Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

কবি জীবনানন্দ দাশ : মানুষটি

Icon

হাসান হাফিজ

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা কবিতার বিস্ময় জীবনানন্দ দাশ। স্বভাবলাজুক মানুষটির জীবনযাপন, ব্যক্তিগত বিষয় আশয়, চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মনস্ক পাঠকের কৌতূহল কম নয়। এ নিবন্ধে সে ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে চাই। হাওড়া গার্লস কলেজের ইংরেজি বিভাগে কবি যখন অধ্যাপনা করতেন, সে সময়কার কথা। সেই কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিচারণ করেছেন তার কবি সহকর্মী জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে ‘...একদিন অধ্যক্ষ বিজয়বাবু এসে বললেন, ইংরেজি বিভাগে একজন নতুন অধ্যাপক আসছেন। তার নাম জীবনানন্দ দাশ। শুনেই আমরা বিস্মিত হয়ে কবি জীবনানন্দের আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখন ‘নাভানা’ থেকে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সে সময়ে তিনি যথেষ্ট পরিচিত সুখ্যাত এবং বিতর্কিতও বটে। শনিবারের চিঠিতে প্রায় প্রতি সংখ্যায় তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হতো। কারণ তার কবিতার বিষয়বস্তু রচনা-ভঙ্গিমা ও তাৎপর্য খুবই অদ্ভুত এবং উদ্ভট বলে মনে হয়েছিল। যাই হোক, তিনি চাকরিতে যোগদান করলেন। ইতঃপূর্বে দেশভাগ হয়েছে। স্বাধীনতা এসেছে এবং পূর্ববঙ্গ থেকে দলে দলে বাস্তুহারা সাধারণ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছিলেন। সেই তিনি গার্লস কলেজে বিনা আবেদনে অধ্যাপনায় বৃত হলেন, এবং শুধু অধ্যাপক নন, একেবারেই ইংরেজি বিভাগের প্রধান হয়েই যোগদান করলেন। অধ্যক্ষ বিজয়কৃষ্ণের মানুষ চিনবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তিনি সহজেই জীবনানন্দের প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন। ইতঃপূর্বে কবিতা লেখার অপরাধে ব্রাহ্ম নেত্রীদের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা সিটি কলেজের চাকরি খোয়ালেন। পরে পূর্ববঙ্গের দু-একটি কলেজে যোগ দিলেন, কিন্তু অধ্যাপক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি লাভ করতে পারেননি। তবে হাওড়া গার্লস কলেজের ছাত্রীদের কাছ থেকে প্রচুর শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন। তিনি ইংরেজি গদ্য প্রবন্ধ পড়াতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংকলিত গদ্যগ্রন্থটি অতিশয় নীরস। কিন্তু ছাত্রীদের কাছে শুনেছি নীরস গদ্যও নাকি তার পড়ানোর গুণে কবিতার মতো স্বাদু হয়ে উঠতো। প্রথম দিনের কথা বলি। আমরা সবাই আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। অধ্যক্ষ মহাশয় এক নতুন অধ্যাপককে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ঘরে এলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন মধ্যবয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোক। একটি চক্ষু একটু ট্যারা মতো। অত্যন্ত কম কথা বলেন। মৃদু হাসি ও নমস্কার বিনিময়ের পর তাকে আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও অন্তরঙ্গতার সঙ্গে গ্রহণ করলাম। বেশি কথা বলতেন না বলে বোধহয় সহজেই অন্তরঙ্গ হতে পারতেন। সবাই মিলে চা খাওয়া হতো, অধ্যাপিকা বিনিতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার সঙ্গে রসিকতাজুড়ে দিতেন। বলতেন, কবি, আপনার কাপ থেকে একটু চা আমার ডিশে ঢেলে দিন। তিনি সকৌতুকে চোখ তুলে বলতেন, কেন? বিনিতা বলতেন, হয়তো এমন দিন আসতে পারে যে দিন আমি সবার কাছে গর্ব করতে পারব, জীবনানন্দ তার কাপ থেকে আমাকে চা ঢেলে দিয়েছিলেন। শুনেই তিনি অট্টহাস্য করে উঠতেন, কিন্তু সে বড় মজার হাসি। সব চোখ-মুখ হেসে উঠতো। কিন্তু কোনো শব্দ ছিল না-যাকে বলে শব্দহীন অট্টহাস্য।...’ ধূসর পাণ্ডুলিপির কবি কেমন মানুষ ছিলেন? তার ব্যক্তিসত্তার সরূপটিই বা কোনো ধরনের? আবুল কালাম শামসুদ্দীনের লেখা ‘কবি জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে’ থেকে খানিক উদ্ধৃতি-নোতুন বয়সের অনভিজ্ঞ মনের কাছে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ যে সাড়া জাগাতে পারেনি, ‘বলতা সেন’ দ্বারাই তা সম্ভব হয়েছিল। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি আমরা যত্রতন্ত্র মুখে মুখে আবৃত্তি করে বেড়াতুম। কলেজের এক অনুষ্ঠানেও আবৃত্তি করলুম একদিন। একদিন বাড়িতে গেলাম তার। কলেজে তার প্রখর গাম্ভীর্যের জন্য কাছে এগোতো না কেউ। সবারই ধারণা ছিল তিনি ভীষণ রাশভারী প্রকৃতির লোক। আমরাও অবকাশ পেতাম না কথা বলার। বাংলো ধরনের বাড়ি উপরে শনের চাল। বেড়া আধেক ইট আর আধেক বাঁশের। কিন্তু ভেতরে সাহিত্য পাঠকের কাছে আশ্চর্য এক জগৎ। বই বই আর বই। অসংখ্য পত্রিকা। সবই সযত্নে গুছিয়ে রাখা-দেখে মনে হয় বার বার পড়া। একধারে একটা ছোটো টেবিল। হয়তো তার লেখার। অন্দরে ছিলেন তার স্ত্রী এবং বালিকা কন্যা মঞ্জু দাশ। তারাও কবিরই মতো স্বল্পভাষী নির্জনতাপ্রিয়। সেইকালে মঞ্জু দাশের বোধ হয় বয়স দশ কী বারো। ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন তার বাড়িতে না গেলে ‘জীবনানন্দ বাবু অসামাজিক মানুষ’ এ ধারণা করেই চিরদিন দূরে দূরে থেকে যেতাম। সে ধারণা অচিরেই ভেঙে গেল। অমন রাশভারী চেহারার ভেতরে একটি সহজ সরল শিশুর মন খুঁজে পেয়ে আমরা চমৎকৃত হয়ে গেলুম। আমরা তখন লেখার চেষ্টা করছি। কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-কতো কী! আর মুখে ‘প্রগতি সাহিত্যে’র খই ফুটছে। এ সময় কলেজে একদিন তার সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় এক প্রগতিশীল ছাত্র-‘কবি’ হঠাৎ কথার মাঝখানেই তাকে প্রশ্ন করলেন : আপনি জনগণের কবিতা লেখেন না কেন? তার সাহস দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। জীবনানন্দ বাবু এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কয়েকবার তার এবং আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আস্তে প্রশ্ন করলেন, তুমি এ প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের মধ্যে আছো বুঝি? সে বলল : হ্যাঁ। অবশ্যই আমরা এ সমাজব্যবস্থাকে বদলাতে চাই-কায়েম করতে চাই শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। সেখানে কবি ও সাহিত্যিকরাও আমাদের সঙ্গে আসবেন তাদের বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি পরিত্যাগ করে-মার্ক্সবাদ যে নতুন পথ দেখিয়েছে-কথার মাঝখানেই জীবনানন্দ বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন : তুমি কার্ল মার্ক্স পড়েছো? ডাস ক্যাপিটাল? ছাত্র-‘কবি’টি থতমত খেয়ে বললেন : না। জীবনানন্দ বাবু একটুকাল তার দিকে যে তাকিয়ে থেকে হাসি গোপনে বহু চেষ্টা করলেও অকস্মাৎ উচ্চহাস্যে ফেঠে পড়লেন। হঠাৎ সে হাসি। এমন আচম্বিতে বেরিয়ে আসা-সে অবাক হয়ে দেখতে হয় তাকে। ছাত্রটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পালিয়ে বাঁচল। জীবনানন্দের এ হাসিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবেগকে চেপে রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। ভালোলাগার আবেগকেও অসংযত জীবনযাপন তো দূরের কথা-রচনাতেও ছিলেন সংযমী। হাসির আবেগকেও লুকিয়ে রাখতে চাইতেন তিনি। অনেক সময়, দেখা গেছে, যে হাসির প্রসঙ্গ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, সেইকাল অকস্মাৎ বাঁধ ভাঙার মতো করে বেরিয়ে পড়েছে তার হাসি। তবু এমন হাসতে তাকে তার বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ কখনো দেখেনি।...’ কবি জীবনানন্দ দাশের ছোটভাই অশোকানন্দ দাশের স্মৃতিচারণা থেকে উদ্ধৃতি-‘‘ছোটবেলা থেকেই আমাদের রক্তে-বিশেষ করে দাদার-হাঁটার নেশা ছিল। স্মরণ-প্রান্তের প্রায় শেষ সীমানায় গিয়ে মনে হচ্ছে, পঞ্চাশ বছর আগে খুব ছোটবেলায় নেপালে নয়-নেপালের কাছে সুপোলে গিয়েছিলাম। রোজই সকালে ও সন্ধ্যার প্রাক্কালে সেখানকার জনবিরল উদার প্রান্তরে আমরা হেঁটেছি। মাঠে হাঁটতে-হাঁটতে, আকাশের বুকে মেঘ পাল তুলে সাঁতার কেটে যাচ্ছে দেখে, দাদা বলতেন, ‘জানিস, বড় হ’য়ে আমি এমন নৌকা তৈরি করব, যাতে করে তুই ঐ মেঘের মতন আকাশে বেড়াতে পারবি।’ মনপবনের নৌকার যারা মাঝি, তারা বলতে পারবেন সে-রকম নৌকা তৈরি হয়েছে কি-না। প্রায় ছোটবেলা থেকেই বরিশালের উপকণ্ঠে শ্মশানভূমির পাশ দিয়ে আমরা দু-জনে হেঁটেছি, অবাক হয়ে কখনো-বা লাশকাটা ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। কখনো আরও দূরের পাল্লা, শহর ছাড়িয়ে গ্রামের পথে। বর্ষাকালে নদীর তীরে কত সন্ধ্যায় হেঁটেছি, নদী যখন স্ফীত হয়ে পথকে ছুঁয়ে দিচ্ছে-অথবা শীতকালে নদীর রেখা যখন বহুদূরে সরে গেছে, নদীর মধ্যে-ধান-খেতের মধ্যে নেমে গেছি, যেসব ধান-খেত রাতের নীরব মুহূর্তে অন্ধকারে স্নান করে শীর্ণা নদীর সঙ্গে কথা বলে। নদীর ওপারে দেখেছি সবুজ অন্ধকার। গিরিডিতে উশ্রী নদী পার হয়ে বালুর তটে, আমলকী বনে বহুদিন হেঁটেছি। কখনো হেঁটেছি এপারে ক্রিশ্চান হিলের দিকে। কলকাতা ময়দানে, পার্কে, অলিতে-গলিতে ঊষাকালে অথবা গভীর রাতে বহুদিন হেঁটেছি। পুণা শহরে হেঁটে গেছি পার্বতী মন্দিরের চূড়ায়, যারবেদায় পর্ণকুটিরের পাশ দিয়ে, মূলা-মুথা নদীর সঙ্গমে, কাঞ্চিতে, লোনা ডোলার পথে। হেঁটেছি, বোম্বাই শহরের পথে-ঘাটে, মালাবার হিলে, ওয়ালীর সমুদ্রের পাশে, ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস থেকে বান্দ্রায়, বান্দ্রা থেকে সান্তাক্রুজে, সান্তাক্রুজ থেকে জুহুর সমুদ্রতটে। হেঁটেছি দিল্লির সড়কে সড়কে যেখানকার ধুলোর সঙ্গে মিশে গেছে অনেক বিলুপ্ত নগরীর ধুলো ও বালি; হেঁটেছি শাহানশা বাদশাদের কবরের পাশে-পাশে-মসজিদ ও মিনারের কাছে, লোদী গার্ডেনে, ইয়ুসুফ সরাইতে মেহরৌলীর পথে। জীবনানন্দ শেষ ঘুমের আগে পর্যন্ত রোজই হেঁটেছেন এক নেশায় আক্রান্ত হয়ে, কোনো সাথীর সঙ্গে অথবা সাথীহীন হয়েও। শুধুই কি হেঁটেছেন শহরের অলিতে-গলিতে, পার্কে-ময়দানে, মনপবনের নৌকা চড়ে অতীত যুগের কত শহর, কত গ্রাম, কত অট্টালিকা, আধুনিক জীবনের কত পটভূমিতে, কত সাগর-সৈকতে, মানুষ-মনের কত অলিতে-গলিতে হানা দিয়ে এসেছেন। বরিশালে দাদার বাল্য, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো বড়ই উজ্জ্বল ছিল। এমন পিতামাতা, এমন পরিবেশ। তখনকার দিনে বরিশালের জীবনে সমাজের বিভিন্ন স্তর ছিল। আমাদের অবস্থা সচ্ছল ছিল না, কিন্তু পিতা বরিশালের সমাজে সম্মানের উচ্চ আসনে ছিলেন। মূল্যচেতনা বিশুদ্ধ ছিল। মাতা তার প্রতিভাবান পুত্রের সম্বন্ধে অগাধ আশা পোষণ করতেন। সেই আশা, সেই বিশ্বাস দাদার প্রথম যৌবনে প্রেরণা জুগিয়েছে, তার নিজেরও দৃঢ় বিশ্বাস লাভ করতে সাহায্য করেছে। দাদা ধর্মের অনুষ্ঠান পরবর্তী জীবনে পছন্দ করতেন না, কিন্তু ব্রাহ্ম ধর্মের সারবস্তুতে বিশ্বাসবান ছিলেন। যে-ধর্মের হাওয়াতে দাদা বড় হয়ে উঠেছিলেন, উপনিষদের সে-ধর্মের নির্দেশ হচ্ছে, অন্ধকার থেকে আলোকে যাওয়ার সাধনা। মানুষের জীবনে পতন আছে, অন্ধকার আছে, কিন্তু তা চিরন্তন নয়, উদ্যম ও সাধনাযোগে পতনকে পশ্চাতে ফেলে ধ্রুব সত্যে, আলোকে পৌঁছতে হবে। বিশ্বচরাচরের সর্বত্র, প্রকৃতির সব উপকরণে বিশ্ববিধাতার মহিমা ও ঐশ্বর্য প্রতিফলিত হয়েছে, উপনিষদুক্ত এ ধর্মের বাণী হচ্ছে এই। বাল্যে, কৈশোরে অথবা প্রথম যৌবনে তার শিক্ষা-দীক্ষা, তার পরিবেশ, এমন-কি তার ধর্ম তাকে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল জীবনের ছবি দেখিয়েছে।...’’ এবার জানব কবিজায়া লাবণ্য দাশ কী লিখেছেন কবি স্বামী সম্পর্কে। লাবণ্য দাশ লিখেছেন, ‘‘গ্রীষ্মের এক দুপুরে আমি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলাম। নিদ্রা-দেবীর, বহু আরাধনা করে সবে ঘুমটা একটু এসেছে, এমন সময় কানে গেল, ‘মিলু (কবির ডাক নাম) আমাকে একটা খাম দিবি’? কথাটা বার দুই শুনলাম। বুঝলাম, মা কবির কাছে খাম চাইছেন। কিন্তু যাকে বলা, তার কানে আদৌ ঢুকেছে বলে মনে হলো না। বেশ কিছুক্ষণ পরে কবির গলা শোনা গেল : ‘আমাকে অনেক চিঠি লিখতে হবে। আমি পয়সা দিচ্ছি। তোমার যে কটা দরকার কাউকে দিয়ে আনিয়ে নাও। আর কাল হলে যদি চলে, তবে আমি নিজেই এনে দিতে পারি।’ কবির কথা শুনে মা চুপ করেই রইলেন। কিন্তু আমার আর সহ্য হলো না। আমি কোনো কথা না বলে সোজা কবির ঘরে ঢুকে তার টেবিল থেকে তিনটে খাম তুলে নিলাম। কবি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘কর কি? কর কি? সবকটা খামই আমার লাগবে।’ আমি খাম নিয়ে চলে আসতে আসতে বললাম, ‘পোস্টঅফিস সামনেই। সোজা গিয়ে নিয়ে এস।’ কিন্তু মজা হলো এই-মা খাম তো নিলেনই না, উলটে আমাকে বললেন, ‘তুমি আবার ওর দরকারি খাম আনতে গেলে কেন? আমি তো আর নিজের জন্য চাইছি না। যাকে দেব, তাকে কাল দিলেও চলবে।’ আমি তখন রাগ করে খাম তিনটে কবির টেবিলেই ফেলে দিয়ে এলাম, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বললেন, ‘এতদিনেও তুমি মাকে চিনলে না? আমি তো শোনা মাত্রই বুঝেছি, তিনি নিজের জন্য চাইছেন না।’ কবি অবিশ্যি তার পরদিনই মাকে খাম এনে দিলেন। এইরকম বাবা মায়ের সন্তান হয়ে পৃথিবীতে আসতে পারায় কবি চিরদিন নিজেকে সৌভাগ্যবান বলেই মনে করেছেন। ঝড়, ঝঞ্ঝা, দুর‌্যাগের ঘনঘটা কালো আবরণে বহুবার তার জীবনকে ঢেকে ফেলেছে-ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পথ হারিয়ে দিশেহারা তাকে হতে হয়েছে বৈকি। কিন্তু তার মা বাবার আশীর্বাদই আলো হয়ে তাকে পথের সন্ধান দিয়েছে। শত বাধা অতিক্রম করে সোজা হয়ে হেঁটে যাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে। কবির কথা বলতে গিয়ে আজ মনে পড়ে কবির পরলোকগতা জেঠিমার কথা। মনে পড়ে তার ছোট পিসিমার কথা। কাকা ব্রহ্মানন্দ দাশের সঙ্গে কবির সম্পর্কের কথা। আমাদের জেঠিমা অতি অল্প বয়সে সর্বানন্দ পরিবারের বউ হয়ে এসেছিলেন। সেকালের মেয়ে তিনি। বিয়ের আগে লেখাপড়ার কোনো সুযোগই তার হয়নি। কিন্তু পরে নিজের চেষ্টায় বাংলা ছেড়ে ইংরেজিও তিনি ভালোই শিখেছিলেন। কারণ আমি বরিশালে গিয়ে তাকে বহু ইংরেজি গল্পের বই পড়তে দেখেছি। এই জেঠিমা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার পরে কবি আমাকে বলেছেন, ‘স্বামী এবং ছোট মেয়েটিকে (তিনটি মেয়ের মধ্যে) হারানোর পর তিনি যেন দ্বিধাহীনভাবেই নিজেকে সবার মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। যেখানে অসুস্থ অসহায় মানুষ-সেখানেই আমাদের মমতাময়ী জেঠিমা। রাত দুপুরেও যদি তিনি শুনতে পেতেন যে, পাড়ার কেউ খুবই বিপদে পড়েছে, অথবা অসুস্থ হয়ে কষ্ট পাচ্ছে; তাকে দেখার কেউ-ই নেই, তিনি তখুনি ছুটে চলে গিয়েছেন তার কাছে। জাতের সংস্কার কোনোদিনই তাকে এসব অসহায় দুর্বল মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। এ সেবাপরায়ণা মহিমময়ী নারীর সান্নিধ্যে

যিনিই এসেছেন, তিনিই নিজেকে ধন্য বলে মনে করেছেন-সান্ত্বনা পেয়েছেন মৃত্যুপথযাত্রী। মাতৃসমা জেঠিমা সম্বন্ধে কথাগুলো বলানোর সময় কবির মনের দরদ এবং গভীর শ্রদ্ধা

যেন প্রতিটি অক্ষরের ভেতর দিয়েই ঝরে পড়ছিল। কবির কাকা ব্রহ্মানন্দ দাশের কোনো ছেলে না থাকায় তিনি তার দাদার এ

প্রথম সন্তানটিকে মনে মনে হয়তো গভীরভাবেই স্নেহ করতেন।

তাই শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে কবির অন্তিম শয্যাপাশে দেখেছি তার অস্থির মনের ব্যাকুলতা। মুখে তিনি কিছুই প্রকাশ করেননি।

শুধু দুটি হাত পেছনে মুষ্টিবদ্ধ করে অনবরত পায়চারি করেছেন। কি এক অব্যক্ত বেদনাভরে মাথা তার নুয়ে নুয়ে পড়েছে। আমি নির্বাক হয়ে সবই লক্ষ্য করেছি। তার তখনকার অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছে-তিনি শুধু যে কবির কথাই ভাবছেন, তা নয়, তার দাদা এবং মেজো বৌঠানের (কবির বাবা, মা) কথা হয়তো স্মরণে আসছে তার। কবির অবর্তমানে আমাদের কী হবে-এ কথাও হয়তো তিনি ভাবছেন। এই কাকা সম্বন্ধে কবিকে বহুবার বলতে শুনেছি, ‘আমাদের কাকাকে সহজে বোঝা যাবে না। মুখে তার রুক্ষ ভাষা, কিন্তু অন্তরে তার ফল্গুধারা। তার কর্তব্যবোধ অসীম-পরিবারে তার দানেরও সীমা নেই। কিন্তু সবই নীরবে। কোনো ধরনের অভিব্যক্তিই তার নেই।’’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম