Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

নার্গিস আসার খানমের লেখক-মানস

Icon

আনোয়ারুল হক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দৌলতপুরের ষোল বছরের কিশোরী নার্গিসকে (১৯০৪-১৯৮৫) (আসল নাম : আসার খানম। প্রথম দেখাতেই নবীন কবি নজরুল ফুলের নামে আসার খানমের নাম পালটে এই নাম রেখেছিলেন) যে রাতে (৩ আষাঢ় ১৩২৮ বঙ্গাব্দ, ১৭ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) বাইশ বছরের যুবক নজরুল অজ্ঞাত (গবেষকরা কাবিননামায় যে শর্তের কথা বলেন, তা অনুমাননির্ভর) কারণে চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে বীরেন্দ্র সেনগুপ্তকে সঙ্গে করে কুমিল্লা চলে এলেন। সেই রাতেই নার্গিস নামের মেয়েটি নিজের ভাগ্যের পরিণাম প্রত্যক্ষ করে কেবল অশ্রু বিসর্জন করেছে। নজরুলের ভাষায়, ‘নিয়তি’কে এড়ানোর ক্ষমতা তার ছিল না। ‘পাষাণ দেবীর মতোই সে বেছে নিয়েছিল বেদনার বেদী-পিঠ।’(নার্গিসকে লেখা নজরুলের শেষ চিঠি দ্রষ্টব্য)

প্রেমিক নজরুলের প্রতি নিগূঢ় অভিমানে ‘বেদনার বেদী-পিঠ’ বেছে নেওয়ার পরও নার্গিস বিশ্বাস করতেন, নজরুল তার কাছে ফিরে আসবেন। এ আশায় নার্গিস ষোল বছর অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু নজরুল আর ফিরে আসেননি। ব্যর্থ প্রেমের দহনে প্রতিদিন তিনি দগ্ধ হয়েছেন। আরও বেশি অপমানের আগুনে পুড়েছেন তখন, যখন নজরুলের অন্তরঙ্গ বন্ধু মোজাফফর আহমদ ঘটনার আটচল্লিশ বছর পর ‘স্মৃতিকথা’য় (তৃতীয় মুদ্রণ, ১৫ অক্টোবর ১৯৬৯) ‘বিবাহ’কে অস্বীকার করে (প্রথম ও দ্বিতীয় মুদ্রণে স্বীকার করেছেন) বিতর্কের সূত্রপাত করেন। নজরুলের প্রতি নার্গিসের প্রেম সম্পর্কে তিনি ‘ছলনা’, ‘অভিনয়’, ‘তার মামা আলী আকবর খানের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নকারিণী’ ইত্যাদি নেতিবাচক মন্তব্য করেন।

নারীত্বের প্রতি এ অবমাননা নার্গিস মৃত্যু অবধি পলে পলে অনুভব করেছেন। পরবর্তীকালে সতের বছর অপেক্ষার পর বিবাহিত জীবনেও (কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে হয় ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ, ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে) নজরুলকে তিনি ভুলে যেতে পারেননি। তেমনি নজরুলও তার প্রথম প্রেম নার্গিসকে ভুলতে পেরেছিলেন এমন দাবি করা যাবে না। তবে, নার্গিস সম্পর্কে একথা বলা যাবে, নজরুলকে ভুলে যেতে না পারার মর্মযাতনা, বিরহী হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করার জন্য নার্গিস পরিণত বয়সে হাতে-কলম তুলে নিয়েছিলেন। লিখেছেন তিনটি উপন্যাস।

স্মর্তব্য, বিয়েতে অঘটন ঘটে গেলেও নার্গিসের জীবন থেমে থাকেনি। অপরদিকে, নজরুলেরও। বিপর্যস্ত অবস্থায় নজরুল কুমিল্লা ফিরে সেনগুপ্তের কান্দিরপারের বাসায় সপ্তাহখানেক ছিলেন। এ সময়ে বিধবা গিরিবালা দেবীর কন্যা প্রমীলার প্রেমে তিনি বাঁধা পড়েন। নজরুল আর ফিরে না এলে আলী আকবর খান স্কুলের পাঠ শেষ করিয়ে নার্গিসকে ঢাকায় এনে কামরুন্নেসা গার্লস কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। সেই সময়ে ওই কলেজে সহপাঠিনী ইন্দু চন্দ’র (পরে ইন্দু দত্ত) নার্গিস সম্পর্কে ভাষ্য আছে আজহারউদ্দিন খানের ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থে। -(পৃষ্ঠা : ৭৬) যে তিনটি উপন্যাসের কথা বলা হলো প্রকৃতপক্ষে, তাতে কথাকার নার্গিস রূপকের আড়ালে নিজের জীবনের কলঙ্কময় অধ্যায়কে তুলে ধরেছেন। আজ থেকে শত বছর আগে দৌলতপুরের মতো অজপাড়াগাঁয়ের সমাজে বিয়ের আসর ত্যাগ করে স্বামীর চলে যাওয়া একজন নারীর জীবনে যে কতটা দুঃখজনক, বেদনাদায়ক, লজ্জার ঘটনা এবং তার পরিবারের জন্য চরম অপমানের এর ভুক্তভোগী ছিলেন নার্গিস। যে বেদনার আঁচ অনুধাবন করেননি নজরুল জীবনী-লেখক, গবেষকরা।

নার্গিসের নিভৃত হৃদয়ের ক্ষত থেকে উৎসারিত রক্তক্ষরণ তার তিনটি উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। নার্গিসের প্রথম উপন্যাস ‘তহমিনা’। বিখ্যাত ইসলামিক পৌরাণিক কাহিনি ‘সোহবার-রুস্তম’ এ আছে, রুস্তম তার স্ত্রী ‘তাহমিনা’কে ছেড়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। এ কাহিনিকে উপজীব্য করে নার্গিস নিজের মনোকথা ব্যক্ত করেছেন। বাঁচা-মরার অনিশ্চিত যুদ্ধে রুস্তম তাহমিনাকে ছেড়ে গেলে এ নারী যে বিরহের অনলে দগ্ধ হয়েছেন তার সঙ্গে উপন্যাসে একাত্মতা অনুভব করেছেন নার্গিস।

‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থে আজহার উদ্দীন খান লিখেছেন, ‘নার্গিস যে তিনখানা উপন্যাস লিখেছিলেন তার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন নিঃসন্দেহে নজরুল। ‘তহমিনা’ উপন্যাস সোহরাব-রুস্তমের কাহিনি রুস্তমের পত্নীর নাম তহমিনা। তহমিনা ও নার্গিসের ভাগ্য যেন একসুতায় বাঁধা। স্বামীর জন্য তহমিনার যে আকুলতা প্রতি ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়, সেটি যেন নার্গিসের নিজেরই আর্তনাদ। (পৃষ্ঠা : ৭৯)

নার্গিস ‘তহমিনা’র ভূমিকায়ও নিজের বেদনাবোধকে স্পষ্ট করছেন, ‘পাঠক! তোমরা যে কেহ তাহমিনার দুঃখ জাগানিয়া কাহিনি পড়বে, তার দুঃখে দু ফোঁটা অশ্রু ফেলো যেন-তাতেও যদি জনমদুঃখিনী তহমিনার সান্ত্বনা হয়। আর তার মতো দুঃখিনী কখনো কাহারও নজরে পড়ে, তাকে মানুষের চোখ দিয়ে দেখো যেন।’

উল্লেখ্য, ‘মানুষের চোখ তাকে দেখার’ আবেদনকে নজরুল ‘কটূক্তি’ ভেবেছেন। আর প্রতিষ্ঠিত গবেষক, জীবনীকার, স্মতিকথক কেউ এতে সাড়া দেয়নি। নজরুল লিখেছেন ‘হিংসাতুর’ কবিতা। যেটি ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ ‘সওগাত’ অফিসে বসে লেখা। কবিতাটি ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুল কবিতার ভাষায়, নার্গিসকে পালটা দোষারূপ করেছেন। যার উৎস, নজরুল নার্গিসকে লেখা প্রথম এবং শেষ পত্রে ‘পুনশ্চ’ দিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘তোমার কোন পুস্তকে...কটূক্তি ছিল।’...

নার্গিসের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ধূমকেতু’। এ ধূমকেতু যে নজরুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্য-শিল্পের ভুবনে নজরুলের আবির্ভাব ‘ধূমকেতু’র মতো। তার বিখ্যাত অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকার নাম ছিল ‘ধূমকেতু’। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ২৬ শ্রাবণ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, ১১ আগস্ট ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। এ ‘ধূমকেতু’র পুচ্ছের আগুনে জ্বলেছে পুড়েছে ব্রিটিশ রাজশক্তি। তার স্রষ্টার প্রেমের আগুনে পুড়ে পুড়ে দগ্ধ হয়েছে নার্গিস। তার লেখা উপন্যাসের নাম ‘ধূমকেতু’ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। জাগতিক আকাশে ধূমকেতু’র উদয় ও অস্ত যেমন অল্প সময়ের জন্য, তেমনি নজরুলও নার্গিসের জীবনে আকস্মিক এবং ক্ষণকালের জন্য উদিত হয়েছিলেন। যেতে যেতে সে যেমনি পোড়া দাগ রেখে যায়, নজরুলও এ গ্রাম্য তরুণীর মনে পোড়া দাগ রেখে অন্তর্হিত হয়েছেন।

বাঙালি জীবনে প্রচলিত একটি সংস্কারের কথাও এখানে তুলে ধরা যায়, তা হলো, ওই পুচ্ছধারী আলোক উজ্জ্বল বস্তুটি আকাশে যে সময় দেখা দেবে, সেই সময় সে অমঙ্গল বয়ে আনে। এটি চলে গেলে লোকজীবন স্বস্তিবোধ করে। তার কারণ, ‘ধূমকেতু’ কবিতায় নজরুলের ভাষায়, তিনি-

...স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!...

আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ।...

নার্গিসের জীবনেও তিনি অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। ‘ধূমকেতু’ উপন্যাসের ভূমিকায় নার্গিস বলেছেন, ‘তহমিনা’র পর ধূমকেতুর উদয় বিস্ময়কর হইলেও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। শুধু আকাশেই ধূমকেতু’র উদয় হয় না,

মানুষের হৃদয়াকাশেও হয়; যাতে করে কত হৃদয় পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।’

উপন্যাসটির ভূমিকায় এই ‘কত’ হৃদয়ের একজন লেখিকা নিজে। অথচ নজরুল জীবনে নার্গিসকেই নেতিবাচক ভূমিকায় নির্ণয় করেছেন প্রাজ্ঞ গবেষক সমাজ। বলা বাহুল্য, এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব যারা পালন করেছেন, তারা এ পুরুষশাসিত সমাজেরই একজন। নজরুলের ভাষায়, যে ভাষা ঔপন্যাসিক নার্গিসেরও,

পুরুষ হৃদয়হীন

মানুষ করিতে নারী দিল তারে অর্ধেক হৃদয় ঋণ

খেয়ালের বশে তাদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা

লব-কুশ বনে ত্যজিয়াছে রাম পালন করেছে সীতা। (সংক্ষেপিত)

‘ধূমকেতু’ উপন্যাসের রচয়িতা নার্গিসের দৃষ্টিতে নজরুলও তেমনি, হৃদয়হীন। পৌরাণিক চরিত্র সীতাকে রামের পরিত্যাগ করার মতোই নজরুলও নার্গিসকে ত্যাগ করেছেন। অমানবিক এ সমাজ নজরুলকে বিব্রত (‘স্মৃতিকথা’ দ্রষ্টব্য) করার উছিলায় কোনোদিন প্রশ্ন করে জানতে চায়নি-কেন তিনি বিবাহ আসর ত্যাগ করে চলে এলেন? আদিকাল থেকে নারীকেই কেবল পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। প্রমীলাকে মেঘনাদের চিতায় আরোহণ করতে হয়েছে! পরিত্যক্তা নার্গিসকেও নজরুলের বন্ধু লেখক সমাজ, গবেষক, জীবনীকার, পারিপার্শ্বিক সমাজের ভ্রুকুটির অপমান আজীবন সহ্য করতে হয়েছে। সর্বশেষ, জনৈক নজরুল জীবনীকার কর্তৃক মামা আলী আকবর খানের (১৮৯৫-১৯৭৭) সঙ্গে নার্গিসকে জড়িয়ে কু-রুচির, কুৎসিত মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছে। -(দ্রষ্টব্য: গোলাম মুরশিদ: বিদ্রোহী রণক্লান্ত : নজরুল জীবনী, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮) এ অপমান, দুঃখগাথা অবর্ণনীয় কষ্টের। যার বিবরণই আছে তার উপন্যাসে।

নার্গিসের তৃতীয় এবং শেষ উপন্যাসের নাম ‘পথের হাওয়া’। এ উপন্যাসের বিষয়ও নজরুলকে লক্ষ্য করে। বিষয় বস্তুতে ঔপন্যাসিক নার্গিস যে ভ্রাম্যমাণ পথিক ‘হাওয়া’কে চিত্রিত করেছেন, সেই ছবির সঙ্গে নজরুলের বোহেমিয়ান চরিত্রের সাযুজ্য আছে। তিনি পথিক হাওয়া’র মতোই একদিন দুরন্ত বেগে এসে তার নিরিবিলি গ্রামীণ জীবনে দোলা দিয়ে আবার হারিয়ে গেছেন। যেমন করে হাওয়া আসে আর যায়। এ ‘পথিক হাওয়া’ প্রকৃতিকে দোলা দেয়, উড়িয়ে, বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সে নিজে স্থায়ী হয় না। নজরুলও নার্গিসের জীবনে তেমনি করে এসে তার শান্ত জীবনকে ওলট-পালট করে দিয়ে গেছেন। দুরন্ত হাওয়া মনকে আনমনা করে দেয়। স্বপ্ন দেখায়, ঘর বাঁধে না। বাঁধন ছিঁড়ে যায়।

যুবক নজরুল যখন কুমিল্লার দৌলতপুরে নার্গিসের জীবনে এসেছেন, কলকাতার সমাজে তখন তিনি উদীয়মান, প্রতিশ্রুতিশীল, সম্ভাবনাময় তরুণ কবি। বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। ‘পথের হাওয়া’র মতোই ভেসে বেড়ানো এলোমেলো। পথের পথিক বটে। এ নজরুলের দেখা পাওয়া যায় নার্গিসের লেখা একটি গানেও। যাতে উপন্যাস তিনটিতে ব্যক্ত মনের ভাবই ফিরে এসেছে,

তুমি তো বলেছিলে চিরদিন সাথী হয়ে থাকবে

কুড়িয়ে পাওয়া এই বনফুল মালা করে রাখবে

হে পথিক, তুমি ভালোবেসে/এইতো সেদিন জড়ালে এসে

আজ তুমি হায় ছিঁড়িলে বাঁধন/আর কি গো কাছে এসে নাম ধরে ডাকবে।।

আমি সূর্যমুখী জাগি তোমার ধ্যানে/ফুটিয়েছিলে তুমিই আমায় গানে গানে

সবকিছু আজ ভুলে গেছ জানি/ভুল করে সুরভী কি আর তুমি মাখবে।। (প্রয়াত গবেষক বুলবুল ইসলামের সৌজন্য প্রাপ্ত ‘অর্ফিয়াস’ গ্রন্থে মুদ্রিত)

বলা আবশ্যক, মনের অনিবারিত কষ্ট এবং সেই তাগিদেই নার্গিস লিখেছেন। যে তিনটি উপন্যসের কথা বলা হলো এর তথ্য আজহার উদ্দীন খানের ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থে আছে। কে ছিলেন প্রকাশক, প্রকাশকাল ইত্যাদি তথ্য দেওয়া নেই। বিষয়টি অনুসন্ধানের। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে নার্গিসের লেখক সত্তার সঠিক মূল্যায়নের। এ দাবি নজরুল-জীবন ইতিহাসের।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম