Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

কবিতার নিপুণ শিল্পী ফিলিস্তিনের মোসাব আবু তোহা

Icon

ভূমিকা ও অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তরুণ ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহার প্রথম কবিতার বই ‘তুমি আমার কানে যা লুকোনো দেখতে পাবে’ ২০২২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর তার কবি পরিচিতি আরব জগৎ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তার কাব্যগ্রন্থ ‘প্যালেস্টাইন বুক অ্যাওয়ার্ড’ ও ‘আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে এবং চলতি বছর (২০২৫) গ্রন্থটি নরওয়েজিয়ান অথরস ইউনিয়নের ‘ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে। এটি ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড ও ‘ওয়ালকোট পোয়েট্রি প্রাইজ’-এর জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছিল।

আবু তোহা ১৯৯৩ সালে ইসরাইলি হামলায় বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার ‘আল-শাতি’ শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ গাজা থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। এর আগে তিনি ২০১৭ সালে বেইত লাহিয়া সিটিতে অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ লাইব্রেরি নামে গাজা উপত্যকায় প্রথম ইংরেজি ভাষার গ্রন্থের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। ২০১৯ সালে এ লাইব্রেরি দ্বিতীয় শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় গাজা সিটিতে। তিনি গাজায় জাতিসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি পরিচালিত স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে চাকরি করেছেন ২০১৬ থেকে ২০১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ২০১৯ সালের অক্টোবরে তিনি ‘স্কলার-অ্যাট-রিস্ক’ ফেলোশিপে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং স্কলার হিসাবে যোগ দেন। কবিতার ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি নেন সিরাক্যুজ ইউনিভার্সিটি থেকে এবং গাজায় ফিরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেখানে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবেও কাজ করেন। আবু তোহা ‘অ্যারোস্মিথ প্রেস’-এর একজন কলামিস্ট এবং ‘দ্য নেশন,’ ‘লিটারারি হাব’, ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস,’ ও ‘দ্য নিউইয়র্কার’ এ লেখেন। বর্তমানে তিনি কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে একজন ইনস্ট্রাকটর ও আবাসিক লেখক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আবু তোহার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতো ‘পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন’-এর ওয়েবসাইটে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী এবং দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতায় তার কবিতা প্রকাশিত হয়ে আসছে। নিউইয়র্ক টাইমস তার কবিতার ওপর এক আলোচনা উল্লেখ করেছে, ‘কাব্যজগতে ব্যতিক্রমী প্রতিভাধর আবু তোহা’র আবির্ভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতার যে বৈপরীত্য তা দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল’-এর পক্ষে জ্যাকব জেমস লিখেছেন, ‘আবু তোহা’র কবিতার অনুরণন পাঠককে দৃঢ় হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করে। তার চারপাশের আপন মানুষগুলোর যে দুর্দশা ও বৃহত্তর বিপর্যয় ঘটে চলেছে, তা তিনি শব্দের সমাহারে ফুটিয়ে তোলেন নিপুণ চিত্র শিল্পীর মতো।’

২০২৩ সালের অক্টোবরে আবু তোহা, তার স্ত্রী ও সন্তানদের বেইত লাহিয়ার বাড়ি থেকে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। কারণ ইসরাইল সতর্কতা জারি করেছিল, বেইত লাহিয়ায় বোমাবর্ষণ করা হবে। ৬ নভেম্বর দ্য নিউইয়র্কার-এর এক নিবন্ধে তোহা উল্লেখ করেছিলেন, তিনি সাইকেল চালিয়ে তার বাড়ি যাচ্ছিলেন কিছু বই উদ্ধার করে আনার জন্য। কিন্তু তার বাড়িসহ আশপাশের এলাকা বোমায় বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল। ইসরাইল পরে জাবালিয়ায় বোমাবর্ষণ করে, তারা যেখানে ছিলেন সেখান থেকে মাত্র ৭০ মিটার দূরে। আবু তোহার বিশিষ্ট কবি বন্ধু রেফাত আলারীর ২০২৩-এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হন। আমেরিকান ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ও লেখক অ্যামি গুডম্যান যখন তোহা’র কাছে তার বন্ধু রেফাতের মৃত্যু সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চান; তিনি বলেন, ‘তার মৃত্যু অনন্য নয়। রেফাত আলারীর এর মরদেহ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তার সম্পর্কে শুধু এটুকু বলতে পারি, তিনি সবসময় আমাদের সাহিত্যকর্ম শোনার অপেক্ষায় থাকতেন। তিনি শেক্সপিয়ারের সনেট এবং জন ডানের কবিতা পড়তে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে তিনি জন ডানের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। আমি রেফাতকে স্মরণ করতে চাই, যিনি আমার সঙ্গে স্ট্রবেরির মাঠে গিয়ে স্ট্রবেরি তুলতে ভালোবাসতেন। তিনি এমন একজন ছিলেন, যিনি মরতে চাননি।

ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত কানাডীয় আইনজীবী ডায়ানা বুত্তু’র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আবু তোহার। তিনি জানান, আবু তোহার তিন সন্তানের মধ্যে তিন বছর বয়সি পুত্র আমেরিকান সিটিজেন। তাকে গাজা থেকে উদ্ধারের জন্য মিশরে আমেরিকান দূতাবাসে আবেদন করা হয়েছিল দুই সপ্তাহ আগে এবং এ সংক্রান্ত ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় মিশরসংলগ্ন রাফাহ সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়া নিরাপদ বিবেচিত হলে তিনি পরিবার ও অন্যদের সঙ্গে ১৯ নভেম্বর রওয়ানা হন। মাঝপথে ইসরাইলি বাহিনী আবু তোহাকেসহ প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনিকে আটক করে। বিষয়টি প্রচার মাধ্যমে আসার পর আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট সিএনএনকে জানায়, আবু তোহাকে আটক করা সম্পর্কে তারা কিছু জানে না। তবে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ কবি আবু তোহার ব্যাপারে সতর্ক হয় এবং দুদিন পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ানের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ইসরাইলিরা তাকে মারধর করেছে। পেন আমেরিকা এক বিবৃতিতে বলে, ‘কবি ও লেখকদের অবশ্যই ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে সত্য বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে।’

মোসাব আবু তোহার কবিতা

তুমি আমার কানে যা লুকোনো দেখতে পাবে

তুমি যখন আমার কান খুলবে,

তখন আলতোভাবে কান স্পর্শ করো,

ভেতরে কোথাও অনুরণন আছে আমার মায়ের কণ্ঠের,

তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি আমাকে সাহায্য করে ভারসাম্য ফেরাতে

আমার একাগ্রতার সময় যখন আমি মাথা ঘোরা অনুভব করি,

তখন তুমি তোমার কানে হয়তো আরবি গানের সুর শুনবে,

আমি তখন মনে মনে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করি,

অথবা বাড়ির আঙিনায় পাখিদের জন্য গাওয়া আমার একটি গান।

ক্ষতস্থান সেলাইয়ের সময় এসব আমার কানে রেখে দিতে ভুলো না।

তুমি শেলফে যেভাবে বই রাখো ঠিক সেভাবে সব গুছিয়ে রেখে দাও।

ড্রোনের টানা গুঞ্জন,

এফ-১৬ এর গর্জন,

বাড়িঘর, মাঠ এবং দেহের ওপর

পতিত বোমার প্রচণ্ড, তীক্ষ্ম আওয়াজ,

উড়ে যাওয়া রকেটের শোঁ শোঁ শব্দ থেকে

আমার কানের ক্ষুদ্র-পথ মুক্তি লাভ করুক।

ক্ষতস্থানে ছিটিয়ে দাও তোমার হাসির সুবাস।

আমাকে জাগাতে আমার শিরায় ভরে দাও জীবনের গান।

ঢাকে মৃদু আঘাত করো, যাতে আমার মনও তোমার মনের সাথে নাচে,

আমার ডাক্তার, আমার দিন ও রাত।

আমার দাদা এবং আমার বাড়ি

ফিরে আসার প্রতীক্ষায় আমার দাদা আঙুলে দিন গুনতেন

এরপর গণনা করতে তিনি ব্যবহার করতেন পাথর,

কিন্তু যথেষ্টসংখ্যক পাথর ছিল না,

অতঃপর তিনি মেঘ, পাখি ও মানুষ গুনতেন।

ক্রমে অনুপস্থিতি দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ হয়ে উঠলো,

তার মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ ছত্রিশটি বছর,

আমাদের হিসেবে এখন সত্তর বছরের বেশি।

আমার দাদা তার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন,

তিনি সংখ্যা এবং মানুষের সংখ্যা বিস্মৃত হয়েছিলেন

তিনি বাড়ির কথা ভুলে গিয়েছিলেন।

দাদা, আমি যদি তোমার সঙ্গে থাকতে পারতাম,

তাহলে আমি স্বয়ং তোমাকে বহুসংখ্যক কবিতা

অনেক কবিতা লিখতে শেখাতে পারতাম,

এবং তোমার জন্য আমাদের বাড়ি রং করতাম,

আমি তোমাকে মাটি থেকে সেলাই করিয়ে নিতাম

এমন একটি জামা, যা গাছপালায় সাজানো থাকতো,

এবং তোমার রোপণ করা গাছগুলোর মধ্যে

কমলা থেকে তোমার জন্য সুগন্ধি তৈরি করতাম,

আনন্দের আকাশ ভরা অশ্রু দিয়ে তৈরি করতাম সাবান,

এর চেয়ে খাঁটি আর কোনোকিছুর কথা ভাবতে পারি না।

প্রতিদিন আমি গোরস্থানে যাই,

সেখানে ব্যর্থভাবে খুঁজি তোমার কবর,

ওরা কি নিশ্চিত যে ওরা তোমাকে কবর দিয়েছিল?

নাকি তুমি একটি গাছে রূপান্তরিত হয়েছো?

অথবা কোনো পাখির সাথে উড়ে গেছো অজানায়?

আমি তোমার ছবি একটি মাটির পাত্রে রেখেছি,

প্রতি সোমবার সেই ছবিতে আমি পানি দিই,

এবং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমাকে বলা হয়

ওই দিনগুলোতে তুমি রোজা রাখো।

রমজান মাসে আমি প্রতিদিন পানি দিই,

ত্রিশটি দিন ধরে আমি পানি দিই,

অথবা এর চেয়ে কম বা বেশি দিন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম