হাতে নামাতে গিয়ে তার হাতে লেগে যায়। স্যাঁকা লাগা হাত জ্বলে উঠতেই জাহানারা ‘ওহ্, মা-রে..’ চিৎকার করে ওঠে।
হামিদ দৌড়ে এসে দেখে স্ত্রী হাত ধরে বসে পড়েছে। সে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে সোফাতে বসায়। পোড়া স্থানে বার্ন মলম লাগাতে চেষ্টা করে। জাহানারা তখন হাতের তীব্র জ্বলুনির ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে।
টিভিতে এখন যাত্রাবাড়ীর দৃশ্য দেখাচ্ছে। মেয়র হানিফ সেতুর গোড়ায় হেলমেট বাহিনী, হাতে লাঠি ছাড়াও অন্যান্য জিনিস আছে। শনিরআখড়া থেকে সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দখলে। টোলপ্লাজা পর্যন্ত জমায়েত ছাত্র-জনতার ওপর হঠাৎ চড়াও হয় পুলিশ। তুমুল সংঘর্ষ চলছে।
পুলিশ, বিজিপি, হেলমেট পার্টি, ডাণ্ডাবাহিনী একসঙ্গে নেমেছে অস্ত্র হাতে। অন্যদিকে নিরস্ত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্রছাত্রী, সাধারণ জনতা।
এক অসম লড়াই চলছে দেশে। ঢাকার বিভিন্ন রাজপথে নেমেছে ছাত্র-জনতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ফেসবুক, টিভি নিউজের সচিত্র দৃশ্য দেখে ক্রমেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রথমে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। তারপর সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা জেগে ওঠে। সরকারি চাকরিতে ৫৪ শতাংশ কোটা বলবৎ ছিল। ছাত্রদের প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে সরকারপ্রধান কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০১৮ সালে। সেই প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে কোর্ট প্রজ্ঞাপন বাতিল করে কোটা পুনর্বহালের রায় প্রদান করে। ২০২৪ ১ জুলাই ছাত্ররা ন্যায্য অধিকার নিয়ে আবার নামে রাজপথে। সরকারের একজন মন্ত্রী বললেন-
‘বিষয়টি সাব-জুডিশিয়াল ম্যাটার, আমি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করছে। কোর্টের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক বলল-
‘এটা তো কোর্টের বিষয় না। এটা স্টেট পলিসি ম্যাটার। অহেতুক আমাদের হাইকোর্ট দেখানো হচ্ছে কেন?’
পত্রিকার নিউজে, টিভির খবরে সরকারপন্থি সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকারের পক্ষের অবস্থান নেয়। তারা বিশ্লেষণ করে বোঝাতে চায়, সরকারের অবস্থানই সঠিক।
শুরু থেকেই কোটা আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। আন্দোলনকারীরা দাবি নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে।
১ থেকে ১৫ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি নিয়ে শাহবাগ, রাজু ভাস্কর্য, শহিদ মিনার ইত্যাদি স্থানে সমাবেশ ও মিছিল করে।
একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বলেন-
‘কোটা আন্দোলন মোকাবিলার জন্য আমাদের ছাত্র সংগঠনই যথেষ্ট।’
সরকারপ্রধান বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করলে এক সাংবাদিক চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন করেন।
সাংবাদিক : মাননীয়, ছাত্ররা কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করছে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। আগামীকাল আন্দোলনকারীরা ‘বাংলা ব্লকেড’-এর ডাক দিয়েছে। ৫৪ শতাংশ কোটা আর মেধা কোটা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
সরকারপ্রধান : কোটা আন্দোলনকারীরা কোর্টের আইন মানবে না, সংবিধান মানবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা না পেলে, রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে? রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধরা পাবে না? অপরাধটা কী?’
সরকারপ্রধানের এ মন্তব্য শিক্ষার্থীরা মানতে পারেনি। রাজাকারে ইতিহাস তারা জানে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যারা সহযোগিতা করেছিল, তাদের ‘রাজাকার’ বলে। তারা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। সেই থেকে ‘রাজাকার’ শব্দটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নেতিবাচক অর্থ ধারণ করেছে। ‘রাজাকার’ বলতে এখন বোঝায় দেশবিরোধী, বিশ্বাসঘাতক একটি চরিত্র। স্বাধীনতা-পরবর্তী গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটকে রাজাকার চরিত্রের ভিন্ন এক ন্যারেটিভ নির্মাণ আছে। জনপ্রিয় কথাসাত্যিক হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকে টিয়ে পাখির মুখ দিয়ে বলানো হয়-‘তুই রাজাকার!’
একটি মাত্র সংলাপ, কী যে জনপ্রিয়তা ফেল! রাস্তায়-রেস্তোরাঁয়, ক্যাম্পাসে ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ছিল-‘তুই রাজাকার!’ তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এমন ছিল, ‘হানাদার বাহিনী’ ‘রাজাকার’ এসব শব্দ ব্যবহার এক ধরনের নিষিদ্ধ ছিল। বাঙালি জীবনে মুক্তিযুদ্ধের মতো যেন কোনো কিছুই ঘটেনি। ক্ষমতার কাজই হচ্ছে, বর্তমানকে গুরুত্ব দেওয়া আর অতীতকে ভুলিয়ে রাখা। ত্রিশ লাখ শহিদের প্রাণ, এক কোটি লোকের শরণার্থী হওয়া, মা-বোনের ইজ্জতহানি, যাদের জীবনের ওপর দিয়ে সময়টা বয়ে গেছে, চাইলেও তাদের মন থেকে ইতিহাস মুছে দেওয়া যায় না।
রাজনৈতিক পালাবদলে, এ সরকার আমলে ‘রাজাকার’ শব্দটি গালি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সরকারের বিপক্ষে, সমালোচনা করলেই যাকে তাকে ‘রাজাকার’ ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, প্রচার মাধ্যমে, সমাজের সব জায়গায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী লোকজনকেও এ ট্যাগ লাগিয়ে শারীরিক-মানসিকভাবে হয়রানি, নির্যাতন করেছে। একশ্রেণির দলান্ধ লোক এ ট্যাগকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। ক্ষমতাসীনরা ‘আমরা’ আর অন্যরা ‘তোমরা’ হিসাবে গণ্য করেছে। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ধরনের বিভাজন-বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারপ্রধানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সেই দিন মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসে। মিছিলের স্লোগান-
‘তুমি কে? আমি কে?
রাজাকার, রাজাকার
কে বলেছে? কে বলেছে?
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’
এবং
‘চাইতে গেলাম অধিকার
হয়ে গেলাম রাজাকার।’
মধ্যরাতের সব নীরবতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে হাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে স্লোগান দিতে দিতে অজস্র শিক্ষার্থী জড়ো হয় টিএসসি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে।
আন্দোলনের অগ্নি জ্বলে উঠতে থাকে। এ আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে স্কুল, কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা ক্রমে সংগঠিত একটি শক্তি হিসাবে একই সরলরেখায় এসে দাঁড়িয়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন-
‘গতরাতে আমরা বিক্ষোভ করে সরকারপ্রধানকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ছিলাম। প্রত্যাহার না হওয়ায় আমরা রাস্তায় নেমেছি। সরকারপ্রধান আমাদের অপমান করেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে সবাইকে রাজাকার বলেছেন।’
আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশের ছাত্রসমাজ। দেশের জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে ছাত্ররা জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে-
‘চেয়ে ছিলাম অধিকার
হয়ে গেলাম রাজাকার’
স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজপথ। এখন আর ছাত্রছাত্রীদের ঘরে ধরে রাখা যাচ্ছে না। তারা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। সারা দেশে আন্দোলনের মশাল জ্বলে ওঠে। উত্তাল সমুদ্রের মতো দুলছে দেশ। যদিও এ পর্যন্ত কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি।
১৫ জুলাই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সভাপতি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ করে বলেন-
‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঘাত করেছে।’
এক মন্ত্রী বললেন-
‘যারা নিজেদের রাজাকার বলে পরিচয় দেয়, তাদের লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে মিছিল করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।’
এসব তর্কবিতর্কে আন্দোলনে ঘৃতাগ্নি আরও বৃদ্ধি পায়। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয় একাত্তর হল, সূর্যসেন হল ও ক্যাম্পাসের বেশ কয়েকটি জায়গায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ, ধাওয়া-পালটাধাওয়া চলে। বিকাল তিনটা থেকে শহীদুল্লাহ হল ও মেডিকেল কলেজের মধ্যবর্তী স্থানে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বন্ধ করে দেয় ঢাকা-আরিচা রোড, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট এলাকা দ্বিমুখী লড়াইয়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয় বেসরকারি ব্র্যাক, নর্থসাউথসহ মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৫ জুলাই সকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ ফেসবুক পোস্টে লেখেন-
‘স্যার! (শামসুজ্জোহা, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে শহিদ) এ মুহূর্তে আপনাকে আমাদের খুবই প্রয়োজন স্যার! আপনার সমসাময়িক সবাই মারা গেছেন। তবুও মৃত্যুতে তুমি অমর হয়ে থাকো। আপনার কবর আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। আমরা আপনার আত্মায় উদ্দীপ্ত হয়েছি।
আপনিও প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছ আত্মসমর্পণ করবেন। তবে যতদিন বেঁচে থাকবেন, মেরুদণ্ড নিয়ে বেঁচে থাকবেন। ন্যায়সংগত দাবিকে সমর্থন করুন, রাস্তায় নামুন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ান। আপনি প্রকৃত সম্মান এবং মর্যাদা পাবেন, আপনার মৃত্যুর পরে আপনি সময়ের ইতিহাসে বিবর্ণ হবেন না। শামসুজ্জোহা হয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন। ‘শামসুজ্জোহা’ হিসাবে মৃত্যু অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানজনক ও গৌরবের।’
১৬ জুলাই, দুপুর আড়াইটা। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। জমাটবদ্ধ ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। অধিকাংশ ছাত্র পেছনে সরে আসে। কিন্তু আবু সাঈদ অকুতোভয়, সড়কের মাঝখানে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতে একটা ছড়ি, গায়ে কালো গেঞ্জি, যেন শোকের পোশাক আগেই পরে নিয়েছে। বারবার হাত দুটো দুদিকে মেলে ধরে বুক টান করে ধনুকের সিলার মতো দাঁড়াল সে। পেছনে কেউ তার সঙ্গে আছে কিনা, সে দেখেনি। একাই বুক পেতে বিপ্লবকে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে যায়। পুলিশ উলটো দিক থেকে গুলি ছুড়েছিল। ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে লুটিয়ে পড়ে চব্বিশ বিপ্লবে সূর্যসন্তান, বিজয়ী বীর আবু সাঈদ।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে প্রিয় মাতৃভূমির কী রূপ কল্পনা করেছিল আবু সাঈদ?
বৈষম্যহীন, শোষণ-নির্যাতনহীন একটা রাষ্ট্র! সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ! দূর গ্রামের দিগন্ত রেখা, যেখানে আকাশ এসে মাটিতে মিশে গেছে। সবুজ-শ্যামল জমিনে উদিত হচ্ছে রক্তলাল সূর্যটা। স্বপ্নময় এ দৃশ্য দেখতে দেখতে কি আবু সাঈদ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল?
এ তার শেষ শয্যা। মায়ের স্নেহমাখা কোল। চোখের পাতা বন্ধ হওয়ার আগে সে দেখেছিল মায়ের অশ্রুভেজা চোখ! নতুন একটি সকাল!
