Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বই আলোচনা

হরিজন ও দলিত জনগোষ্ঠীর তথ্যবহুল দলিল

Icon

আশরাফুল আলম পিনটু

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তথাকথিত অস্পৃশ্য বা নিম্নবর্ণের মানুষ নিয়ে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বই- বাংলাদেশের হরিজন ও দলিত জনগোষ্ঠী। লিখেছেন আনারুল হক আনা। বাংলাদেশে হরিজন শব্দটির ব্যবহার থাকলেও তেমন কোনো গবেষণাগ্রন্থ না থাকায় এ সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি কম। সাধারণভাবে আমরা হরিজন বলতে বুঝি হিন্দু সমাজের নিুবর্ণের জনগোষ্ঠী। কিন্তু শব্দটির উৎপত্তি ও জনগোষ্ঠীর নামকরণের সঙ্গে আছে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকার বিলুপ্তপ্রায় দলিত জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, সামাজিক পরিবর্তন, অস্তিত্বের সংকট, অর্থনৈতিক অবস্থাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করে উপস্থাপন করেছেন পরিশ্রমী লেখক। গ্রন্থে ৬টি অধ্যায় ছাড়াও আছে পূর্বসূত্র ও সূচনা অংশ। অধ্যায় : ১. ভারতবর্ষে বর্ণভেদের বিভিন্ন পর্যায়, অধ্যায় : ২. বাংলদেশের হরিজন ও অন্যান্য দলিত জনগোষ্ঠী, অধ্যায় : ৩. কয়েকটি হরিজন ও দলিত জনগোষ্ঠীর বিয়ে, অধ্যায় : ৪. অনুসন্ধানে হরিজন পল্লী ও সুইপার কোয়ার্টার, অধ্যায় : ৫. বাংলাদেশের দলিত আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী, অধ্যায় : ৬. কয়েকটি উপজাতি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিয়ে।

প্রথম অধ্যায়ের বিষয়- ভারতবর্ষের প্রাচীন জাতিভেদ, প্রাচীন গ্রন্থে বর্ণ বিভাজন ও অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী, মধ্যযুগের গ্রন্থে বর্ণ বিভাজন ও অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী, সংকর জাতির উৎপত্তি, আধুনিক বর্ণ বিভাজন ও অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী, জাতিভেদ কি সমর্থন যোগ্য?, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট, দলিত জনগোষ্ঠীর সমস্যা ও সমাধানের সুপারিশ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে হরিজন ও দলিতদের সংজ্ঞা এবং বাংলাদেশের ৮৫টি হরিজন ও অন্যান্য দলিত জনগোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়। ৫ম অধ্যায়ে উপজাতি বা আদিবাসীদের দলিতদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের ২৮টি জনগোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখক সংজ্ঞায় স্পষ্ট করেছেন হরিজন ও দলিত আসলে পৃথক জনগোষ্ঠী। সব হরিজন দলিতের অন্তর্ভুক্ত হলেও সব দলিত হরিজন নন।

বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ প্রচারিত লিফলেট অনুযায়ী বাংলাদেশে পরিচ্ছন্ন পেশায় নিয়োজিত বাঁশফোড়, হেলা, লালবেগী, ডোমার, রাউত, হাঁড়ি, ডোম (মাঘাইয়া) ও বাল্মিকী এ আট জাতের জনগোষ্ঠী নিজেদের হরিজন দাবি করেন। পরিচ্ছন্ন সেবায় নিয়োজিত বলে শুধু তারাই বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও অন্য জনগোষ্ঠীরও হরিজন আছেন। তারা ব্যবসা বা অন্য কাজ করেন।

লেখকের আলোচনা থেকে জানা যায়, হরিজন শব্দটি তথাকথিত অস্পৃশ্য বা অবর্ণ হিন্দুদের সমষ্টিগতভাবে নামকরণ করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী পুনা চুক্তির পর। তবে নামটি গান্ধীর উদ্ভাবন ছিল না। এক অস্পৃশ্য পত্রলেখকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। গুজরাটের কবিসন্ত শব্দটি নাকি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ভিন্ন প্রসঙ্গে। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ অনুযায়ী অস্পৃশ্য হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী অনশন করছিলেন। ওইসময় নিষ্পেষিত অস্পৃশ্য হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ড. আম্বেদকর। অবশেষে স্বতন্ত্র নির্বাচনের পরিবর্তে আসন সংরক্ষণের নীতিকে বর্ণ হিন্দু ও অবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছিল। এটাই ছিল পুনা চুক্তি। এ চুক্তির পর অবর্ণ হিন্দুদের সরকারি মতে নামকরণ হয়েছিল তপশিল জাতি। আর মহাত্মা গান্ধীর দেয়া নাম হরিজন।

লেখক আলোচনায় বলেছেন সব ধর্ম, উপজাতি, আদিবাসী, বিভিন্ন পেশার বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষই দলিত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সমাজের রীতি-নীতি, রাষ্ট্রীয় কাঠামো, পরিচালন পদ্ধতি পরিবর্তনের পাশাপাশি দলিত শ্রেণীভুক্ত পেশা বা গোষ্ঠীর শিরোনামও পরিবর্তন হয়ে আসছে। হিন্দু সমাজে বর্ণ বিভাজনের ক্রমশ বিলুপ্ত ঘটছে বটে, তবে শোষণ আর নিপীড়ন প্রক্রিয়া সচল থাকার কারণে উদ্ভব ঘটছে নতুন বিভাজন। এ বিভাজন নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর সীমারেখায় মধ্যে নয়; উৎপত্তি ঘটছে সর্বক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট শিরোনামে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। বর্ণ বিভাজন নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের সুপারিশ ও নিজস্ব মতও উপস্থাপন করেছেন লেখক। সঙ্গে যুক্ত করেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী, ড. আম্বেদকর, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখের বর্ণ বিভাজনের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া।

বইটির বিষয়-আশয় সব পাঠকের জন্য সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে বইটি নৃ-বিজ্ঞান, ফোকলোর, সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য খুবই কাজে লাগবে। বইটি প্রকাশ করেছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু। মূল্য ৫০০ টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম