বই আলোচনা
মহাদিগন্তের কবি উত্তম দাশ
ইকবাল মাহুফুজ
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঈশ্বরী এখন তবে কিছু মুদ্রা কিছু সুর
আমাকে শেখাবে, ঈশ্বরের নিজস্ব নির্মাণ
সেই সুরে সে মুদ্রায় বিভূতি দেখাবে
-উত্তম দাশ
উত্তম দাশ নিভৃতচারী এক কবির নাম। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার চরআলেকজান্ডার গ্রামে জন্ম নিলেও দেশভাগের ক্ষত নিয়ে থিতু হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। অধ্যাপনা করেছেন খিদিরপুর কলেজে। ১৯৩৯ সাল থেকে ২০১৪।
নিভৃতচারী একজন মানুষ কীভাবে এতটা বিস্তৃত হয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা নিয়েছিলেন তা সত্যি অবাক করার মতো। তার বিখ্যাত ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকাই সম্ভবত এপার-ওপার একাকার করে সবাইকে মিলিয়ে দিয়েছিল এক মোহনায়।
জন্মভূমি ছেড়ে গিয়েছিলেন কিংবা যেতে হয়েছিল, কিন্তু আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন। ভ্রমণপ্রিয় ছিলেন। বহুবার এসেছেন জন্মভূমি বাংলায়। তাকে চিনেছিলাম তার মৃত্যুর পর। এবং আরও আরও বিস্তৃত পরিসরে জানলাম কবি মাহমুদ কামাল ও মোহাম্মদ আব্দুল মাননান সম্পাদিত- ‘কবি উত্তম দাশ : জীবন ও সাহিত্য’ শীর্র্ষক বইয়ের সুবাদে।
‘কবি উত্তম দাশ : জীবন ও সাহিত্য’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল এ বছরের জানুয়ারিতে। একজন কবি উত্তম দাশকে মলাটবদ্ধ করা যে সহজ নয় তা কিছুটা অনুমান করা গেল। তবে এ সম্পাদনায় অনেকাংশেই তৃষ্ণা মিটবে কবির পরিচিত কিংবা অপরিচিত পাঠকদের। ২২৪ পৃষ্ঠার এ আয়োজনে উত্তম দাশের সাহিত্য কর্মের বিশ্লেষণ, ব্যক্তিগত জীবন, স্মৃতিকথা, নিবেদিত কবিতা স্থান পেয়েছে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখার পুনর্মুদ্রণ হলেও সব মিলিয়ে সম্পাদকদের আন্তরিক পরিশ্রমের স্পষ্ট ছাপ লক্ষণীয়।
এই সংকলনটির প্রাঞ্জল বিন্যাস ও যত্নআত্তি দেখেই মনে হবে কবি উত্তম দাশ কতটা আত্মীয় ছিলেন, কতটা মিশে গিয়েছিলেন এই প্রিয় মানুষদের সঙ্গে। স্মৃতিকথায় কবি ফরিদ আহমদ দুলাল লিখেছেন- ‘উত্তম দাশকে আমি স্মরণ করতে চাই তার কাব্যকৃতির জন্য, স্মরণ করতে চাই তার ঋদ্ধ গদ্যের জন্য, সম্পাদনা কর্মের জন্য, স্মরণ করতে চাই বাগ্মি উত্তম দাশকে এবং সর্বোপরি মহৎপ্রাণ মানুষ হিসেবে তার প্রতি জানাতে চাই গভীর শ্রদ্ধা।’ এবং তিনি তার স্মৃতিচারণার শেষে লিখেছেন- ‘উত্তম দা ছিলেন সবার মধ্যে পুরুষোত্তম, অনন্য সাধারণ নরোত্তম উত্তম দাশকে জানাই বিদায় শ্রদ্ধা।’
পুনর্মুদ্রণ এবং নতুন মিলিয়ে আছে বারো লেখকের সাহিত্য বিশেষণ। প্রয়াত উজ্জ্বল কুমার মজুমদারের বিশ্লেষণটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রাঞ্জল বিশ্লেষণ আছে কবি তরুণ সান্যাল ও ভবতোষ দত্তের।
মাহমুদ কামাল লিখেছেন- ‘উত্তম দাশ মৃদুভাষী কবি। অর্থে উচ্চকিত কিন্তু প্রকাশে সজ্জন।’ এ পর্বে আরও লিখেছেন- সুমিতা চক্রবর্তী, ফরিদ আহমদ দুলাল, রফিক উল ইসলাম, জুলফিকার হায়দার, অনুপম হাসান, তপন বাগচী, রনি অধিকারী ও নাসিরুদ্দিন শাহ।
নিবেদিত কবিতা লিখেছেন- শ্যামলকান্তি দাশ, ময়ূখ দাশ, রম্যানী দাশ, আবদুল মান্নান সরকার, মেঘনাদ ঘোষাল, জনসন সন্দীপ, অমলেন্দু বিশ্বাস, রাজকুমার শেখ, সবুজ মাহমুদ ও মাহফুজ মুজাহিদ। প্রায় সবগুলো কবিতায়ই এক গোপন আবেগময় শ্রদ্ধার মিশেল স্পষ্ট অনুভূত হয়েছে।
উত্তম দাশ তার কবিতায় লিখেছেন- ‘আমরা তো বেশ আছি/ এই মাসে ধর্ষণ তো তিনটে/ মাত্র তিনটে/ বেশ আছি।’ উত্তম দাশের কবিতার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কবি মৃণাল বসুচৌধুরী লিখেছেন- ‘আমাদের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মোড়কে শান্তি ও শৃঙ্খলার অভিভাবকদের ওপর মৃদু লাঠিচার্জ এই কবিতা।’
মাহবুব সাদিকের ‘উত্তম দাশের মহাপ্রয়াণ’ শিরোনামের লেখাটি আগেই পড়েছি ভিন্ন মাধ্যমে। একজন উত্তম দাশ আমাদের কতটা আত্মীয় ছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কবি মাহবুব সাদিকের এই স্মৃতিকথায়। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার গদ্য এক ভিন্নতর ধারায় বয়ে চলে।
এ সংকলনে তার ‘পদ্মকাঁটার বিষে জড়ালে শরীর’ শিরোনামের লেখাটিও তেমন ভালো লাগল। খুব ভালো লেগেছে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর লেখা। ‘আগামীকালের জন্য তুমি যে ব্যাগ গোছাচ্ছ/ তার মধ্যে পুরোটাই তো জীবনের গল্প’ এবং ‘তুমি কার পক্ষে খেলবে জীবন না মৃত্যুর?’ উত্তম দাশের এই পঙ্ক্তিদ্বয়ের
কথা বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন- ‘এই যে জীবন ও মৃত্যুর সহ-অবস্থান, তার মধ্যেই অঙ্কুরিত হয় বীজ, পত্র-পল্লবে ভ’রে ওঠে ভুবন, ঝরা পাতা থেকে মরা কাণ্ডে রেখে যায় অনন্তের সংবাদ।’ এমন গদ্যময় লেখাগুলোই বোধহয় এত দীর্ঘ পাঠকে প্রাঞ্জল করে তুলেছে। ‘জীবন ও সাহিত্য’ শীর্ষক এ পর্বে আরও লেখা আছে- গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুস শুকুর খান ও কাজল চক্রবর্তীর।
কবিপত্নী মালবিকা দাশের ছোট্ট সহজ স্মৃতিচারণাটি আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে ক্ষণিকের জন্য। লিখতে লিখতে তিনি যখন লিখেন- ‘দেশে দেশে তার ঘর ছিল, আর সেই ঘর খুঁজে নিতে প্রায়ই বেরিয়ে যেত যে মানুষটি সে হঠাৎ এক গভীর নিশীথে জীবনের কোলাহল থেকে নিঃশব্দে চলে গেল অনন্তের আহ্বানে।’ তিনিও কবি, তাই বুঝি এত প্রেম এত গদ্যময়তা।
প্রতিটি লেখার শিরোনামই সুন্দর, আবেদনময়। মোহাম্মদ আবদুল মাননানের ‘আরও একটু কাছে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল’ শিরোনামের লেখাটির স্মৃতিচারণা ভালো লেগেছে। লিখেছেন- ফরিদ আহমদ দুলাল, লিলি হক, খন্দকার নাজিম উদ্দিন, তাহমিনা কোরাইশী, রোকেয়া ইসলাম।
সংকলনভুক্ত হয়েছে উত্তম দাশের জীবনপঞ্জী, মহাদিগন্ত পুরস্কার প্রসঙ্গ এবং দুর্লভ সব ছবি। কবি উত্তম দাশের প্রয়াণ তার প্রিয়জনদের বুকে কতটা ক্ষত রেখে গেছে তা বোঝা যায় মাহমুদ কামালের কথায়।
‘কবি উত্তম দাশ, আমার দাদা’ স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ‘উত্তম দা’র প্রয়াণের খবর যখন তার প্রিয় ছাত্র মেঘনাদ ঘোষাল ১৩ জুন ভোরবেলায় মুঠোফোনে জানায়, শুনেই চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। সে কান্না এখনও থামেনি।’ সত্যি, এ কান্না থামার নয়।
