Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

রুমি ও হুইটম্যানের কাব্যিক যোগসূত্র

Icon

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যুক্তরাষ্ট্রে বেস্টসেলিং কবিদের অন্যতম আটশ বছর আগে জন্মগ্রহণকারী প্রাচ্যের সুফি কবি জালালুদ্দিন রুমি। তার কবিতা আমেরিকার সর্বত্র পঠিত হয় এবং মসনবিসহ তার প্রায় সব কবিতার ইংরেজি অনুবাদ বুকস্টোরগুলোতে সহজে পাওয়া যায়। নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক সংখ্যার বুক সেকশনে রুমিকে ষাটের দশকের পর আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আমেরিকা ও মুসলিম বিশ্বের অবস্থান বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, পোশাক, খাওয়া-দাওয়া কোনো কিছুর মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। আমেরিকানরা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, যা মুসলিম বিশ্বে বিবেচনা করা হয় ব্যভিচার হিসাবে। মুসলিম বিশ্বের ধর্মনিষ্ঠা ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের প্রতিপালনকে আমেরিকানরা দেখে গোঁড়া ধর্মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টান্ত হিসাবে। এ দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও সব পর্যায়ের আমেরিকান রুমির কবিতার পাঠক। মুসলিম বিশ্ব এবং আমেরিকা যদি দৃশ্যত একে অন্যকে এতটাই খাপছাড়া ও দুর্বোধ্য বলে মনে করে, তাহলে কীভাবে প্রাচ্যের মধ্যযুগীয় আলখেল্লাধারী একজন সুফি কবির পক্ষে আমেরিকানদের হৃদয়ের গভীরে এতটা নিবিড় আস্তানা তৈরি করা সম্ভব হলো?

রুমির কাজের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সব মানুষের মধ্যে, সব বস্তু ও অস্তিত্বের মধ্যে পবিত্রতা দেখতে পাওয়া এবং সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িত করার আকাঙ্ক্ষা। তিনি তার কবিতায় বলেছেন-

‘সাক্ষাতের যে কোনো সুযোগ, তা যদি পথেও হয়,

সেখানে আলো থাকে, ঐশ্বর্য উঠতে থাকে ঊর্ধ্বলোকে।’

এই ঔজ্জ্বল্য তিনি তার নিজের মাঝেই দেখেছেন। তিনি বলেন :

‘আমি অস্তিত্বের সকল নিয়ম দেখছি,

ঘূর্ণায়মান সৌরমণ্ডল, বিবর্তনের অভিজ্ঞান,

ওপরে উঠে যাওয়া এবং পতিত হওয়া,

এটা কী এবং কী নয়?’

এই প্রশ্নের উত্তর তিনি পান সুর ও সংগীতের মাঝে :

‘আমি চাই নল দিয়ে তৈরি বাঁশি,

একটি বীণা, খঞ্জনি ও ঢোল,

সুর ও সংগীতই আমার জিকির।’ (আল্লাহকে স্মরণ করার উপায়)

সম্ভবত রুমির সবচেয়ে প্রবল সক্ষমতা ছিল বেহেশত ও পৃথিবীকে তার সত্তার মাঝে যুক্ত করা এবং দুটির পেছনেই মূল উৎসকে দেখা। তিনি বলেছেন :

‘প্রেমিকের সত্তায় আছি বলে আমি দুটিই দেখেছি,

একটি পৃথিবী এবং অপরটিকে ডেকে জানতে হবে।’

রুমির সব কাজের মূল ও কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইসলাম। আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা ও নবি মুহাম্মাদের প্রশংসা করাই তার কবিতার তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপাদ্য। এটি ছিল রুমির ইসলামি দৃষ্টি, যা আল্লাহর সর্বজনীনতাকে উপলব্ধি করেছে এবং তার মুসলিম হৃদয় এ সত্তায় লীন হতে চেয়েছে।

তার মুসলিম সর্বজনীনতার ভিত্তি কুরআনের মধ্যে নিহিত, যেখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তার অনেক নবিকে এমন স্থানে পাঠিয়েছেন, যেখানে তারা ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষাকে ‘মণিমুক্তাপূর্ণ’ বলে স্বীকার করেছেন। রুমি বলেছেন :

‘হিন্দুরা তাদের ভাষায় ঈশ্বরের প্রশংসা করে;

সিন্ধিরা সিন্ধি ভাষায় ঈশ্বরের প্রশংসা করে।’

রুমির কবিতায় এমন আর কী আছে, যা আমেরিকানদের এভাবে আকৃষ্ট করেছে? অনেকে বলেন, এটি বাইরের কোনো কিছুর প্রতি আমাদের মুগ্ধতা অথবা আধুনিক সময়ের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে আমাদের সমসাময়িক অবস্থার সামঞ্জস্যতার কারণে। কিন্তু আমার মতো কেউ কেউ মনে করেন আমেরিকায় রুমির জনপ্রিয়তার কারণ হয়তো আরও গভীর। রুমি আমেরিকার কাব্য ঐতিহ্যের ধারায় আঘাত করেছেন। তিনি আমেরিকার নিজস্ব ঐতিহ্যের একজন কবির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যার ওপর রুমির কবিতার ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। তিনি ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)। রুমির মতো ওয়াল্ট হুইটম্যানও মানুষের মাঝে চমৎকারিত্ব দেখেছেন। হুইটম্যান তার কবিতায় বলেছেন :

‘আমাদের সবাই অনিবার্য, আমাদের প্রত্যেকেই সীমাহীন,

এখানে আমরা প্রত্যেকে চিরন্তন।’

আরেক কবিতায় তিনি বলেছেন :

‘যেসব নগরে আলো বা উষ্ণতা আছে, আমি সেখানে যাব,

হ্যাঁ, স্বয়ং আমি যাব,

যে দ্বীপগুলোতে পাখিরা উড়ে যায়, সেখানে যেতে আমিও ডানা মেলব,

হ্যাঁ, স্বয়ং আমি যাব।’

জালালুদ্দিন রুমির মতো ওয়াল্ট হুইটম্যান বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ভালোবাসতেন। তিনি লিখেছেন :

‘মসজিদের ওপর থেকে আমি আরব মুয়াজ্জিনের আজান শুনেছি,

গির্জার বেদিতে আমি খ্রিষ্টান যাজককে কথা বলতে শুনেছি,

হিব্রুর কণ্ঠে শুনেছি ইতিহাসের পাঠ ও শ্লোক...।

আমি হিন্দু পণ্ডিতের কণ্ঠ শুনেছি, যিনি তার ছাত্রদের পাঠ দেন।’

জালালুদ্দিন মুসলিম ঐতিহ্য থেকে তার লেখার খোরাক পেয়েছেন; ওয়াল্ট হুইটম্যানের ভিত্তি ছিল আমেরিকান ঐতিহ্য। তারা দুজন কি একে অন্যের লেখা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। রুমির জন্ম যেহেতু হুইটম্যানের জšে§র বহু শত বছর আগে হয়েছিল, সেজন্য হুইটম্যানের কোনো কিছু সম্পর্কে রুমির জানার প্রশ্ন আসে না। তবে হুইটম্যান কোনো সূত্রে রুমির কবিতার সংস্পর্শে এসে থাকতে পারেন। এ সম্পর্কে কারও স্পষ্ট ধারণা নেই। রুমি ও হুইটম্যানের কাব্যভাবনায় যে সামঞ্জস্য পাওয়া যায় তা বহু বিষয়ে মানুষের ধ্যানধারণা ও চিন্তাভাবনার মধ্যে অভিন্নতা থাকার কারণে। উভয়ের কবিতায় অনেক ক্ষেত্রে ভাবনা ও প্রকাশের যে মিল, তা প্রমাণ করে যে, ইসলাম ও আমেরিকার মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান, তা অনিবার্যভাবে বড় ধরনের কোনো ব্যবধান বা বৈসাদৃশ্য নয়। কারণ দুই সভ্যতার চেতনার মধ্যে বসবাস ও ভিন্ন বিশ্বাসে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও দুই কবি বিস্ময়কর সম্পর্ক ও নৈকট্য প্রদর্শন করেছেন। সভ্যতার দ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে কিছু মানুষের সৃষ্টি এবং এ দ্বন্দ্বে বিশ্বাস করে না তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

রুমি এবং হুইটম্যান উভয়েই মানুষের দেহ ও আত্মার প্রশংসা করেছেন। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক; মন্দ ও ভালো। সেজন্য পাঠকরা তাদের কবিতায় বিভিন্ন ধর্ম, ধর্মহীন ও দার্শনিক ধ্যানধারণা উপস্থিতি দেখতে পান... ইসলাম, খ্রিষ্টাব্দ, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধ, ইহুদিবাদসহ বহু বিশ্বাসের উপাদান। আধ্যাত্মিকতা এ ক্ষেত্রেই রুমি এবং হুইটম্যানের মধ্যে একটি অদ্ভুত মিল। ওয়াল্ট হুইটম্যান তার মৃত্যুর এক বছর আগে ‘এ পারসিয়ান লেসন’ নামে একটি কবিতা প্রকাশ করেন। এর মধ্যে দেখা যায়, ‘পাকা দাড়িবিশিষ্ট এক সুফি’ পারস্যের এক গোলাপ বাগানে তার ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলছেন। হুইটম্যান সুফিকে তার নিজের কণ্ঠ দিয়েছেন :

‘অবশেষে আমার সন্তানেরা প্রতিটি শব্দকে এবং অবশিষ্ট প্রতিটি অংশকে মোড়কবদ্ধ করবে,

আল্লাহ সবকিছু, সবকিছু, সবকিছু,

প্রতিটি জীবন ও বস্তুতে থাকে অন্তর্নিহিত,

হয়তো অনেক এবং আরো অধিক অপসারিত হয়- তবুও আল্লাহ, আল্লাহ,

আল্লাহ সেখানে আছেন।

বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বিচরণকারী কি দূরে? কী কারণ যে এমন অদ্ভুতভাবে আড়াল হয়ে আছে?

তুমি কি সমগ্র বিশ্বের অস্থির সমুদ্রের গর্জন তোমার নিচেই শুনতে পাচ্ছো?

তুমি কি এ অসন্তোষ সম্পর্কে জান? প্রতিটি জীবনের আহ্বান ও প্রেরণা,

কিছু জিনিস কখনো কি স্থির থাকে না

কখনো কি পুরোপুরি হারায় না?

প্রতিটি বীজের কী অদৃশ্য কোনো প্রয়োজন থাকে?

প্রতিটি অণুর মধ্যেই থাকে একটি মূল তাগিদ,

প্রায়ই অসচেতন, মন্দ এবং অধঃপতিত।

যত দূরেই হোক ফিরে আসে তার উৎস ও মূলে,

ব্যতিক্রমহীনভাবে বিদ্যমান থাকে অন্তর্নিহিত অভিন্ন বিষয় ও লক্ষ্যে।’

হুইটম্যানের পাকা দাড়িবিশিষ্ট সুফির কথাগুলোর সঙ্গে রুমির কথার পুরোপুরি মিল রয়েছে, ‘উৎসের দিকে ফিরে আসার জন্য সকল বস্তুর একটি তাগিদ থাকে।’ হুইটম্যান এবং রুমি প্রায়ই অভিন্ন কণ্ঠে কথা বলেছেন। সেজন্য রুমিকে আমেরিকান কবিতার অবাধ স্বাধীনতার ধারায় উপস্থাপন করা যৌক্তিক, যা আমেরিকান পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য। কারণ এ ধরনের কবিতার রয়েছে আত্মগ্রাহী ও আত্মানুসন্ধানী আবেদন। কিন্তু দুজনের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। হুইটম্যান প্রায়ই সৈকতে পদচারণাকারী পর্যবেক্ষক, আর রুমি প্রায়ই বিপদের মধ্যে ঝুঁকি গ্রহণের কথা বলেছেন :

‘প্রেম আসে একটি ছুরি নিয়ে,

তুমি সাগরের তীরে পায়চারি করছো,

শুকনো রাখতে তুলে ধরেছ আলখেল্লার প্রান্ত।

তোমাকে গভীরে ডুব দিতে হবে নগ্ন হয়ে,

হাজার গুণ গভীরে, যেখানে প্রেম বহমান।

রুমির মাঝে এই প্রেমিক স্বয়ং পরিচালনাকারী, যিনি কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত বহন করেন সর্বজনীন শক্তি। এই কবিতায় ‘তুমি’ সেই কেন্দ্র। যে কেউ তোমার কণ্ঠে যে কোনো কিছু উচ্চারিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, কেউ এই কবিতাই উচ্চারণ করছে। সর্বনামগুলোই হচ্ছে বিরাট রহস্য। কেউ দরজায় টোকা দেয়, কেউ উত্তর দেয়। দুজন হয়ে যায় একে অন্যের এবং এরপর চার হাজারে। হুইটম্যানের ক্ষেত্রেও এটি সমভাবে সত্য। তার সবচেয়ে পরিচিতিমূলক কবিতা ‘আমার সংগীত’ এর শুরুটাও ‘আমি’ দিয়ে :

‘আমি নিজেকেই উদ্যাপন করি এবং নিজেকে তুলে ধরি সংগীতে,

এবং আমি কী ধারণা করি তা তুমি ধারণা করতে পারো।’

এই কবিতা শেষ হয়েছে ‘তুমি’ দিয়ে :

‘এক স্থানে আমাকে হারিয়ে আরেকজনের সন্ধান করছো,

আমি তো কোনো স্থানে তোমারই প্রতীক্ষা করছি।’

এ জটিল, সারা জীবনের প্রক্রিয়া, আত্মার নির্যাসের মিশ্রণই রুমির কবিতার অন্তর্ভুক্তিপ্রবণ অভিজ্ঞতা। হ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম