Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আমাদেরও একটি ‘বাইতুল হিকমা’ চাই

Icon

সালাহ্উদ্দিন নাগরী

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুর দিকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনে ইউরোপের অন্ধকার যুগের প্রাক্কালে বিশ্ব মানবতার দূত হিসাবে মহানবি (সা.)-এর আগমনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ৬২২ সালে মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর সীমানা নিয়ত বড় হতে থাকে। আলেকজান্ডার দি গ্রেড (৩২৩ খ্রিষ্টপূর্ব)-এর পর মুসলমানরাই ভারত থেকে মিশর পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ডকে এক শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। উত্তর আফ্রিকা ও ৭১১ সালে স্পেন জয়ের মাধ্যমে মুসলমান সাম্রাজ্য আলেকজান্ডারের তৎকালীন সাম্রাজ্য অপেক্ষা আরও বিস্তৃতি লাভ করে। একক রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্ভবে সমগ্র এলাকা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এক অভূতপূর্ব লালন ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

নতুন নতুন দেশ জয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা যেমন সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকেন এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের বহু মানুষও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকেন। ফলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে ইসলামের অনুশাসন সঠিকভাবে পালনের জন্য ইসলাম সম্পর্কিত অধ্যয়ন জরুরি হয়ে পড়ে। তাই লেখাপড়া ও জ্ঞান অর্জনের প্রতি মুসলমানদের প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা ইসলামে জ্ঞানচর্চাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই তো, পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনের ৩৯ নং সূরা আয-যুমারের ৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করছেন, বলো-যারা জানে, আর যারা জানে না তারা কি সমান? জ্ঞানচর্চা ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির অন্তর্ভুক্ত, তাই তো রাসূল (সা.)-এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ এসেছিল-‘পড় তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলম দিয়ে, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না’। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত ও হাদিসে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। তাই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত ব্যক্তিদের জ্ঞানচর্চার প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের প্রথম দিকে জ্ঞানচর্চার পর্যাপ্ত বইপুস্তক ও রেফারেন্সের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষায় লিখিত পাণ্ডুলিপি, বইপুস্তক অতিদ্রুত আরবিতে অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর এ অনুবাদ কর্ম ও আরবীয়দের অসামান্য জ্ঞান-তৃষ্ণার ওপর ভর করেই পরে ইউরোপে নবজাগরণ (রেনেসাঁস) ঘটেছিল, ইতিহাস কিন্তু তাই বলে।

৭৫০ সালে আব্বাসীয়দের ইসলামি খেলাফতের কর্তৃত্ব নেওয়ার সময় রাজকার্য ইরাকের কু’ফা নগরী থেকে পরিচালিত হতো। পরে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর কর্তৃক রাজধানী বাগদাদে স্থানান্তরিত হলে স্থানীয়দের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আব্বাসীয়দের জীবনাচরণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। স্থানীয় অভিজাতরা জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী ছিলেন, তাই তাদের মধ্যে বই পড়া ও বই সংগ্রহ করার একটা চর্চা আগে থেকেই ছিল। আর সে ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত ও সুসংহত করার জন্য আব্বসীয় খলিফা আল মনসুর স্বপ্নের নগরী বাগদাদে লাইব্রেরি বা পুস্তক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। আব্বাসীয়রা বুঝতে পেরেছিলেন বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষের এত ব্যাপক বিস্তৃত সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হলেই চলবে না, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির সব শাখায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও অসাধারণত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষের ভাব জগৎকে জয় করতে হবে। আর এ ধরনের আবহে আরব্য রজনীর মহানায়ক হারুন অর রশীদ (শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ) খলিফার পদে অধিষ্ঠিত হলে পিতামহ আল মনসুরের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। পিতামহের পুস্তকের এ সংগ্রহশালাকে ‘খিজানাত আল হিকমা’ নাম দিয়ে এটিকে তিনি রাজদরবারের লাইব্রেরি রূপে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রথমে তার পিতা মাহদী ও পিতামহ আল মনসুরের সংগ্রহে থাকা শিল্প, সাহিত্য আর বিজ্ঞানবিষয়ক বই দিয়ে লাইব্রেরি সাজানোর কাজ শুরু করেন। দরবারের সবাইকে এখানে অধ্যয়ন এবং এর কলেবর বৃদ্ধির জন্য অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। পরে এ লাইব্রেরির একাংশ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।

খলিফা হারুনের রেখে যাওয়া খিজানাত আল হিকমা তার পুত্র খলিফা আল মামুনের (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) হাত ধরে উৎকর্ষতার চূড়ান্ত ধাপে উন্নীত হয়। তিনি এর ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সৌন্দর্যবর্ধন করেন। পরবর্তী তিন দশকে এ লাইব্রেরির সেই সংগ্রহ বিশাল রূপ ধারণ করে এবং নতুনভাবে সজ্জিত এ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয় ‘বাইতুল হিকমা’।

খলিফা মামুন বাইতুল হিকমাকে সমৃদ্ধ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রয়োজনীয় পুস্তক, পাণ্ডুলিপি সংগ্রহে মনোযোগ দেন। গ্রিক, মিশরীয়, ভারতীয় এবং চীনা সভ্যতার এমন কোনো পুস্তক অবশিষ্ট ছিল না যে তিনি সংগ্রহ করেননি। অধিকন্তু তিনি সেসব পুস্তক সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হননি, প্রতিটি পুস্তক আরবিতে অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। জানা যায়, তৎকালীন সিসিলির রাজকীয় দরবারের লাইব্রেরিতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ও গণিতের উঁচুমানের পাণ্ডুলিপি ছিল। আল মামুন সেগুলো কপি করতে চেয়েছিলেন, তৎপ্রেক্ষিতে তিনি সিসিলির রাজদরবারে বার্তা পাঠান। রাজা তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলাপ করে সেগুলো খলিফা মামুনের বাইতুল হিকমাতে উপঢৌকন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কথিত আছে সিসিলির সেই পুস্তক ও পাণ্ডুলিপি বাগদাদে নিয়ে আসতে ৪০০ উটের প্রয়োজন পড়েছিল।

আব্বাসীয়দের পুস্তকপ্রেম বা বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কিংবদন্তি হয়ে আছে। খলিফাদের কেউ কেউ যুদ্ধে জড়ানোর আগে প্রতিপক্ষের সংগ্রহে বইপুস্তক কী পরিমাণে আছে তা খোঁজ করতেন এবং যুদ্ধে জয়ের পরই শান্তি চুক্তির শর্ত হিসাবে বইপুস্তক, পাণ্ডুলিপি দাবি করতেন।

মূলত লাইব্রেরি, গবেষণা ব্যুরো ও অনুবাদ কেন্দ্র সমন্বয়ে বাইতুল হিকমা প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুবাদ কেন্দ্রের প্রধান নেস্টোরিয়ান হুনায়ন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৩) একাই গ্রিকসহ বিভিন্ন ভাষায় লিখিত ১১৬টি গ্রন্থ আরবিতে ও সাবিত ইবনে কুরা অ্যাপোলোনিয়াস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড ও টলেমির গুরুত্বপূর্ণ রচনা অনুবাদ করেন। পরবর্তী দেড়শ বছরে পিথাগোরাস, প্লেটো, অ্যারিস্টিটল, গ্যালেনসহ গ্রিক ভাষার সব বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক কর্ম এবং ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী শুষরুতা, আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্তের রচনাবলি আরবিতে অনূদিত হয়। বলা হয় গ্রিকদের এমন কোনো রচনা বাকি ছিল না যা আরবিতে অনুবাদ করা হয়নি।

এ একাডেমি শুধু গ্রিক, সিরীয় বা সংস্কৃত ভাষার গ্রন্থ অনুবাদ করেই ক্ষান্ত থাকেনি। অসংখ্য মৌলিক গবেষণা ও বিভিন্ন উদ্ভাবনী কার্যক্রমে অবদান রেখেছিল। প্রখ্যাত গণিতবিদ অ্যালজাবরা (বীজগণিত)-এর জনক আল খোয়ারিজমি বাইতুল হিকমাতে গবেষণা করতেন। তার অসমান্য গবেষণা গ্রন্থ ‘কিতাব আল জাবের’ থেকে ‘অ্যালজাবরা’ এবং ডাটা প্রসেসিং ও ক্যালকুলেশন সংশ্লিষ্ট ‘অ্যালগোরিদম’ টার্মটি আল খোয়ারিজমি থেকেই গৃহিত। ‘হিন্দু ও অ্যারাবিক নিউমেরাল’ পদ্ধতিটিও বাইতুল হিকমাতেই পূর্ণতা পায়। এছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যার, অসংখ্য মৌলিক গবেষণা বাইতুল হিকমার গবেষকদের মেধা ও শ্রমের ফল।

খলিফা আল মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বাইতুল হিকমা’র অর্থনৈতিক সুবিধা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এর দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেন ও একাডেমিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। তার পূর্বসূরিদের অনুকরণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রচনা অনুসন্ধানে পণ্ডিতদের বিদেশে প্রেরণ করতেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের এতটাই পৃষ্ঠপোষক ছিলেন যে, গবেষকদের লিখিত বা অনূদিত বইয়ের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে তাদের কর্মের প্রতিদান দিতেন।

যে কোনো ভাষাভাষী, অঞ্চল, ধর্ম বিশ্বাস নির্বেশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল বাইতুল হিকমা। তাই তো বলা হয়ে থাকে বাইতুল হিকমায় পা রাখলে আরবি, ফারসি, হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন হেন কোনো ভাষা ছিল না, যা শোনা যেত না। এটি সমাজবিজ্ঞান, কলা, অঙ্ক শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, প্রকৌশল, স্থাপত্যবিদ্যা চর্চার এক অতুলনীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ একাডেমিকে কেন্দ্র করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগান্তকারী গবেষণা, রচনা ও পর্যবেক্ষণ সংঘটিত হতে থাকে। তাই তো এখনকার স্কলাররা বাইতুল হিকমার বিশালতা, ব্যপকতা ও কার্যক্রমের বহুমুখিতা বর্ণনা করতে গিয়ে এ প্রতিষ্ঠানকে এ যুগের গুগলের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আর তাই তো পৃথিবীর তাবৎ সুধিজন ‘আরব্য রজনী’র কেন্দ্রবিন্দু বাগদাদ নগরীর জৌলুস, আভিজাত্য, শান-শওকত ও বিলাসিতায় কেবল আপ্লুত ও মন্ত্রমুগ্ধই হতে থাকেন।

১২৫৮ সালে মোঙ্গলদের নৃশংস ও বিভৎস আক্রমণের মাধ্যমে বাইতুল হিকমাসহ জ্ঞানচর্চার লীলাভূমি বাগদাদ নগরী মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এ নগরীর সব বিদ্বান, পণ্ডিত, বিজ্ঞানী চিন্তকসহ লাখ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়। বাইতুল হিকমার সব বইপুস্তক, রচনাবলি নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। মানুষের রক্ত ও বইপুস্তকের কালিতে ট্রাইগ্রিস নদীর পানি একাকার হয়ে যায়। কিন্তু বাইতুল হিকমাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হলেও বিদগ্ধজনদের ভাবনা থেকে একে মুছে ফেলা যায়নি। হ্যাঁ, বাইতুল হিকমা এখনো আছে। একটু জেনে নেওয়া যাক, উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন ১৮৬৮ সাল থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চারবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি ওয়ালশ্-এর ফ্লিন্টশায়ারে একটি আবাসিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। এ লাইব্রেরি সম্পর্কে বলা হয় Gladstone’s Library: The Hotel where you can sleep with book। ২০১০ সালে আন্তঃধর্মীয় সমঝোতা বৃদ্ধি ও সম্পর্ক উন্নয়নে ওই লাইব্রেরির একটি কক্ষকে ইসলামিক স্বর্ণযুগের ‘বাইতুল হিকমা’ স্মরণে House of Wisdom নামে নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইসলামের স্বর্ণযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ‘বাইতুল হিকমা’র অবদান তুলে ধরাই ইসলামিক রিডিং রুম সংযোজনের মূল উদ্দেশ্য।

পৃথিবীর বুকে ৭০০-৮০০ বছরব্যাপী জ্ঞানচর্চায় মুসলিমদের একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের মূলে ছিল বাইতুল হিকমার অনুবাদ কর্ম, যা আরবীয়দের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেয়। এসব বিষয় ভাবতে ভাবতে আমাদেরও আগ্রহ জাগে জ্ঞানচর্চার শিখরে পৌঁছতে, কিন্তু আমরা কি ওরকম প্রস্তুতি নিতে পেরেছি? আমরা বাংলাভাষায় লেখাপড়া, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, শিল্পসাহিত্য রচনা ও মনের সব অনুভূতি প্রকাশ করি বা করতে চাই। কিন্তু এ বিষয়গুলো আরও সাবলীল এবং যুগোপযোগীভাবে সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় বইপুস্তক ও রেফারেন্স অনেক ক্ষেত্রেই হাতের কাছে পাওয়া যায় না। ফলে আমাদের মেধা-মনন, পরিশ্রমের সর্বোচ্চ প্রাপ্তিও হয়তো ঘটে না। ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে অনেক সাবজেক্টে ইংরেজি ভাষায়ই লেখাপড়া করতে হয়। আর যেসব সাবজেক্টে বাংলাভাষায় লেখাপড়া করা যায়, সে সব সাবজেক্টে রেফারেন্স হিসাবে বাংলা বই এর সম্ভার খুব একটা বড় নয়। ফলে উন্নত দেশের সঙ্গে উচ্চশিক্ষায় পেরে উঠা যাচ্ছে না।

বিশ্ব সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসের ধারাবাহিক সংকলনের বাংলা কপি আমাদের নেই। পৃথিবীর বড় বড় লেখক, গবেষক, বিজ্ঞানীদের যেসব প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে, সাহিত্য, চিকিৎসা, অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে প্রতিবছর যারা নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন, তাদের অবদানের বাংলায় অনূদিত সংকলন আমাদের নেই। দু-একজন অনুবাদকের বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে দু-চারটা বইয়ের অনুবাদ দিয়ে সব শ্রেণির শিক্ষার্থী, গবেষক, চিন্তক ও সংস্কারকদের জ্ঞান-তৃষ্ণা মেটানো যাচ্ছে না।

তাহলে কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে? কীভাবে আমরা প্রয়োজনীয় সব রচনা কর্মের বাংলায় অনূদিত সংস্করণ পেতে পারি? জ্ঞানচর্চার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হলো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার ছাত্র-শিক্ষক, গবেষকদের যেসব বিদেশি রচনাকর্মের দারস্থ হতে হয়, সেগুলো নিয়মিত অনুবাদের জন্য প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অনুবাদ সেল’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

আমাদের বাংলা একাডেমিকে অনুবাদ কর্মের ওপর জোর দিতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতার বিকাশে ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার তাবৎ পুস্তক ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করতে হবে। এটিকে নিরবচ্ছিন্ন একটি প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যত ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি আছে সবখানে ‘অনুবাদ সেল’ তৈরি করে বাংলায় অনুবাদের বাধ্যবাধকতায় আনতে হবে।

কিছু কিছু ওয়েবসাইট জ্ঞানচর্চা ও রেফারেন্সের অত্যন্ত বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসাবে ধরা হয়। ‘এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’ ১৭৬৮ এবং ১৯০১ সাল থেকে যথাক্রমে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত থেকে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান শিল্পকলাসহ বহুবিধ জ্ঞানের একটি ইংরেজি বিশ্বকোষ। প্রায় নিয়মিত একশজন সম্পাদক, চার হাজার অবদানকারীর মাধ্যমে এটি লিখিত ও সংশোধিত হয়ে থাকে। যাদের মধ্যে প্রায় ১৪০ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও ৫ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টও ছিলেন। বর্তমানে প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে ২০০৮ সাল থেকে এটি অনলাইন সংস্করণ চালু করেছে। একইভাবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লাইব্রেরি ‘ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’ এবং ‘ইউনেস্কো’র যৌথ উদ্যোগে ওয়ার্ল্ড ডিজিটাল লাইব্রেরি আরেকটি নির্ভরযোগ্য তথ্য ভান্ডার, ২০০৯ সালে ২১ এপ্রিল হোম পেজ উদ্বোধনের মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু করে। এ ওয়েবসাইটটি ইংরেজি ও আরও দু-একটি ভাষায় তাদের লেখনী প্রকাশ করে থাকে। এ দুটি ওয়েবসাইটসহ আরও যেসব ওয়েবসাইট বিশ্বস্ততার সঙ্গে জ্ঞান বিকাশে অবদান রেখে চলেছে, সেগুলো বাংলায় চালুর বিষয়টি যথাস্থানে তুলে ধরা যেতে পারে। তাহলে বাংলাভাষায় গবেষণা, রেফারেন্স সংগ্রহ অনেক সহজ হয়ে যাবে।

জ্ঞানচর্চায় উন্মাদনা সৃষ্টি ও জ্ঞান-তৃষ্ণা মিটাতে তরুণ প্রজন্মকে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারের সঙ্গে আমাদের মাতৃভাষায় পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আর সে জন্য আমাদেরও ওই ‘বাইতুল হিকমা’ বা House of Wisdom এর মতো একটি লাইব্রেরি ও অনুবাদ প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। যেখানে এ দেশের তরুণ প্রজন্ম ও বিশ্বের সব প্রান্তের গবেষক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, সমাজচিন্তক অবদান রাখার জন্য মুখিয়ে থাকবেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম