Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

ষোলো ঘর

Icon

তাহসান কবির

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাত আটটা বাজতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি। আরও আগে আসার কথা ছিল কিন্তু বিচিত্র আবহাওয়া! ফুরফুরে বাতাসের পর অমন ঝুপ করে বৃষ্টি নামার তো কথা ছিল না। অবশ্য আজকে আবিরের এখানে এভাবে আসারও তো কথা ছিল না। তবু এসেছে। বৃষ্টিটা একটু ধরে এলে রিকশা নিয়ে বাকি পথটুকু। এমন আবহাওয়ায় একদমই বাইরে বেরোতে ইচ্ছা করে না, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বের হয়ো না। তবে শিলার ডাক সে কবে ফেলতে পেরেছে?

শিলালিপি চৌধুরী। বাসার নম্বর মেলানোর আগেই বাসাটাকে চিনে ফেলল, শিলা যে বিশদ বর্ণনা দিয়েছে বাসার, তাতে গেটের পাশের গন্ধরাজ গাছটার সঙ্গে রাস্তার ওপাশের বিল্ডিংটার বিশাল গোঁফওয়ালা দারোয়ান সবই হুবহু মিলে যাচ্ছে! এরপর যদি এটা সেই বাসা না-ও হয়, আবির ঢুকবে বলে মনস্থির করেই ফেলেছে। গা-মাথা থেকে পানি ঝেড়ে-মুছে চুলটাকে যথাসম্ভব ঠিকঠাক করে নিল সে। নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের সংকোচটা তার আজীবনের। বন্ধুদের আড্ডার মধ্যমণি আর ডার্ক কমেডির বিপুল ভাঁড়ার হলেও অচেনা মানুষের সঙ্গে প্রথম আলাপে কেমন আড়ষ্ট হয়ে পড়ে! শিলার স্বামীর সঙ্গে এবারই প্রথম দেখা আবিরের।

আবির আসতে চায়নি। কি দরকার মিছেমিছি গিয়ে কষ্ট দেওয়ার, কষ্ট পাওয়ার? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন মাস, এর মধ্যে কতবার যে শিলা ফোন করে আসতে বলেছে তার হিসাব নেই। অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে কিছুদিন পার করলেও ব্যস্ততার অজুহাত দেওয়া যায়নি। আবির যে কেমন ব্যস্ত আর তা কী নিয়ে, সেটা আদৌ ব্যস্ততার কাতারে পড়ে কিনা শিলার চেয়ে আর কে বেশি জানবে? আজ শিলার কণ্ঠও কেমন আকুল লেগেছে! সেই ডাক, পরিচিত, খুব পরিচিত।

‘আমি আবির, আবির মাহমুদ। আপনার সঙ্গে দেখা করে ভালো লাগছে।’ নিজে নিজে কিছুটা ঝালাই করে নেয়, হাসিটা ধরে রাখে। প্রথম দেখায় শরিফ সাহেবের সামনে আড়ষ্ট হতে চায় না। শরিফুল ইসলাম সরকারি কর্মকতা। কিছুদিন চাকরি করেই নতুন সংসার পেতেছেন মিরপুরের এ বাসায়। সরকারি কোয়ার্টার পাওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই থাকবেন। দুজনের সংসারে অতিথি হিসাবে প্রথম আসাটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সামলাতে চায় আবির, শিলাকেও দেখাতে চায় সে বদলে গেছে অনেকটা।

তবে, শরিফ দরজা খুললে আবির তাকে ছোট্ট করে সালাম দেয় এবং হড়বড় করে বলে, ‘আমি শিলার সাথে দেখা করতে এসেছি। ও কি বাসায় আছে?’

শরিফ আন্তরিক হাসি দিয়ে স্বাগত জানায়, ‘আপনিই আবির সাহেব, শিলার বন্ধু, ঠিক? আরে আরও দুজন তো আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে। শিলা বাসায় না থেকে যাবে কই? আসেন, ভেতরে আসেন।’

আবির ঢোকার আগেই শিলা সামনে এসে দাঁড়ায়, চিরচেনা ভঙ্গিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, ‘তুমি আসছ! আমি তো ভাবলাম বৃষ্টির ভয়ে কাথা মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছ। ভেজো নাই তো। এমনি অসুখের শেষ নাই। আজকেই সুস্থ হয়ে আবার জ্বরে পড়লে...’

আবির তাকে থামিয়ে দিয়ে তার চিরচেনা রূপে ফিরতে থাকে যেন, ‘শিলার কাছে বৃষ্টি কোন ছাড়! শিলায় যে কাবু হয় না, বৃষ্টি তো তার জন্য আশীর্বাদ।’

শরিফ মজাটা বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে আবিরকে বসার ঘরে নিয়ে বসায়। শিলা এসে পাশের সোফায় বসে। আবির আবার নীরবতার সংকোচে ডুবতে থাকা সময়টাকে মোকাবিলা করতে বলে, ‘তুমি কি রান্না করছিলা নাকি? (শরিফের দিকে তাকিয়ে হেসে) খাওয়া যায়?’

শিলার রান্নার কথা মনে পড়ে। জবাব না দিয়ে চোখ কটমট করে রান্নাঘরে চলে যায়।

‘সেটা চাখার জন্যই তো এসেছেন আবির সাহেব। আর রান্না যা-ই হোক সময় লাগবে মনে হচ্ছে এখনো। চলুন, কিছুক্ষণ দাবা খেলা যাক। আপনি খুব ভালো খেলেন, শিলা বলেছে। আরও অনেক কিছু বলেছে...’

‘শিলা যদি বলে থাকে তাহলে সবই হয় বাড়িয়ে, নয়তো বানিয়ে বলেছে’, বিনয়ের সুরে শিলাকে খোঁচা দিয়েই বুঝল শিলা শুনে ফেলেছে।

‘তবু তো একজন তোমারে নিয়ে কথা বলছে। আমি না থাকলে তোমারে...’

‘দাবা আর ঘুঁটিগুলো একটু এনে দেবে?’ বলে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে শরিফ। শিলা দাবা আনতে গেলে শরিফ ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘মাথাটা একটু গরম। চট করে রেগে যায়। ওহ, আপনাকে কী বলছি! আপনি তো জানেনই, ওর এত ভালো বন্ধু...’

‘এ কথাটা কমিয়ে বলেছে দেখছি!’ হঠাৎ কি এক রোখ চাপে আবিরের মাথায়, শিলার হয়ে কেউ কথা বলছে বলেই কি? দাবার ঘুঁটি সাজাতে সাজাতে বলে, ‘প্রেম ছিল আমাদের। গভীর প্রেম, বলেনি সে?’

থতমত খেয়ে যায় শরিফ, কী বলবে বুঝতে পারে না। তবু স্বাভাবিকভাবে চাল দিতে দিতে হেসে পরিস্থিতি হালকা করতে বলে, ‘তো বিয়ে করলেন না কেন?’

আবির রোখটা চেপে উদাস স্বরে বলে, ‘গভীর কিছুর তল খুঁজে পাওয়া যে বড় কঠিন, শরিফ সাহেব। তার জন্য দম থাকতে হয়, জীবন বাজি রাখতে হয়। হয়তো এক জীবনে ধৈর্য ধরতে হয়।’

আর কথা এগোয় না। ফুরফুরে আবহাওয়াটা কেমন গুমোট হয়ে ওঠে। শরিফ খেলায় মনোযোগ দিয়ে অস্বস্তি এড়ানোর চেষ্টা করে, আবির এলোমেলো খেলতে থাকে। তার মনে তিন মাস আগের সময়গুলো দলা পাকিয়ে যায়। শিলা যেদিন বিয়ের কথা বলল সেদিন আবির প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে, বলে, ‘ফেয়ারওয়েল দেন, ভালো থেকো বাবু।’ তারপর প্রায় ছুটে চলে আসে সামনে থেকে। বুক ফাটানো একটা চিৎকার হজম করলেও চোখের জল আটকাতে পারে না। টপটপ জল পড়তে থাকে স্মৃতিতে, দাবায় মারা পড়তে থাকে দুটো হাতিই, একটা ঘোড়া, পাঁচটা সৈন্য, মন্ত্রীও। বিনিময়ে সে খেতে পেরেছে একটা ঘোড়া, একটা কিস্তি আর দুটো সৈন্য!

শিলা এসে রান্না শেষ হওয়ার খবর দেয় আর খেলার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। আবিরের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘তোমার এমন দুরবস্থা কেন! কী খেলতেছ! ভালো করে খেল।’

আবির নিরাবেগ ভঙ্গিতে জবাব দেয়, ‘তোমার বর বড় ভালো খেলছেন।’

আবিরের জন্য শিলার উদ্বেগ দেখেই কিনা রাগ হয় শরিফের, কিছুটা রুক্ষ স্বরেই বলে, ‘আপনি ভালো করে খেলছেন না, আবির সাহেব। নাকি আপনি এমনই খেলেন? অবশ্য প্রেমিকার চোখে সব প্রেমিকই হিরো হয়, পারুক চাই না পারুক। নাকি আপনার তাড়া আছে যাওয়ার, তাড়াতাড়ি শেষ করতে চান?’

শিলা থতমত খেয়ে বোঝার চেষ্টা করে, ‘মানে? কী বলছ এসব!’

আবিরের রোখ চরমে ওঠে, কাটা কাটা গলায় বলে, ‘বাজি ধরবেন, শরিফ সাহেব? এই অবস্থা থেকেও আমি আপনাকে হারাব। বাজিমাত করব, আপনি খেলবেন, বাজি?’

তাচ্ছিল্যের সুরে পালটা জবাব দেয় শরিফ, ‘ও বাবা! আপনি আবার জুয়াড়িও নাকি? আপনার এত গুণ তো জানতাম না। বাজি ধরবেন? ঠিক আছে, কত হাজার বলেন। নাকি লাখের খেলোয়াড় আপনি?’

শিলা একবার এর, একবার ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই আবিরের কথায় যেন বোমা ফাটল ঘরে। বোমার তীব্র শব্দের পর যেমন পিনপতন নীরবতা নামে, তেমনি নৈঃশব্দ্যের মাঝে ঘড়ির কাঁটা শুধু জানাল যে নয়টা বাজে।

‘এত অবাক হওযার কী হলো?’ আবির যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলে গেল, ‘মনে হচ্ছে চুমু কাকে বলে আপনারা জানেনই না! আরে ভাই, চুমুই তো খেতে চেয়েছি, একটু গভীর করে চুমু খেতে চেয়েছি বাজিতে জিতলে, খুন করতে তো চাইনি।’

‘আর হারলে?’ অনেকক্ষণ দম আটকে রাখার পর ছাড়ার মতো করে বহু কষ্টে বলে শরিফ।

‘গুড। তার মানে আপনি রাজি। আমিও শুনেছিলাম আপনি লিবারেল টাইপের মানুষ। এ ভাবধরা সতী-সাধু ঘরানার নন। আর তা ছাড়া শিলা আমাকে রেখে যে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, সে যতই বাবা-মাকে কষ্ট না দেওয়া, পরিবারের ইজ্জত রক্ষা বা সমাজের স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্যই হোক : আমার একটু ছায়া আপনার মধ্যে না থাকলে সে পারতই না।’

চোয়াল শক্ত করে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে শরিফ। শিলা মাঝখানে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী শুরু করছ তোমরা, হ্যাঁ? আমি বাজির দান! সভ্য লোকের মতো যারা একসাথে বসে খেতে পারে না, একটা সন্ধ্যা কাটাতে পারে না, তারা কি মানুষ!’

আবির নরম স্বরে শিলার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘একটু চুমুই তো খেতে চেয়েছি তোমাকে। সে-ই দিনগুলো, আলো-আঁধারিতে আমাদের যৌথ সময়, ঠোঁটে...’

বিরক্তি-সংকোচে ম্রিয়মাণ শিলা স্বামীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই শরিফ বলে ওঠে, ‘তুমিও বা কেমন মানুষ, গভীর জলের মাছ! সবকিছু নিয়ে এত এত বলেছ অথচ এটা নিয়ে আমাকেও কিচ্ছুটি বলোনি? আর একজনকে এত গভীর ভালোবেসে তাকে সে ফ ছেড়ে চলে এলে কী করে!’ তারপর আবিরের দিকে তাকিয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রশ্নটি করে সে।

আবির খুব স্বাভাবিক গলায় জবাব দেয়, ‘আপনি যা বলবেন, তা-ই।’ কিছুটা আবেগ ভর করে গলায় যখন বলে, ‘জীবন বাজি রাখলাম, যান। হারলে জীবন দিয়ে দেব আপনাকে। যদি মারতে না পারেন, বলবেন, নিজে নিজেকে মেরে দেব। আর তুমি আমাকে শেষবারের মতো একবার চুমু খেতে চাও না, শিলালিপি? দ্য লাস্ট কিস?’

থমথমে নীরবতা নেমে আসে ঘরে। বাইরে আবার বৃষ্টি নেমেছে। এখন আকাশ ঝরবে, ঝরে ঝরে হালকা হবে একসময়। কিন্তু এ ঘরের তিনটি মানুষের মন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বহু ঘটনা ও সম্ভাবনায় ভারী হয়ে উঠছে ক্রমশ। শরিফ ভাবছে, এমন কিছুর জন্য যদিও প্রস্তুতি ছিল না, তবু ব্যাপারটা যখন জানা গেছে আর তার পেছনের লোকটাকেও যখন ধরাশায়ী করার সুযোগ মিলেছে, বাজিটা মন্দ নয় একেবারে। আবির জানে, সে এমনিতেও মরতে যাচ্ছে। জীবনটাকে আর টানা যাচ্ছিল না। যদি তার বিনিময়ে শেষবারের মতো শিলাকে একটু বুকে পাওয়া যায়, যদি বিষের আগে অমৃত জোটে শেষবার। শিলা কিছুই ভাবতে পারছে না। নিয়তিকে মেনে নিয়ে সে মানিয়ে নিয়েছিল বাস্তবতার সঙ্গে। সংসারের শুরুতেই স্বামীর সামনে প্রেমিককে চুমু খেতে চায়নি, চায়নি আবির মারা যাক। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, খাবারের কথাও কারও মনে পড়ছে না।

নীরবতা ভাঙে শরিফ, ‘তো শুরু করা যাক’ তার চোখে বিদ্বেষপূর্ণ কৌতুক খেলা করে, বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলে ‘আপনার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার, আবির!’

‘ভবিষ্যৎ বলে কি আদৌ কিছু আছে, শরিফ? তোমার সাজানো সংসারে কাল যদি শিলা না থাকে? সে যদি আমার সাথে যেতে চায়? তুমি কোথা থেকে উড়ে এসেছ হে, আমাদের মাঝখানে?’

‘তোমাদের মাঝখানে? বরং আমার বাসায় তুমি এসেছ উটকো লোক। প্রতিটি কথায় বারবার তুমি ঢুকে পড়েছ আমার সংসারে। খেতে গিয়ে, ‘আবির বলত এটা খাওয়া আর মাটি খাওয়া একই কথা!’ সিনেমা দেখতে গেলে, ‘আবির থাকলে এই সংলাপের অন্য মানে বের করতই, তোমাকে বলা যাবে না!’

‘কতবার না করেছি, তবু ডাকলে কেন? তুমি কত সুখে আছ দেখাতে? আমার সঙ্গে যেটুকু কথা তাতেও তো ‘শরিফ আজ এটা এনেছে, ওটা এনেছে; রান্না করতে হাত পুড়িয়েছে!’ তুমি কী চাও বলো তো?’ শিলার দিকে তীব্র প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আবির। শিলা কিছু বলে না, চুপচাপ দাবার সৈন্যটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেটি মন্ত্রী হওয়ার প্রতীক্ষায় আছে।

খেলা খুব ধীরলয়ে চলছে। দুজনই সময় নিয়ে বহু ভেবে-চিন্তে চাল দিচ্ছে। তবে আবির যেন হঠাৎ নিজেকে খুঁজে পেয়েছে, হয়তো পুরস্কারটার জন্যই বা জীবনবাজি বোধহয় একেই বলে। শরিফ কিছুটা এলোমেলো হয়ে পড়েছে, বেশি আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে ভুল-ভাল চাল দিয়ে একটা ঘোড়া খুইয়েছে আগেই। এখন, একটা কিস্তি। মন্ত্রী আর কিস্তির মাঝখানে যদি ঘোড়া এসে পড়ে, একটাকে যে হারাতেই হয়। খেলায় সুবিধে করতে পারছিল না বলেই হয়তো শরিফ হাই তোলে আর বলে, ‘চা প্রয়োজন এখন। শিপি, তুমি কি একটু যাবে?’

‘আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না, নিজেই বানিয়ে নাও লাগলে।’ কড়া গলায় বলে শিলা। তার চোখ তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঠায়। শরিফ উঠে গেলে শিলা চাপাস্বরে কিন্তু প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বলে, ‘তুমি কি আমার সংসার ভাঙতে এসেছ?’

‘না, বাবু! আমি তো নিজেকে ভাংচুর করতে এসেছি। একবার তোমাকে ছোঁব, তারপর হব ইতিহাস... তুমি তোমার বরের পক্ষে খেল না, তাহলেই তো আর তোমার সংসার ভাঙে না, আমি আপদও বিদেয় হই।’

শিলা কিছু বলার আগে দুই মগে চা নিয়ে আসে শরিফ, চায়ের পাতিল চুলাতেই ছিল। শিলাকে বলে, ‘তোমার জন্য আনিনি। তুমি শুয়ে পড়, তোমাকে খেলার রেজাল্ট জানিয়ে দেওয়া হবে।’

শিলা কটমট করে তাকায়। আবির বলে, ‘আপনারা হ্যাপী কাপল, একটা উটকো লোকের জন্য মাঝরাত্তিরের চা পান কেন মিস করবেন? আমি নিচ্ছি না, একটু ওয়াশরুমটা?’ ইশারায় দেখিয়ে দিলে আবির চলে যায়। বোর্ডের দিকে দেখিয়ে শরিফ শিলাকে বলে, ‘হাড্ডাহাড্ডি অবস্থা এখন। কিন্তু আমিই জিতব। তুমি চাইলে প্রেমিকের পক্ষে খেলতে পার, এমন সুযোগ তো সবাই পায় না, তুমিও ভবিষ্যতে পাবে না।’

আবির ফিরে এলে শিলা শোবার ঘরে যায়। বিছানার ওপর বসে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ওদিকে দাবায় মগ্ন দুজন পরস্পরকে কথার আক্রমণেও পর্যুদস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়, তারা খেয়াল করে না। গভীর রাতে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে শিলা; সে হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছে। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে যেন, কিন্তু মাথা ঠান্ডা বলতে যা দরকার তা হচ্ছে না; সে ভাবতে পারছে না কিছু।

অনেকটা সময় পর যখন শিলা সিদ্ধান্ত নিতে পারল যে সে শরিফের সংসারে আর ফিরবে না এবং জীবনেও আবিরের সঙ্গে দেখা করবে না; তখন আবিরের নিঃসঙ্গ রাজা শরিফের রাজা-হাতির দুর্বল ফাঁদ এড়িয়ে ষোলো ঘর পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম