Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

কবি, সমালোচক ও সমালোচনা

Icon

সরকার মাসুদ

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কবি, সমালোচক ও সমালোচনা

সমালোচক বা Critic শব্দটি আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তার ক্রমবিকাশের এক অনিবার্য পরিণতি। ভারতবর্ষের ঐতিহ্য সমালোচক ছিল না; ছিল টীকাকার কিংবা ভাষ্যকার। ইউরোপীয় ঐতিহ্যেও জন ড্রাইডেন, বেন জনসন প্রমুখের আগে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। বাংলাসাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, উনিশ শতকের শেষার্ধে সমালোচনা নামক বস্তুটি আকার পেতে আরম্ভ করে। বিশ শতকের প্রথম দুই-তিন দশকে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথনাথ বিশী, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখের হাতে তা বেশ শক্ত-সবল হয়ে ওঠে। তবু ওই সমালোচনা এলিয়টকথিত The commendation of works of art by means of written words (লিখিত শব্দের মাধ্যমে শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা তৈরি)-এর বেশি কিছু ছিল না। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম কেবল রবীন্দ্রনাথ ও মোহিতলাল। প্রধান কারণ তারা কবি। কবি বলেই তারা সমালোচনার মতো কঠিন বিষয়কে একইসঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত ও সরল করে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। এ বিষয়ে আর্নল্ড কী বলেছেন লক্ষ করুন। তার মতে সমালোচনা হচ্ছে a disinterested Endeavour to learn and propagate the best that is known as thought in the world (পৃথিবীতে যা কিছু শ্রেষ্ঠ বলে জানা ও ভাবা হয়েছে তা জানার ও প্রচার করার নিরাসক্ত চেষ্টা)। খেয়াল করুন এ সংজ্ঞায় প্রযুক্তি The best কথাটি। অর্থাৎ সমালোচক হওয়ার জন্য প্রয়োজন শ্রেষ্ঠ চিন্তা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা, সেই জ্ঞান অন্যের সামনে যুক্তিগ্রাহীভাবে উপস্থাপন করা। খাঁটি সমালোচকের কাজ হচ্ছে শিল্পকর্ম সম্বন্ধে পাঠকের/দর্শকের/শ্রোতার মনে প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করা। তেমন সমালোচক আমাদের এখানে বিরল। এ ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিন্যাসের ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যাতে পরের প্রজন্মের জ্ঞানার্থী সহজেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণবন্ত অংশটি খুঁজে পায় এবং বিষয়মাফিক কাজে লাগাতে পারে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও হুমায়ুন আজাদের মতো দু-চারজন লেখকের কাজের ভেতর সেটা দেখতে পাওয়া যায় যদিও তার বিস্তৃতি কম। এদের লেখায় যে সংবেদনার ঘনত্ব ও প্রসঙ্গনিষ্ঠ দৃঢ়তা পাওয়া যায় তা অনুসরণযোগ্য।

আধুনিককালে সমালোচনা ও মূল্যায়ন সমার্থক। মূল্যায়নের গোড়ার কথা প্রচুর জ্ঞান সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কিত পরিচ্ছন্ন ধারণা। সমালোচনা কোনো না কোনো তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। সমালোচক ব্যক্তিটি দর্শনবিৎ নাও হতে পারেন, অনেকেই তা ননও, কিন্তু তার মূল্যায়নে সুন্দর, অসুন্দরের যে তারতম্যজ্ঞান, সামগ্রিক শিল্পধারণা ও নির্ণয়ী ভাবুকতা নিহিত তা মূলত এক জাতের দার্শনিক চিন্তা থেকেই আসে। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে কোলরিজ ও ওয়াল্টার পেটারের মতো সমালোচকদের। এরা অ্যারিস্টটল টমাস অ্যাকোয়ায়নাস, ক্রোচে বা হেগেলের মতো দার্শনিক সমালোচক নন। এরা হলেন যাকে বলে দর্শন অনুরাগী লেখক। ফলে যখনই সাহিত্যের কথা বলেছেন তখনই তার বক্তব্যের দার্শনিক পশ্চাৎপট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ লেখকরা সমালোচনায় বৃত হয়েছেন সাহিত্যের সৌন্দর্য অনুভব থেকে জন্ম নেওয়া অভিপ্রায় থেকেই। কেননা একজন কবি কোনো ক্ষেত্রে মহৎ আর কোথায় তা নন, কী তার সামগ্রিক শিল্পকৃতি এসব তারা কেবল নিজেরাই বোঝেননি। অপরকেও বোঝাতে চেয়েছেন। আরও একশ্রেণির সমালোচক আছেন, যারা কোনো দার্শনিক তত্ত্ব বিষয়ে সচেতন নন কিংবা খানিকটা জ্ঞান থাকলেও তা সাহিত্য মূল্যায়নে প্রয়োগ করতে অনিচ্ছুক। দেখা গেছে, এ জাতের সমালোচকও মূল্যায়নের কাজে পটু। শঙ্খ ঘোষ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, অশ্রুকুমার সিকদার, হায়াৎ মামুদ প্রমুখ এ ঘরানার লেখক।

সমালোচনা কাজটির সঙ্গে প্রচারপ্রবৃত্তিও সম্পর্কিত। ‘প্রচারেই প্রসার’ কথাটির সঙ্গে সবাই কমবেশি পরিচিত। সমালোচনা যদি সৎভাবে করা যায়, তা সাহিত্যের শিক্ষার্থীর উপকারে আসে এবং শিল্পকর্মের শ্রীবৃদ্ধিতে তা সাহায্য করে। লেখক, এভাবে একটা সাংস্কৃতিক-সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। সমালোচকের কাজ আমরা সচরাচর যেমনটা মনে করি সেরকম নয়। তা বহুমুখী এবং অনেকখানি জটিল। মার্কসবাদী সমালোচনা, মনস্তত্ত্বনির্ভর সমালোচনা, কলাকৈবল্যবাদী সমালোচনা, আঙ্গিককেন্দ্রিক আলোচনা-এ রকমভাবে ভাগ করলে বিষয়টিকে খণ্ডিত করা হয়; এতে করে সমগ্রের ধারণাকে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। এটা অন্ধের হাতি দর্শনের মতো ব্যাপার হয়ে যায়। আসলে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, শিল্পসংক্রান্ত গভীর ধারণা ও বিস্তৃত অভিজ্ঞতা। সবার আগে দরকার সুরুচি। এ সুরুচিই ঠিক করে দেয় আপনি কীভাবে লিখবেন, কী ধরনের বিষয়-আশয় বাছাই করবেন, এমনকি কেমন লোকজনের সাহচার্য নেবেন। সমালোচনাকর্মে সহৃদয়তা ও বিবেকিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জিনিস লেখকদের, বিশেষ করে নবীন লেখকদের প্রণোদিত করে সৃজনী কাজে, সর্বদাই। দুধরনের লেখককে আমরা সমালোচক হিসাবে চিনি। ক. সৃষ্টিশীল লেখক যিনি কেবল নিজে কবিতা বা কথাসাহিত্য রচনা করেন না, অপরের লেখার মূল্যায়নও করেন। খ. সৃষ্টিশীল লেখক নন কিন্তু অন্য লেখকদের রচনার মূল্যায়কর্মে নিবিষ্টচিত্ত। দ্বিতীয় ধরনের লেখকরাই সাধারণত সমালোচক হিসাবে পরিচিত। পশ্চিমা বিশ্বে এ জাতীয় সমালোচক অসংখ্য এবং তারা এ কাজে এমনই মান অর্জন করেছেন যে, একজন যশস্বী সমালোচকের ভালো বা মন্দ (বুক রিভিউএ) বলার ওপর একটি গ্রন্থের বিক্রির কম-বেশি অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এখন আমি বাংলা ভাষার দুজন প্রাবন্ধিক-সমালোচকের নাম করব যারা নিজেরা কাব্যচর্চা করেননি কিন্তু কাব্যসমালোচক হিসাবে বিখ্যাত হয়েছেন- ১. আবু সয়ীদ আইয়ূব ২. শিবনারায়ণ রায়। শিবনারায়ণের অবশ্য ছিটেফোঁটা কাব্যপ্রয়াস আছে। তবে তা নিতান্তই অনুল্লেখ্য। আবার ‘কবি ও প্রাবন্ধিক’ কিংবা ‘কবি ও সমালোচক’ এরকম শব্দবন্ধের সঙ্গেও আমরা পরিচিত বহুকাল যাবৎ। বেনজনসন বহু যুগ আগে মন্তব্য করেছিলেন-To judge the poets is only the function of post। কোলরিজও সমজাতীয় কথা বলেছিলেন। জনসন সাহেবের ওই উক্তির ভেতর সত্য আছে, কিন্তু কবিমাত্রই তো আর সমালোচনাশক্তির অধিকারী নন। তাছাড়া ব্যাপারটা এমনও নয় যে, যিনি সুকবি তিনি কবিতার ভালো সমালোচকও। তাহলে তো বিনয় মজুমদার শামসুর রাহমান বা শক্তি চট্টোপাধ্যায় একইসঙ্গে বড় সমালোচকও হতেন; রবার্ট ফ্রস্ট কিংবা পারলো নেরুদাকে উঁচু দরের কাব্য বিশ্লেষক হিসাবেও পেতাম আমরা। বাস্তব চিত্র কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। রবার্ট পেন ওয়ারেন, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, উইলিয়াম রাদিচে, হায়াৎ সাইফ প্রমুখ কবি হিসাবে দ্বিতীয় শ্রেণির কিন্তু কাব্যবিশ্লেষক হিসাবে অধিকতর সক্ষমতার পরিচয় রেখেছেন। অন্যদিকে খুব বড় মাপের কাব্যপ্রতিভা নিয়ে আবির্ভূত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও সমালোচক বা কাব্যবিশ্লেষক হিসাবেও অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন এলিয়ট, এজয়া পাউন্ড, জীবনানন্দের মতো মনস্বী লেখকরা। পাউন্ড তার সমালোচনা সাহিত্যে temperament শব্দটিকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। শব্দটির পুনরাবৃত্ত প্রয়োগও লক্ষণীয় তার লেখায় এবং আমরা জানি, শ্রেয়বোধ তৈরির কাজে ওই temperament-এর ভূমিকা কতটা কার্যকর। আধুনিক কবিদের গুরুশার্ল বোদলেয়ারও বিশ্বাস করতেন, কবিরাই হতে পারেন শ্রেষ্ঠ সমালোচক। আর জন ড্রাইডেন মনে করতেন, শিল্প সৃজনে ব্যর্থ ব্যক্তিরাই সমালোচক হিসাবে আবির্ভূত হন। মন্তব্যটি করার আগে তিনি বোধ হয় ভেবে দেখেননি যে, ওই ঢিল শেষ পর্যন্ত তার মাথার ওপর এসে পড়বে। কেননা ড্রাইডেন শুধু উঁচু দরের সমালোচকই নন; একাধিক উচ্চমানসম্পন্ন কবিতারও স ষ্টা। সমজাতীয় কথা আমরা ম্যাথু আর্নল্ড সম্বন্ধেও বলতে পারি যিনি Dover Beach-এর মতো অসামান্য কবিতার জনক।

পৃথিবী সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠ কবি এবং প্রতিভাদীপ্ত সমালোচক-এ দুয়ের উপস্থিতি একই ব্যক্তির মধ্যে কদাচিৎ ঘটে। তিরিশের প্রজন্মের শুধু জীবনানন্দ নয়, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে; চল্লিশের সমর সেন-এরাও একাধারে কবি ও সমালোচক হিসাবে রীতিমতো সামর্থ্যবান। শিল্পী তার স্বকৃত শিল্পকর্মের কিংবা অপরকৃত সমজাতীয় শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পারঙ্গম নয়-প্লেটো তার ‘আইওন’সহ একাধিক গ্রন্থে এমন কথা বলেছেন। ওই মন্তব্যকে স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে গণ্য করলে সেই কবিদের প্রতি অবিচার করা হবে, যারা সমালোচক হিসাবেও যোগ্যতার উজ্জ্বল পরিচয় রাখতে পেরেছেন। একটা সময় ছিল যখন লেখক-শিল্পীরা সাত-পাঁচ না ভেবে সহজ-সরলভাবে তাদের ‘কাজ’গুলো সম্পন্ন করতেন। কিন্তু আধুনিক যুগ লেখক-শিল্পীদের আত্মসচেতন হতে বাধ্য করেছে। আজ আত্মসমালোচনা ব্যতিরেকে কোনো শিল্পকর্মই ছাড়পত্র পায় না। এই আত্মবিচারী সমালোচনাশক্তি শিল্পসৃজনের অপরিহার্য শর্ত। একজন কথাসাহিত্যিক কি লিখতে লিখতে কিছু সময়ের জন্যও পেছনে ফিরে তাকান না? কিংবা একজন কবি তার কবিতাটির চূড়ান্ত পাঠ তৈরির আগে কি দু-একবার তা পড়ে দেখেন না সমালোচকের দৃষ্টিতে? সেদিক থেকে ভাবলে আমরা দেখি, প্রত্যেক স ষ্টাই সমালোচক।

সমালোচক যদি সুকবি হন তাহলে কাব্য রচনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সমালোচনা কর্মকে সুদৃঢ় ভিত্তি দিতে পারেন। তেমন সমালোচকের ‘কাজ’ সচরাচর গ্রাহ্য হয়ে থাকে। তবে নিজে কবিতা না লিখলেও উচ্চমার্গের সমালোচনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন এফ আর লিভিস, আবু সায়ীদ আইয়ুবের মতো বিদগ্ধজনরা। কবি-সমালোচকের অবস্থানকে অগ্রগণ্য বিবেচনা করলে একথা মানতে হবে যে, বড় মাপের কবি বড় মাপের সমালোচক, আর দ্বিতীয় শ্রেণির কবির সমালোচনাও দ্বিতীয় শ্রেণির। বাংলাদেশে আমরা এমনটা প্রায়ই হতে দেখছি যে, একজন দুর্বল কবির দু-একটা কবিতা বা কবিতার কিছু পঙ্ক্তি যদিও বা কষ্ট করে পড়া যায়; প্রবন্ধ নামধারী গদ্য একেবারেই পড়া যায় না। মনে পড়ছে কবি-সমালোচক কোলরিজের সেই প্রশ্নটি। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, গৌণকবি যদি সমালোচনা লেখেন সেই রচনার অবস্থা কী দাঁড়াবে?

বিশেষ ধরনের কল্পনাশক্তির অধিকারী বলেই একজন লেখক কবি হিসাবে গণ্য হন। অন্যদিকে, বিশেষ মূল্যায়নশক্তির অধিকারী হওয়ার ফলেই একজন লেখককে আমরা সমালোচক বলি একই লেখকের মধ্যে এ দুধরনের ক্ষমতার সমাবেশ হয়েছে এটি যেমন কোলরিজ, ডক্টর জনসন, ম্যাথু আর্নল্ড, এলিয়ট প্রমুখের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তেমনি রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, লোকনাথ ভট্টাচার্য, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখের লেখায়ও দেখা যায়। এটা মনে করা ভুল যে, সমালোচক কেবল মূল্যবিচারেই পারঙ্গম; তার কল্পনাশক্তি আদৌ নেই। কল্পনাশক্তি অবশ্যই আছে। সেটা নিচু স্তরের ‘নিচু’ কেন? কারণ ওই কল্পনা মুগ্ধ হতে বা অনুধাবন করতে সাহায্য করে; কোনো কিছু গড়তে পারে না। কবি বা শিল্পী যে অর্থে গড়েন সেরকম কিছু করতে অপারগ সমালোচক। তাই ‘কল্পনাপ্রতিভা’ শব্দটি কেবল কবির বেলাতেই প্রযোজ্য এবং শব্দটির আবিষ্কারকও একজন মহান কবি। সমালোচক মূলত বিশ্লেষণের কাজ করেন। যুক্তি-প্রমাণ তার কাজের একটা খুব উল্লেখযোগ্য দিক। তার আরও কাজ আছে। সেটা হচ্ছে পাঠককে সংবেদী করে তোলা। সমালোচকের ক্ষমতার সুকৃতিই কেবল পাঠকের মনে সঠিক প্রতিক্রিয়া জাগাতে পারে। রচনার সৌন্দর্য বা খুঁত তুলে ধরাই শেষ কথা নয়। অল্পবয়সি লেখকের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোও আলোকিত করা জরুরি। এ ছাড়া সার্বিক মূল্যায়নের প্রশ্ন যদি আসে, উচিত হবে যতটা সম্ভব লেখকের সেরা রচনাগুলো বিচারের আওতায় আনা। কবিতা-কথাসাহিত্য বিষয়ে গুরুত্ববিচারী মন্তব্য করার পাশাপাশি এ দিকেও গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু।

সৎ ও পরিশ্রমী সমালোচকের একটা বড় গুণ বিশেষ ধরনের হৃদয়বক্তা যার সঙ্গে বিবেকিতা জড়িত ওতপ্রোতভাবে। সহৃদয় বিবেচনার অর্থ তাই বলে সাহিত্যের ফেল করা ছাত্রকে পাশ করিয়ে দেওয়া নয় বরং কী কী করতে পারলে সে সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারত সে দিকনির্দেশনা দেওয়া। এক বহুপাধী, প্রাজ্ঞ সমালোচকের নাম শিবনারায়ণ রায়। তার ‘শেকসপীয়র, রবীন্দ্রনাথ, নক্ষত্রসংকেত’ গ্রন্থে ‘সহৃদয় পাঠকের খোঁজে কয়েকজন লেখক’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ আছে। ওই রচনায় ‘পাঠক’ বলতে তো তিনি সমালোচকই বুঝিয়েছেন। ‘সহৃদয়’ শব্দটির প্রয়োগ একজন সহানুভূতিসম্পন্ন সমালোচকের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিরই ইঙ্গিত দেয়। সৎ ও বিবেকী সমালোচক টেক্সটের ব্যবচ্ছেদ করেন অর্থাৎ কাটেন আবার ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে দেন। ত্রুটি বা স্খলন উল্লেখের পাশাপাশি ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে কথা বললে যে শিল্পসম্ভাবনার ক্ষেত্রে উন্মোচিত হয় তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্পসৃষ্টির প্রসঙ্গে আমরা ধ্যানের কথা বলি। ধ্যান বা চৈতন্য সমালোচকেরও খুব প্রয়োজন। তার দীক্ষিত সংবেদনায় শিল্পকর্ম বিচিত্র রূপে ধরা দেয়। তার সর্বগ্রাহী সুরুচির অনুমোদনও পায় সেই সৃষ্টিকর্ম। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নিজত্বজ্ঞাপক গদ্যভাষা। সব মিলিয়ে সমালোচনা হয়ে ওঠে ভাস্বর তার নিজস্ব সৃজনক্ষেত্রে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম