গল্প
বৃষ্টি অথবা ইরিন জামান
হাসনাত মোবারক
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাতাস ছুটছে, মেঘ উড়ে উড়ে আসছে। পাটকাঠির বেড়ার ঘরে শুয়ে-বসে আছি। অনেক পুরোনো একটা ঘর। বাংলা টিনের ঘর। ইচ্ছা করলে ঘরটি ভেঙে ফেলা যেত। সেটা আর হয়নি। বাড়িতে যাই না। ঘরটা যে আছে, সেটাই ভাগ্য। এ ঘরটিতেই আবার আমার আবাসন হবে। সেটা কে জানত! ছাত্রাবস্থায় অনেক বিখ্যাত হতে চাইতাম। বড় হয়ে রাজনীতি করব। মন্ত্রী-মিনিস্টার হব। এই ঘর দেখে সবাই বাহবা দেবে। রনক এই ঘরে পড়াশোনা করেছে। নামটা নিয়ে আমার অনেক আক্ষেপ ছিল। এই নামটা মন্ত্রী-মিনিস্টারের সঙ্গে যায় না।
প্রবল ক্ষমতাশালী হলে অনেক সুযোগ ঘটবে। কৈশোর পেরোনো মনে নানা কল্পনার ছবি আঁকতাম। স্বপ্ন দেখতাম। দীর্ঘদিন পর এই ঘরটাতে শুয়ে-বসে সেসবই ভেসে উঠছে। নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। তাড়াশের ইউসুফ ভাই প্রায় বলত, আরে বারেশ্বর বাল অইব। আমি আসলে সেই বারেশ্বর বাল হয়েছি। ব্যর্থ জীবন। শূন্য হাতে ফিরে এসেছি। একবারে চলে এসেছি তা নয়। ফিরে যাব। সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায়। আমার হাতে তেমন টাকা নেই। অসুস্থ হয়ে ফিরে এসেছি। একাকী থাকতে হবে। আমি বাইরে বের হলেও তেমন কিছু বলত না কেউ। শতশত মানুষ। কে কোথায় থেকে, এ রোগ বাঁধিয়ে, কী ছাড়িয়ে, গ্রামে আসতেছে, যাচ্ছে। কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। আঙ্গিনার শেষ মাথায় ঘর। খুব দুঃসাহসিক না হলে এখানে কেউ রাতে একাকী থাকতে পারে না। স্কুলের গণ্ডিটা এই ঘরে থেকেই পার করছিলাম। তখনো ভয় করেনি। ঘরের সামনে পুকুর। কচুরিপানা দিয়ে জমকালোভাবে আটকানো থাকত। চৈত্র-বৈশাখ মাসে দুর্দার ডাহুক, কোড়ার ডাকে অস্থির করে তুলত। মানুষের শব্দ বা কথা কানে এলে বইয়ের পড়া মাথায় ঢুকত না। তাই এ ঘরটাতে থাকতে পছন্দ করতাম। এই ঘরে খুব কম মানুষ আসত। এখন তো কেউই আসে না।
আমার সহপাঠী-সমবয়সিরা এ ঘরটা নিয়ে অনেক গল্প বলত। বানায়ে বানায়ে। বেলন দিতে যেভাবে রুটি বলিয়ে বলিয়ে বড় করা হয়। আমার ওই ঘরটা নিয়ে যে যে রকম পারে, ওকরম গল্প বানাত। অনেকেই এ ঘরটাতে আসার সাহস পেত না। রাতে ঝরঝর করে পড়তাম। হারিকেনের লাল আলোয় আমার মুখের ঘাম জমত। আসলে আমি কী তখনো পড়তাম! নাকি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম। সে সময়ে বিছানা বালিশ, শ্যাওলা কাপড়ের ওপর সাদা সুতা দিয়ে ফুল তোলা হাতপাখা। বস্তুগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে লাল আলোর পরিবর্তে সাদা আলো। ঘরভর্তি খাতা-কলমের জায়গায়, কয়েকটা হেডফোন, চার্জার, সেলফি স্ট্যান্ড, মোবাইল। নতুন নতুন টেক্সের রিল্পাই আর স্ন্যাপ চ্যাট, ভাইভার, হোয়াটস অ্যাপ, স্টুডেন্ট ডাটায় শিক্ষা অর্জন।
একুশ বছর আগের বা আরও আগের নিম কাঠের পড়ার টেবিল। যেটা এখনো রয়েছে। মনে হচ্ছে, গত পরশুই আমি এখানে ছিলাম। হারিকেনের চিমনি উথলিয়ে ওঠা ধোঁয়া অথবা আমার শত স্বপ্নের স্মৃতি। উসকে উঠছে গভীর রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে উঠতে যেসব বয়স্ক মানুষের মুখ। আমার ঘরের হারিকেনের আলো দেখে বুঝতেন, রনক এখনো পড়তেছে। সকালে ফজরের নামাজ আদায় করে এসে তারা খানকায় বসতেন। ওই কর্মহীন মানুষগুলোর আলোচনায় আমার সুভবিষ্যতের ছবি আঁকা হতো। আজ ওই বয়স্ক মানুষগুলো কেউ বেঁচে নেই। তারা বেঁচে থাকলে খটকা লেগে যেতেন। ভালোই হতো। তাদের ঘোর কেটে যেত। আমার ব্যক্তিজীবন দেখে ভিরমি খেতেন। তার চেয়ে বেশিটুকু ঘেরো লাগত, তারা কেউ আমাকেও বিশ্বাস করতেন না। আমাকে খোঁচাতেন, বিয়ে কেন করি নাই। সরকারি চাকরি করো নাকি! চাকরিতে ঘুস-ঘাস আছে নাকি! পশ্চিম চড়ার জমিগুলো তো আলিমুদ্ধির ব্যাটারা ৩০ বছর ধরে খাচ্ছে। সেগুলোর টাকা পরিশোধ করে দাও। নানা কথার উত্তর দিতে হতো।
বছর দেড়েক আগে একটা নামি প্রতিষ্ঠানে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করতাম। ঘোরে ঘোরে জীবন কাটাইছি। ধসে গিয়েছে আষাঢ়ের ঢলে। একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে চেয়েছিলাম। অদৃষ্টের পরিহাসে থিতু হয়ে এখন আমি এই ঘরে আবদ্ধ।
এই বৃষ্টি-বিধুর দিনে আমার চিরচেনা আবাসস্থলে বসে-শুয়ে আছি। ভালোই লাগছে ফিরে এসে। ফিরে আসাটা তো স্বাভাবিক নয়। এর পরও ভালো লাগতেছে। টিনের চালাতে জলপতনের শব্দ। বাঁকানো বাঁশের খুঁটির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কানাকুয়া পাখিটি ফিরে এসেছে ছিটকিনি গাছের ঝোপে। কানাকুয়া পাখিটি কত বছর পর দেখলাম! এ পাখিটির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিলাম। অনতিদূরে বরুণগাছ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। টানা কয়দিনের বৃষ্টিতে বরুণগাছে কালসিটের দাগের চিহ্ন। আমার ফুসফুসেও হয়তো অমন দাগ পড়ে গেছে কে জানে! সোনার ডিমের মতো বরুণ ফলগুলো টুবুশ টুবুশ করে পানিতে পড়ে ভেসে উঠছে। বরুণ ফলের ভোটকা গন্ধ বৃষ্টিতে ধুয়ে দিচ্ছে। চারদিকে অন্ধকার নামার পাঁয়তারা। ঘাটে ঘাটে নৌকা বাঁধা। এমন বৃষ্টির দিনে জলের সঙ্গে মনের সংযোগ, শরীরের সঙ্গে শরীরের অনুভব কামনা করি। সেটা কীভাবে সম্ভব!
এবার ফিরে এসে বুঝলাম মধ্যবয়সি ইরিন জামান এখনো অবিবাহিত রয়েছে। আমার সঙ্গে ওর দেখা হয় নাই। ওর সঙ্গে মাত্র হাফ প্রেম হয়েছিল। ওর শরীরের সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটানোর আগেই একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল। যেজন্য আমি লজ্জায় বাড়িতে আসিনি এতকাল। ইরিন জামানের কেশ থেকে জবাকুসুমের ঘ্রাণ বের হতো। কল্পনায় ওর ঘাড় বেয়ে আসা ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়েছি কতকাল আগের কথা। সুরের লহরী নিয়ে খেলা করা হয়নি। মানে সুযোগ আসে নাই। অর্থাৎ সাহস ছিল না। যেমনটি সাহস ছিল সেসময়ের সহপাঠী নূরের। ওর চাচাতো বোন বৃষ্টি আপু। সময়ে-অসময়ে বিছানায় যাইত। কখনো কখনো এক বিছানায় সারারাত কাটিয়ে দিত। আমার এ ঘরটিতেই আসত ওরা। কেউ বিশ্বাস করবে না বলে, আমি সেসব কথা কাউকে বলার সাহস পাইনি। যেমনটি সাহস হয়নি ইরিন জামানের কদবেলের মতো গোল স্তনে হাত দিতে।
কলেজ পড়ুয়া বৃষ্টির আপুর সঙ্গে স্কুল পড়ুয়া ছেলের যায় না। এ সুযোগটাই বৃষ্টি আপা নিয়েছিল। বৃষ্টি আপার কলেজে যাওয়ার দৃশ্যটা কত সুন্দর ও মনোরম। বৃষ্টি আপু হয়তো শিং মাছের ঠান্ডা তরকারির সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত ফুঁ পেরে পেরে খেয়ে দেয়ে কলেজে যেত। করতোয়া কলেজে পড়ত। বৃষ্টি আপা আর নূরের ব্যাপার নিয়ে কেউ কথা তুলত না। হয়তো কেউ জানতও না। আমার ভালোবাসার মানুষ ইরিন জামান। ওর শরীরের ঘ্রাণ কখনোই নিইনি। ওর ঘাড়ের গড়নটা শরীরের চেয়ে একটু মোটা ছিল। আমার মা বলত ইরিনের খাদুম খুদুম হাত-পা। ইরিনের মোহন-মধুর মুখের প্রীতিপ্রফুল্ল ভাবটুকু দেখার জন্য ওদের আঙ্গিনায় গিয়ে বসে থাকতাম। মা ইরিনকে পছন্দ বা অপছন্দ করত কিনা! সেসব জানতে চাই নাই। এর পরও সবাই জেনে গিয়েছিল। ওর বড় চাচা জয়পুরহাট থাকত। ওকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে নাকি কবুতরের খামার ছিল। কবুতর শান্তির প্রতীক। ইরিন মাঝে-মধ্যে সিরাজগঞ্জের গ্রামে বাড়িতে আসত। একদম শান্তিময়ীর মতো। আমাকে চিনত না। ওর ধারণা ছিল আমি সবাইকে জানিয়েছি। আমি সেসময় অনুমান করে নিয়েছিলাম, সেই মান-অভিমানে সে আমার সঙ্গে কথা বলে না। আমিও কম কীসের! মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনার পর দে ছুট। আর অমুখো হয়নি। ইরিনেরও খোঁজ নিতে যাই নাই। কাউকে কখনোই জিজ্ঞাসাও করিনি।
আজকের এ বৃষ্টিবকুল সন্ধ্যায় উথলিয়ে উঠছে পৃথিবীর সব ইরিন জামানদের কথা। আমি অসংখ্যক ইরিন জামানের প্রেমে পড়েছি। কাউকে কাউকে বিয়ে করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ফাইনালে গিয়ে ফিরে এসেছি। আসলে আমি তো আসল ইরিন জামানকে ভালোবাসি।
আজকের এই বৃষ্টির ঘোর কেটে যাওয়ার আগে, আমার ভাববিলাসী মনের ছবিটি কে বা কারা যদি এঁকে দিত। ফ্রয়েড! সিগমুন্ড ফ্রয়েড। মনোজগতের বড় প্রেজেন্টার। আমার মেন্টর হিসাবে তাকে নিয়োগ দিতে পারলে হয়তো আমি এই মধ্যবয়সি ইরিন জামানকে বোঝাতে পারতাম। বৃষ্টির বার্তাটুকু পৌঁছে দিতে পারতাম। কালীদাসের মালবিকাকে! নাকি ইরিন জামানকে! আমার ব্যাকুল ঘোর অথবা ইরিন জামানের বাস্তবতার গভীর দর্শনে। কথা নাই অনেক কাল। কথা বলবে কিনা জানি না। পারলে দূর থেকেও আমাকে একবার দেখে নিতে পারত। সেটা করছে কিনা জানি না। ওর কারোর সঙ্গে কমিটমেন্ট আছে কিনা বয়সে! নাকি আমার সঙ্গে নতুন করে আবার শুরু হবে। বাইরের কেউ কেউ পুরোনো কাসুন্দি কানাঘুষা করতেছে নাকি। আমিও যে অবিবাহিত রয়েছি এতকাল। সেটাও তো কেউ জানে না।
মেঘ ঘনানো দিন। কাপ-পিরিচে গরম ধোঁয়ার ঘ্রাণে ইরিন জামানের হাতের স্পর্শ। এক লাফে দাঁড়িয়ে যাব। অলস-উদাস ভাব নিয়ে বলব, আসছ ক্যান? তোমার তো সময় নাই। হয়তো ২/৪ ফোঁটা চোখের পানি পড়বে চায়ের পানিতে। কান্না মুছে দেবে ওড়না দিয়ে। চোখের পানি আর চায়ের পানি একাকার হয়ে এক অসাধারণ রং ধারণ করবে। কী দিয়েছ। এক্সট্রা কিছুই তো দেইনি। তুমি মোবাইল টিপবে, মোবাইল টিপার অপরাধে কিছুই বলব না। শুধু উদাস হয়ে তোমাকে দেখব। তুমি বলবে, ‘কী ব্যাপার একদম চুপচাপ। আমি তো ভাবছি হাজারও অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বসে আছ। কিন্তু এত দেখছি সেই লক্ষ্মীটিই রয়ে গেছ তুমি।’ আমি মেঝেতে বসে পড়ব।
ঝুম, বৃষ্টিতে ভেজার মতো বৃষ্টি। মন উদাস করা বৃষ্টি। বৃষ্টির অদ্ভুত এক ক্ষমতা মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের মনকে অস্থির করে তোলে। বৃষ্টিতে ভিজে জব জব হয়ে যাব। ঠান্ডায় যদি কেঁপে কেঁপে উঠি, তুমি আমারে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবে। নিশ্চই জড়িয়ে ধরাটা দেখে কেউ ছবি তুলে ভাইরাল করবে না। আচ্ছা বলত, এমন পাগল করা বৃষ্টিতে তোমারও কি ইচ্ছা হচ্ছে আমাকে চুমু দেওয়ার? আরে আরে আরে! ‘বৃষ্টি পড়ে অঝোর ধারায়, বৃষ্টি পড়ে লজ্জা হারায়।’ আচ্ছা আমিও কি সব লাজ লজ্জা হারিয়ে ফেলব? লোকে কী বলবে তার তোয়াক্কা না করে ভালোবাসায় হারিয়ে যাব। তুমি বলবে কী কর কী কর, একটু তো শরম কর। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, তুমি বলবে, ‘কী। তাড়াতাড়ি বল।’
চোখ বন্ধ কর। চোখ খুলে দেখবে হাতে কদমফুল। খুশিতে চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি এক হয়ে যাবে। মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলবে, কদমের আয়ু খুব সীমিত।
