Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

শরৎচন্দ্রের ‘শেষ প্রশ্ন’ নারীর নবনির্মাণ

Icon

আদিবা নুসরাত

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সব শরীরেই সম্ভবত বাস করে বাস্তুসাপ। কোনো সাপ ঘর গিন্নির মতো আগলে রাখে চারপাশ, কোনো সাপ প্রবল বিষে ছারখার, কোনো সাপ বোধহয় দুইয়ের একও করে না; কেবল সময়ের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকে। এসব নানা ভাবনা নিয়ে খেতে বসে দেরি হয়ে যায় বারবার। ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে উঠে যাই, পাতে পড়ে থাকে দুপুরের অবধারিত ডাল।

জানালায় দেখি মুখোমুখি বসে থাকে মেঘ আর রোদ্দুর-পরস্পরকে কোনোদিন ছুঁতে পারবে না জেনেও? তারপর শ্রাবণ পেরোয়, সুখ যায় দুঃখ আসে, দুঃখ যায় সুখ। এভাবে অনেক বর্ষা পেরিয়ে গেলেও থেকে যায় কিছু ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাস যার স্বাদ লবণাক্ত, সেগুলো বহন করতে হয় একান্ত নিজেকেই। হৃদয়ে ক্রমশ জমা হতে থাকে মৃত্যুর মতো বিচ্ছেদের ওজন। ফুল ফোটানো হয়ে গেলে বৃক্ষের বুকেও জমা হয় ঝরিয়ে ফেলার তাগিদ। আকাশের দিকে চাইলে হঠাৎ বুঝতে পারি এখন শরৎকাল। শরৎ নানা কারণে ভালো লাগে। এ ঋতুতে অন্যতম এক প্রিয় লেখকের জন্মদিন, শরৎচন্দ্র। শরতে জন্ম বলেই কি উনার নাম শরৎচন্দ্র?

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬-১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮; ৩১ ভাদ্র ১২৮৩-২ মাঘ ১৪৩৩) তুমুল জননন্দিত কথাসাহিত্যিক। চাকরির সুবাদে দীর্ঘসময় যিনি থেকেছেন রেঙ্গুন? তার বহু লেখায় সেই যাপনের গল্প টের পাই আমরা। সেসব পড়ে রেংগুন যেতে ইচ্ছা করে। পাহাড়, সমুদ্র, সবুজ কিছুর টানে নয়। কয়েকটি শব্দের টানে, বাক্যের টানে, বিগত সময়কে ফিরে দেখার টানে। মনে হয় ওখানে গেলেই দেখা পাব সুমিত্রার। সাদা রঙের গাউন পড়ে, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে?

শরৎচন্দ্রের লেখায় প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে এসেছে সমাজের নানা বাঁকবদল, সমাজ বিনির্মাণে তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দর্শন, নারী, নারীর প্রেম-বিরহ, মনস্তত্ত্বের জটিলতা, প্রথাবাদ এবং প্রথার বিরোধিতা।

আজকের মূল আলাপের বিষয়ই শরৎ সাহিত্যে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো একজন নারী। প্রথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নিজেকে যে প্রগ্রেসিভ করতে পেরেছে, পেরেছে সময়কেও? যে চিরাচরিত বাঙালি নারীর অবয়ব ভেঙেছে প্রবল প্রতাপে। সমাজের একপেশে চিন্তা যাকে কারারুদ্ধ করে রাখতে পারেনি।

শরৎচন্দ্রের লেখা মানেই জীবনব্যাপী কেবল চোখের জল মেনে নিয়েই সময় পার করে দেওয়া নয়। কেবল নয় অচলার দ্বিধাদ্বন্দ্ব, মনের তাড়না কিংবা প্রায়শ্চিত্ত করার ব্যাকুলতা। নয় পার্বতীর তীব্র প্রেম ও তীব্র প্রত্যাখ্যান। সব অতিক্রম করে গেছে আরও যেসব লেখা, যেসব নিয়ে প্রচুর আলোচনা করার কথা ছিল কিন্তু আলোচনা হয়নি?

শরৎচন্দ্র নারী মনকে ভীষণ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন সেই সঙ্গে দেখিয়েছেন নারীর ওপর সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি। অথচ শরৎসাহিত্য আলোচনায় নারীর প্রেম ও বিরহ যতটা প্রাধান্য পেয়েছে নারীর বিদ্রোহ ততখানি পায়নি। শরৎচন্দ্রের নারী মানেই যেন চিরাচরিত বাংলার সেই নমনীয় চরিত্র হাতে চুড়ি, সিঁদুর, মমতাময়ী সজলচোখে ঐতিহ্য বহন করে চলা এক গড়ানো প্রতিমা। সেসব কিছুর ভিড়েও নারীর আত্মমর্যাদার যে দম্ভ, নারীকে আধুনিক চিন্তা, লেখায় যেভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি সেদিকেই যাব আজ অল্প একটু।

প্রথমে তার দুটি প্রবন্ধ নিয়ে কথা বলব। নারীর আত্ম উন্নয়নে ‘নারীর মূল্য’ এবং ‘স্বরাজ সাধনায় নারী’ এ দুই প্রবন্ধ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দশকের মধ্যবর্তী সময়ে এ প্রবন্ধগুলো রচিত হয়েছে। ওই সময়ে ইউরোপে নারী আন্দোলন হলেও, উপ-মহাদেশে নারীবাদের সেই জোয়ার আসেনি। এখানে বেসিক্যালি উপ-মহাদেশের নারীবাদ এবং পশ্চিমা নারীবাদের যে ডিভাইডার সেই সম্পর্কেও একটা প্রাথমিক সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে লেখাগুলাতে।

‘যে জাতি যে পরিমাণে তার সংশয় ও অবিশ্বাস বর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, নারীর মনুষ্যত্বের স্বাধীনতা যারা যে পরিমাণে মুক্ত করে দিয়েছে, নিজেদের অধীনতার শৃঙ্খলও তাদের তেমনি ঝরে গেছে।’ (স্বরাজ সাধনায় নারী, ১৯২১)।

এরচেয়ে চমৎকার কশাঘাত লেখার মাধ্যমে আর করা যায় না বোধকরি। তৎকালীন সমাজে পুরুষতন্ত্রের যে হীনমন্যতা প্রত্যকটা শব্দ সেখানে গিয়ে আঘাত করেছে। এটাই নারীর অধিকারের প্রথম প্রশ্ন, চিন্তার স্বাধীনতা পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে শেখা। চাপিয়ে দেওয়া মতবাদ দিনের পর দিন ধরে নিজের ঘাড়ে ও মগজে বহন না করা।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর রোহিণী সম্পর্কে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘উপন্যাসের চরিত্র শুধু উপন্যাসের আইনেই মরতে পারে, নীতির চোখ রাঙানিতে তার মরণ চলে না’।

ব্যাপারটা তো আসলেই সঠিক। শুধু সে সময়ে হিন্দু সমাজের নীতিবোধ যেন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে না পড়ে সে কথা চিন্তা করে বঙ্কিম অন্তিম পরিণতিতে মেরে ফেলল রোহিণীকে! কোনো ধরনের পোয়েটিক জাস্টিসের ধারই ধারল না যেন। নীতির লড়াই জিতল। এই যে প্রথাবাদ, মনের সনাতন চিন্তাধারা অতিক্রম করতে না পারা, শরৎচন্দ্র এ নীতির পক্ষে ছিলেন না মোটেও।

শরতের সবচেয়ে তুখোড় নারী চরিত্র সম্ভবত ‘শেষ প্রশ্ন’ উপন্যাসের কমল। খুব ছোট বয়সে বইটা প্রথমবারের মতো পড়ি আমি, আমার মানস জগতে এক তীব্র আলোড়ন তোলে কমল! প্রশ্ন করতে শেখায়, মেনে নিতে শেখায়, তবে সেই মেনে নেওয়া আমি দুর্বল বলে নয় বরং এই মেনে নেওয়াই বড়ত্বের লড়াই। নিজেকে গ্রহণ করার এক চমৎকার শিক্ষা দেয় কমল। সমাজের সেকেলে চিন্তাকে কেবল প্রত্যাখ্যানই নয়, তার বিরোধিতাও এত সহজ ভাষায় করা যায় কী করে-এখনো কমলকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই। কমল যেন উপন্যাসের চরিত্র নয়, যেন রক্ত চলাচল করছে কমলের শরীরে। এতই প্রাণবন্ত। এ মেলো রিয়েলিস্টিক চরিত্র বাংলাসাহিত্যের এক অমূল্য গৌরব।

‘অজিত কহিল, না, তা নয় কিন্তু শেষ ফল যার দুঃখতেই শেষ তার গোড়ার দিকে যত আনন্দই থাক তাকে সত্যকার আনন্দভোগ বলে না এ তো আপনি নিশ্চয়ই মানেন?

কমল বলিল, না, আমি মানিনে। আমি মানি যখন যেটুকু পাই সেটুকুই যেন সত্য বলে মেনে নিতে পারি। দুঃখের দাহ যেন আমার বিগত সুখের শিশির বিন্দুগুলোকেও শুষে ফেলতে না পারে।’

জীবনে সহজ এবং গভীর এই বোধ, এসব কিছুই কমলকে বারবার জীবন্ত করে তোলে, বাস্তব করে তোলে। কমল বাবাহারা এক অনাথ মেয়ে যার প্রথম স্বামী ছিল ক্রিশ্চান। নানা ঘাত-প্রতিঘাত তাকে এক ফোঁটা মলিনও করতে পারেনি।

উপন্যাসের শুরুতে দেখি কমল শিবনাথের স্ত্রী। যদিও তাদের বিয়ে হয়েছে শৈবমতে(!) যেখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। তবে কমলের চেহারায় সেই প্রশ্নচিহ্ন খুঁজে পাই না আমরা। যদি ভালোবাসাই না থাকে তো কেবল থেকে যাওয়ার জন্য যে থেকে যাওয়া সেটুকু নিষ্প্রয়োজন। যদি চাও তো চলে যেতে পার। প্রকৃতই শিবনাথ প্রেমে পড়ে অন্য নারীর। তবুও অপ্রেমিককে পরম প্রেমেই যেন ক্ষমা করে দিল কমল। শিবনাথের সঙ্গে মনোরমার প্রেম ঘটার পর সবাই যখন শিবনাথের শাস্তির জন্য প্রস্তুত, কমলই তখন সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। কমলের সঙ্গে অন্যায় ঘটার ফলে শিবনাথকে ক্ষমা করতে পারল না কেউই। কিন্তু ক্ষমা করে দিল স্বয়ং কমল।

‘দুঃখ যে পাইনি তা বলিনি কিন্তু তাকেই জীবনের শেষ সত্য বলে মেনে নিইনি। শিবনাথের যা দেওয়ার ছিল তা তিনি দিয়েছেন, আমার যা পাওয়ার ছিল তা আমি পেয়েছি। আপনারা তাকে ক্ষমা করুন।’

বন্ধন তো কেবল একপেশে নয় এবং সেক্ষেত্রে একজনই যদি বন্ধনের সুতা আগলে রাখে তা তো ছিঁড়বেই। তার চেয়ে বরং দুজন দুদিকে চলে যাওয়া ভালো। কমল বলার সাহস রাখে, ‘একদিন যাকে ভালোবেসেছি কোনোমতেই তা আর পরিবর্তন হওয়ার জো নেই, মনের এ জড়ধর্ম সুস্থও নয়, সুন্দরও নয়।’

কমলের হাত ধরেই কত কিছু দেখি, সরু রাস্তা, চা বাগান; কত কিছু নতুন করে ভাবি, নারী-পুরুষে বন্ধুত্বও হয় বোধহয় প্রেম ছাপিয়ে। এক ঘরে রাত্রিযাপন মানেই কেবল সেখানে শরীরি উল্লাস নয়। কেবল কাগজে অঙ্কিত নীতিদর্শন, সমাজের হিপোক্রেসি যাকে একবিন্দু টলাতে পারেনি সে-ই কমল। যে ভাঙে এবং ভাঙতে শেখায় প্রাচীনে গেঁথে থাকা সনাতন বোধ।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম