Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

সৌন্দর্যের জন্য মৃত্যুবরণ করেছিলে

Icon

আদিবা নুসরাত

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সৌন্দর্যের জন্য মৃত্যুবরণ করেছিলে

সন্ধ্যা হওয়া এখনো কিছুটা বাকি ঠিক এ সময়, কমে আসা কিন্তু স্পষ্ট আলোয় দেখতে পেলাম জানালায় কতদিন পর কবুতর এসে বসল। গলায় চকচকে ময়ূরকণ্ঠী রং। লেজের পালক সামান্য কাঁপছে হালকা বাতাসে। এত যে মুখোমুখি আমরা এখন, চাইলে অনায়াসে প্রচুর কুশল সংবাদ আদান প্রদান করা যায়। কেবল হাত নাড়িয়ে খানিকটা সাড়া দিয়ে আবার নীরবতা আমাদের। কয়েকটা দিন এ রকম যায় মনে হয় কেবল ইশারায় কথা বলে কাজ চালিয়ে নিই। অকারণ কারও শব্দ শুনলেই মনে হয়, কথার অপচয়। প্রকৃতই নীরবতা ঈশ্বরসম। এ সময় নিজেকে নিয়েই বসে থাকতে ভালো লাগে কেবল, আদি থেকে অহম।

এক সময় এ রকম ইচ্ছা হতো যে অটোয়ার থেকে অস্ট্রিয়া চষে ফেলতে হবে। তারপর জলের মতো এতটা শান্ত হয়ে গেল সেই মন! মনে হয় রোজকার এসব গড়পড়তা দিন, দেওয়ালে মাকড়সার হেঁটে যাওয়া, খুচরা পয়সার হিসাব জীবনে কম মূল্যবান; আসলে কী? এসব অসংলগ্ন আলাপ ও অপ্রয়োজনীয়তার ভিড়েই ডিকিনসন অনুভব করেছিলেন মৃত্যুর তাৎপর্য। মৃত্যু তো এক দীর্ঘ বিচ্ছেদ। সেখানে তিনি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন ভীষণ নিস্তব্ধ এক মুহূর্ত ঠিক সাইক্লোনের কেন্দ্রের মতো শীতল অঞ্চল সেটি। কিংবা এ শীতলতা আপেক্ষিক কিনা তা বলতে পারি না। এত আয়োজনকালে কেবলই নিস্তব্ধতা মেনে নিতে মন খানিক অস্বীকারই করে কিংবা সোল ডিভাইড হওয়ার সময় কেন সব ছাপিয়ে কেবল কাঠ চেরাইয়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে?

ডিকিনসন বলেছিলেন সত্য ও সুন্দর, যার কারণেই মৃত্যু ঘটুক এপিটাফের নাম একদিন ঠিকই মিলিয়ে যায়। পৃথিবীর এ নশ্বরতা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা কেবল ছাপ রেখে যেতে চাই প্রবল ব্যস্ততায়। এ প্রবাহমান সময় ক্ষয় করে ফেলে সবই, সব। কিছুই পারি না রাখতে। 

‘রাখতে যা চাই রয় না তাও ধুলায় একাকার 

যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর?’

তবুও একদিন বেঁচে থাকতে থাকতে আমরা মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করি। অবশ্যম্ভাবী সেই পরিণতির দিন সবারই তো আসবে। আচমকাই বেজে উঠবে বিদায়ের দামামা, সব সবুজ পাতা তখন উধাও!

ডিকিনসনকে দেখতে পাই সমগ্র একলা এক বাড়িজুড়ে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছেন, দুলছেন চেয়ারে। শরীরে সাদা গাউন, লাল রঙের লেস। পাতা পাতা লিখে আবার সজোরে কাটাকুটি। এরূপ এক বান্ধবহীন জীবন সেইখানে, সেই নিরিবিলিতে কেবল মৃত্যুই যেন গহন সত্য। মৃত্যু কি সবচেয়ে প্রিয়তম বন্ধুর মতো,‘মরণরে তুহুঁ মম শ্যাম সমান?’ নাকি মৃত্যু কোনো স্মিতহাসির যুবক, যে দরজায় দাঁড়িয়ে চিরদিন অপেক্ষা করে যাচ্ছে আমার জন্য, যেহেতু আমার সময় নাই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার! 

এগুলো ডিকিনসনের চিন্তা, এসব চিন্তা করতে করতে দেখি সন্ধ্যা নেমে আসছে, সিঁড়িতে মিউমিউ করছে শুভ্র রঙের বিড়াল, হেজেল চোখ। সন্ধ্যাবেলা ঘুম ভেঙে গেলে ডিকিনসনেরও কি কান্না পেত? 

আচমকা দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে সেইক্ষণে রাশিরাশি বসন্তফুল নেমে এলো বোধহয়, কত রং আর বেরঙের। ‘Wild nights should be Our luxury!’

এ কবিতাটি তীব্র প্রেমের হলেও এইখানে প্রেমিক কে, তা নিয়ে চলে এক অভেদ্য সংশয়। এ কি রক্ত-মাংসের প্রেমিক? নাকি দূর থেকে দূরের সেই ধূসর আর ঝাপসা রঙের অপ্রিয় অধ্যায়!

ডিকিনসন পড়তে গিয়ে আমি আমার কিছু কিছু বন্ধুকে মৃত্যুর মতো ভালোবেসে ফেলেছি। তারপর বহু ভাবনার পর চিন্তা করে পেয়েছি জিনিসগুলো মোটাদাগে মৃত্যু নিয়ে রোমান্টিসিজম মনে হলেও এইখানে কিছু হাই ফিলোসফিকাল থট লুকানো আছে। যেমন একদিন ভোরবেলা এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ চলমান যে, তোমার চোখের ছায়ায় যেন আমার মরণ আসে কিংবা এ সংক্রান্ত কিছু একটা। তো সে আমাকে পালটা উত্তর দিল, ‘মরণ ছাড়া আর কোনো কথা নাই তোমার মুখে?’ এ প্রশ্নে হুঁশে ফিরে মনে পড়ল হয়তো অজ্ঞানে এবং সজ্ঞানে মৃত্যু নিয়ে আরও একাধিক আলাপ তারে দিয়ে ফেলেছি। যাই হোক পড়ছিলাম ডিকিনসন। ডিকিনসন পড়ার সময় শীতকাল আমার ভালো লাগত না কী কারণে এখানে বলি।

ভোরবেলা ক্লাস, সাতটা কি সাড়ে সাতটার। রান্নাঘরে কফির মগ খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই, তো হাতের টোকা লেগে নিচে পড়ে গেল পিতলের বাসন, সেটা মেঝেতে গড়িয়ে যেতে যেতে ঘরময় তৈরি করল এক রিনরিনে বাজনা, যে রকম শব্দ মাথা থেকে হুট করে সরানো যায় না কিংবা যে রকম শব্দ আরও কাছাকাছি শব্দ ধরে ধরে বহু গোপনের দরজা খুলে দেওযার ক্ষমতা রাখে। আমি তীব্র আবেশে সেই ঘূর্ণনের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করছিলাম, সেই সময়টা ন্যানো সেকেন্ডের মতো কম। তবুও তা লিখতে গেলে শুধু ডিকিনসনিও দর্শন দিয়ে কুলাবে না বোধহয়। যাই হোক, কফি-টফি তো আর খাওয়া হলো না! রাস্তায় কনকনে শীত, আমি বেণির নিচে ফিতা বাঁধতেও গেছি ভুলে! এ সব খামখেয়ালি মেজাজ আমার, যে প্রেমিক চিরদিন আমার কাছে চেয়েছে গোলাপ তার জন্য নিয়ে গেছি রাধাচূড়া ফুল। যে চায় নাই কিছুই তারে বেভুলে দিয়ে বসে থেকেছি মস্ত একটা হৃদয়। 

যেতে যেতে দেখি সেকেন্ড পিরিয়ডে ডিকিনসন, আমি চিরদিন ভদ্র সভ্য বালিকা, এ রূপ মুখ নিয়ে স্যারের লেকচার শুনছি। সেটার বাংলা অনুবাদ করলে অনেকটা এ রকম দাঁড়ায়, ডিকিনসন যেহেতু মিস্টিক পোয়েট- সে মিস্টিসিজমের বিষয়াদিতে আলোকপাত করবে এটাই স্বাভাবিক। মৃত্যু একটা মিস্টিক থিম। মৃত্যু বলতে আমরা যে রকম এন্ডিং বুঝাই, সে মোটাদাগে মৃত্যুকে সে রকম মনে করে না। ডেথ, ডেথ, ডেথ...

‘I felt a funeral in my brain,

And Mourners to and fro

Kept treading - treading - till it seemed

That Sense was breaking through’

যতটা মন খারাপ নিয়ে ক্লাসে যাচ্ছি তারও অধিক মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরে আসছি! এই যেন রোজকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেকদিন ফিরে অনন্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে ডিকিনসনকে ভুলে যেতাম। একেকদিন ব্যস্ত হয়ে যেতাম জমিয়ে রাখা শাড়ি ড্রাই ওয়াশে দিতে। একেকদিন কোনো কাজ থাকত না। তন্ন তন্ন করে পড়ে ফেলতাম ডিকিনসন। 

‘There is a pain — so utter —

It swallows substance up —

Then covers the Abyss with Trance —

So Memory can step

Around — across — upon it —

As one within a Swoon —

Goes safely — where an open eye —

Would drop Him — Bone by Bone’

পড়তে পড়তে টের পাই, আমার ব্যথারও তো কোনো নিরাময় নাই অথবা নিরাময়ই যদি থাকল সেইটা আর কীসের ব্যথা! এ রূপে বেদনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে করতে আমার নোট প্যাডেও জমা হয়ে গেছে কত কথা তা আজ পড়ে দেখি-

যেহেতু বেদনা আছে, তা সশব্দে প্রকাশ করি

এই বেদনা শোষণ করে আমার সমগ্র দেহ 

এই বেদনা যেন তীব্র আফিম

অতলস্পর্শী বেদনা আমার।

আরও লেখা, ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে চোখ। পাতা উলটিয়ে চলে যাই অন্য কোথাও, স্মৃতি জেগে ওঠে সবিনয় নিবেদনে। দূরে মিহি শব্দে শোনা যাচ্ছে কোনো ঘুম ভাঙা পাখির ডাক, হয়তোবা সে তার ভাষায় বলছে নিজস্ব অন্তর্দহনের গল্প। আলো নিভিয়ে দিলে আরও ঘন হয়ে ওঠে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। তারপর মস্তিষ্কের খুব গভীরে চেতনা আর অচেতনা মিলেমিশে শুরু করে এক অপার্থিব ভ্রমণ। তখন নিজেকে দেখি ডিকিনসনের চেয়ারের পাশে হাত গুটিয়ে বসে আছি, উনার চোখ পাথরের মতো স্থির, অনুভূতিশূন্য। আলস্যে তাকে আর জিজ্ঞেস করা হয় না, তুমিই ডিকিনসন নাকি আমার চিরাচরিত মেলানকোলিক সৌল? 


মৃত্যুবরণ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম