Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অসাম্প্রদায়িক নজরুল

Icon

শাহীনুর রেজা

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাজী নজরুল ইসলাম এর সঙ্গে ২৫ এপ্রিল ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ ১২ বৈশাখ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার বাদ জুমা কলকাতা ৬নং হাজী লেনে ‘আহলে কেতাব’ অনুসারে আশালতা সেনগুপ্তের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়। এ আইনে স্ব-স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে হওয়া অসিদ্ধ নয়। বিয়ের পর নজরুল তার স্ত্রীর নাম রাখেন প্রমীলা নজরুল। প্রমীলাকে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। এমনকি পরবর্তী সময়ে তার সন্তানদের নাম রেখেছিলেন দুই ধর্মের মিলিত ঐতিহ্যকে ধারণ করে। প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন-কৃষ্ণ মুহাম্মদ। পার্যায়ক্রমে অন্য তিন সন্তানের নাম ছিল অরিন্দম খালেদ বুলবুল, কাজী সব্যসাচী সানী ও কাজী অনিরুদ্ধ নিনি। তিনি তার রচনায় বলেছেন-‘মানুষ এনেছে ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোনো।’

নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী’ পাঠ করলে আমরা এর পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। ১৪৬ পঙ্ক্তির এ দীর্ঘ কবিতায় বিভিন্ন ধর্মের ৭১টি পৌরাণিক শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে- হিন্দু পুরাণ-৫৮টি, মুসলিম পুরাণ-৯টি, খ্রিষ্ট পুরাণ-২টি, বৌদ্ধ পুরাণ-১টি, গ্রিক পুরাণ-১টি। শব্দগুলো-হিমাদ্রি, রুদ্র, নটরাজ, ভীম, ধূর্জটি, পুরোহিত, সন্ন্যাসী, ব্যোমকেশ, ইস্রাফিল, শিঙ্গা, দুর্বাসা, দেবশিশু, বোররাক, বাসুকি, বিষ্ণু, শ্যাম, অর্ফিয়াস, জটাজাল ইত্যাদি।

নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো আজ এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নজরুল এদের নাম দিয়েছেন ধর্ম মাতাল। এরা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করেছে। এদের থেকে মুক্ত হতে আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

তিনি যে কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা তার ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ পাঠ করলে আমাদের উপলব্ধি হয়। তিনি লিখেছেন-‘নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন করার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু-তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ একটুকু ক্ষুণ্ন হয় না। তার মনে বলে, আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি-আমারই মতো একজন মানুষকে।’

বাংলা সাহিত্যে ধর্মবৈষম্য, শ্রেণিবৈষ্যম্য, বর্ণবৈষম্য, জাতিবৈষম্যের আহ্বান নজরুলের রচনাতে বরাবর সোচ্চার। তিনি তার লেখনীতে যে সাম্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন তা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ ও সুবিচার-সুশাসনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সব ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি মানুষকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন-

সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই,

মানুষের মাঝে হে মানুষ তুমি/সত্যের দিও ঠাঁই।

কে কোন্ গোত্রের, কে কোন্ জাতের বা কার ধর্ম বড়, কার জাত ছোট-আজ এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে অস্থিরতা তা নিয়ে নজরুল আগেই বলেছেন-

সকল জাতই সৃষ্টি যে তার/এ বিশ্ব-মায়ের বিশ্বঘর,

মায়ের ছেলে সবাই সমান/তাঁর কাছে নেই আত্মপর।

এক স্রষ্টার একজন মানুষ অন্য আরেকজন মানুষকে ছুঁলে তার জাত যাবে, এমন ঘৃণার কথা নজরুল মানতে পারেননি।

এমন চিন্তাধারার বজ্জাতদের তিনি বলেছেন-

জাতের নামে বজ্জাতি সব/জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া,

ছুঁলেই তোর জাত যাবে/জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।

গোটা বিশ্বব্যাপী নারীর সম-অধিকার নিয়ে আজ আন্দোলন হচ্ছে। অথচ দেড় হাজার বছর আগে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর প্রেরিত পবিত্র কুরআনে নারী অধিকার সমধিক গুরুত্ব পেয়েছে। তারই ধারায় আরেক মহা-মানুষ নজরুল শতবর্ষ আগে বলেছেন-

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি ও/চির-কল্যাণকর,

অর্ধেক তার দানিয়াছে নারী/অর্ধেক তার নর।

১. বাংলা সাহিত্য কোন্ ধর্মের মানুষের? হিন্দুদের? মুসলমানদের? এ প্রসঙ্গে নজরুল অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁর কাছে লিখিত পত্রে বলেন-‘বাঙলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের উভয়ের সাহিত্য। এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুরাও তেমনি মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে প্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্য দেখে ভুরু কোচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী।’ তিনি বলেন-‘আমি হিন্দু-মুসলমান এর গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করে ঐক্য গড়ার চেষ্টা করেছি। কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনা আরও স্পষ্ট হয়, যখন লেখেন- ‘আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে আমি কেবল এই দেশের এই সমাজের নই, আমি সকল মানুষের।’ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। তাই তো তিনি গেয়েছেন-

গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই

নহে কিছু মহিয়ান।

নজরুল উপলব্ধি করেছিলেন সার্বজনীন ভাবধারায় ধর্ম চর্চা করতে হবে। ধর্মের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারে, পরমতসহিষ্ণুতা থাকতে পারে তা তার রচনায় স্থান পেয়েছে। একদিকে তিনি যেমন ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্য-চরিত্রগত শব্দ ব্যবহার করেছেন, অন্যদিকে হিন্দুয়ানি ইতিহাস-চরিত্রগত শব্দ ব্যবহার করে কবিতা-গান লিখেছেন। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি বলিষ্ঠ করার জন্য তিনি লিখেছেন-

মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম/হিন্দু-মুসলমান,

মুসলিম তার নয়নমনি/হিন্দু তাহার প্রাণ॥

মানুষ স্রষ্টার সান্নিধ্য খুঁজতে মসজিদে যায়, মন্দিরে যায়, কাবায় যায়, তীর্থে যায়, কিন্তু হৃদয়ের কাছে যায় না। লালনের ‘আরশিনগর’-এ যায় না। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ নজরুলের কণ্ঠে ‘মানুষ’ কবিতায় ধ্বনিত হয়-

মিথ্যা শুনিনি ভাই/এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন

মন্দির কাবা নাই।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে নজরুল সব ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তা নয়, তিনি বিদ্রোহ করেছেন ধর্ম-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, যারা শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। ভণ্ড মোল্লা-মৌলভি, পুরোহিত-পাদ্রির বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। আজ গোটা বিশ্ব সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কারে ছেয়ে গেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের অসাম্প্রদায়িক নজরুলের চর্চা বাড়াতে হবে। তার অসাম্প্রদায়িক চেতনাই আমাদের কাছে অব্যাহতভাবে প্রাসঙ্গিক।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম