Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

পিনিক

Icon

উম্মুল খায়ের

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কি চমৎকার ঠান্ডা হাওয়া! আজকের এই স্নিগ্ধ সকালটা মন ভরিয়ে দিল। ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে বসে দুলছি আর ভাবছি, প্রকৃতি কত্ত সুন্দর! কত্ত আরামদায়ক! কত্ত বৈচিত্র্যময়! কয়েকদিনের তীব্র গরমে প্রাণ যাই যাই অবস্থা। প্রকৃতির একটু ঠান্ডা হাওয়ায় আজ প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। কি শান্তি! ছেলেবেলায় হঠাৎ এ রকম হাওয়া বইতে শুরু করলেই দৌড়ে মাঠে চলে যেতাম। সবাই মিলে কত্ত আনন্দ করতাম! আহা, কি মজার ছিল সেই সব দিন! চোখ মুদে দুবাহু প্রসারিত করে আমরা একসাথে সুরে সুরে গাইতাম-

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ধান দিব মেপে

কেন যে এই ছড়াগান গাইতাম! শহরে জন্ম, শহরেই বেড়ে ওঠা। ধান কোথায় পাব? তবুও সবাই ধান দিতে চাইতাম বৃষ্টিকে। কি হাস্যকর! ইশ আবার যদি ছোট্ট হতে পারতাম!

এই তো টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ ধরনের বৃষ্টিকে ইংরেজিতে বলে drizzling. যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন শিখেছি-

টিপটিপ বৃষ্টিকে বলে-drizzling

ভালোই বৃষ্টিকে বলে-raining a lot

অনেক বৃষ্টিকে বলে-pouring

অনেক বেশি ভারি বৃষ্টিকে বলে-cats and dogs.

রাতের বেলায় স্কুলের পড়া শেষে দুই ভাইবোনকে vocabulary শিখতে হতো। মাদুর পেতে বসে একসঙ্গে শব্দ করে vocabulary শিখতাম। দিনগুলো এখন খুব মিস করি।

এস এস গ্রিলের ভেতর দিয়ে হাত বের করে দিয়েছি। একটু বৃষ্টি ছোঁয়ার জন্য। বৃষ্টির স্পর্শ সত্যি দারুণ! দুহাতে বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে। যেন এ সুখের নেই কোনো সীমানা! এত্ত ভালো লাগে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আসলে, বৃষ্টিকে অনুভব করতে হয়। কারণ সে বড়ই সৌন্দর্যপূর্ণ। যার হৃদয়ে ভালোবাসা আছে কেবল সেই বৃষ্টিকে স্পর্শ করে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য অনুভব করতে চায়। প্রিয়জনের হাত ধরে একসঙ্গে ভিজতে চায়।

দুহাতের আঁজলায় বৃষ্টি ধরছি ঠিক এ সময় আমার একমাত্র মেয়ে এলিস বলল, মাম, আমিও ভিজতে চাই। করপুটে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ছুড়ে ফেলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সে বাচ্চাদের মতো করে বলল, আমিও ভিজব মাম। একগাল হাসির সঙ্গে প্রচণ্ড উৎসাহ মিশিয়ে বললাম, চল, ছাদে যাই।

মুহূর্তেই এলিসের চোখে মায়াবী জোনাকির আলো ঝলক দিয়ে ওঠে। বছরের প্রথম বৃষ্টি বলে কথা! সে এক দৌড়ে ছাদে চলে গেল। ছাদে উঠে দেখি, প্রিয় হলুদ কাঠগোলাপ ফুটে আছে। আমি ফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম সন্তের মতো। এলিস দুবাহু প্রসারিত করে ভিজছে। রহস্যময়ী বৃষ্টির ফোঁটা যেন তাকে সতেজ করে তুলছে অনির্বচনীয় প্রশান্তিতে।

অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে এক সকালে মা আমার রুমে এসে বললেন, খুকু তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তোর বাবার পছন্দের ছেলে। দেখতে ভীষণ সুন্দর, রাজপুত্র যাকে বলে। জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার। আজ তোকে ভার্সিটিতে যেতে হবে না। ওরা তোকে দেখতে আসবে।

আমাদের মা কড়া মেজাজের মানুষ। মায়ের কথার ওপর কেউ কথা বলার সাহস রাখে না। ব্যাংকে চাকরি করতে গিয়ে মা হয়তো একটু অন্য রকম হয়েছেন। বাবা সব সময় মাই ডিয়ার টাইপের। তিনি সবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলেন। কিন্তু মাকে আমরা হাসতে দেখি না, গম্ভীর হয়ে থাকেন। কম কথা বলেন। মাকে আমরা সবাই ভয় করি। তাই মা যখন বিয়ের কথা বললেন, তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও মুখ দিয়ে টুঁ-শব্দ করিনি। বোকার মতো চুপচাপ বসে রইলাম। ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। আমাদের বাড়িতে কেউ কাঁদতে পারত না। মায়ের এক কথা, হাসবে কিন্তু কাঁদবে না। কান্না পেলে আমরা দুই ভাইবোন ওয়াশরুমে গিয়ে কাঁদতাম। কাউকে বুঝতে দিতাম না। খুব ছোটবেলা থেকে আমরা দুঃখ-কষ্টকে লুকিয়ে রাখতে শিখেছি, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি। সবই মায়ের কারণে সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাবা ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ। আমি যখন জ্বরে শুয়ে থাকতাম, খেতে পারতাম না, তখন বাবা আমার মাথায় পানি ঢালতেন আর চোখ মুছতেন। নিজ হাতে মুরগির স্যুপ রান্না করে আমাকে মুখে তুলে খাওয়াতেন। আমার পছন্দের কলিজার সিঙাড়া কিনে আনতেন। কিন্তু সেসব খেতে পারতাম না। সব কিছু তিতা লাগত। বাবা তখন বাটার আর জেলি দিয়ে ব্রেড মেখে দিতেন, তাও খেতে পারতাম না, তিতা স্বাদের জন্য। সে সময় প্রতি বছর একবার-দুবার জ্বর হতো। আর বাবা অনেক সেবা-যত্ন করতেন।

খালা, চাচি, নানি-দাদি সবাই মিলে রান্নার আয়োজন করছেন। ঘরোয়া আয়োজন আর কি! সবাই খুব আনন্দের সঙ্গে কাজ করছে, হাসি তামাশা করছে, কেবল আমার মন খারাপ। কেন যেন ভেতর থেকে শান্তি নেই। মনমরা মনমরা লাগছিল। বিকালে বাবা আমার কাছে এসে বললেন, খুকু, তোর মন খারাপ কেন? কী হয়েছে? আমি কিছুই বললাম না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললাম শব্দ করে। বাবা, আমার মাথায় হাত রেখে বললেন মারে, ছেলেটা দেখতে সুন্দর। তা ছাড়া মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, টাকা-পয়সার অভাব হবে না। তুই সুখেই থাকবি।

চোখের পানি ফেলে বললাম, তাই বলে যাকে দেখলাম না, জানলাম না তাকে হুট করে বিয়ে করতে হবে !

খুকু, অমত করিস না। ওরা তোকে বিশ ভরি সোনার গহনা দিচ্ছে, আমিও তোর জন্য বিশ ভরির গহনা কিনে রেখেছি। তা ছাড়া মনিরুল দেখতে খুব সুন্দর আর স্মার্ট। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না, এই রকম রাজপুত্র আমার জামাতা হবে!

বিউটিশিয়ান এসে তিন ঘণ্টা ধরে সাজালো আমাকে। উহঃ জীবনের প্রথম সেদিন ভ্রু প্লাগ করতে গিয়ে চোখে পানি চলে এসেছিল। অনেক ব্যথা পাচ্ছিলাম। বিউটিশিয়ান মেয়েটা হেসে বলল, আপা এই তো শুরু! বিয়ের দিন থেকেই কান্না শুরু হয়ে যায় রে আপা, হায় রে নারী জীবন!

সেজেগুজে বসে আছি এমন সময় আমার একমাত্র ভাই রাফি এসে বলল, আপু রে ছেলে তো পুরাই নায়ক! এত্ত সুন্দর নায়ক আমার দুলাভাই হবে! সত্যি খুব আনন্দ লাগলছে! বলেই রাফি দৌড়ে চলে গেল। রাফির কথা শুনে আমার বুকের ভেতরে হঠাৎ কেমন যেন ধুক করে উঠল। একটা অজানা ভয় এসে মনের ভেতরে কুটকুট করতে থাকল। বিয়ে করতে ইচ্ছা করছে না। ভয় ভয় লাগছে কেমন যেন।

সে রাতেই বিয়ে হয়ে গেল। বাসরঘরে রাজপুত্রকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মন বলল, এই ছেলে তো থাকবে না। এত্ত সুন্দর পুরুষ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটা অস্থিরতায় ডুবে গেলাম।

সকালে ঘুম ভাঙল সবার ডাকাডাকিতে। খুকু, খুকুমণি। এই খুকুমণি। দাদিমা গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললেন, কী কালের ঘুম ঘুমাইছ বুবু?

আমি চোখ ডলতে ডলতে বললাম, কী হয়েছে?

দাদিমা কান্না করতে করতে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে রে বুবু! সর্বনাশ হয়েছে!

আমার মেয়ে হয়েছে আমার মতো খিচুড়িপাগল। বৃষ্টি এলেই সে খিচুড়ি খেতে চাইবে, সঙ্গে থাকতে হবে বেগুন ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, মাছ ভাজা, অথবা ডিম ভাজা। আজ খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করছি দেখে সে বলল, মাম, আজ তো শুক্রবার, একটু গরুর মাংস রান্না করবে? খেতে ইচ্ছা করছে। তোমার হাতের ভুনা মাংস উহঃ কি যে দারুণ! এলিস আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি হচ্ছ, এ দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো শেফ। একেবারে সেরা রাঁধুনি। সেরা মাম।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, হয়েছে। আর তেল দিতে হবে না।

মাম, আজ আমি মাংস ভুনা করি?

ওকে। খুব ভালো কথা।

আমার খিচুড়ি রান্না শেষ হলে জেসমিন বুয়াকে বললাম, ভর্তা তৈরি করতে। জেসমিন বুয়া শুঁটকি ভর্তা আর টমেটো ভর্তা করে দিল। এলিস খুব আগ্রহ নিয়ে রান্না করছে। বুয়া তাকে সাহায্য করছে। দূর থেকে আমার মেয়েকে দেখছি। কি মনোযোগ দিয়ে সে রান্না করছে! মাশাআল্লাহ আমার মেয়েটা এত লক্ষ্মী হয়েছে। এত সুন্দরী হয়েছে! কোথাও ঘুরতে গেলে অথবা শপিংমলে গেলে সবাই যখন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ড্যাবড্যাব চোখে, তখন ভয় হয়। কিন্তু যখন সবাই বলে আমার মেয়েটা দেখতে নাকি আমার মতো হয়েছে, তখন ভালো অনুভব করি। গদগদ কণ্ঠে বলি, আমার মেয়ে তো আমার মতোই হবে তাই না?

পুরো বাড়িতে গরুর মাংসের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে গেছে। এ যেন মৌতাত ছড়ান ঘ্রাণ! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। পেট বলছে, কখন খাব, কখন রান্না শেষ হবে? জিহ্বা বলছে, কষা মাংস একটু চেখে দেখ, লবণ হয়েছে কিনা?

আমি যখন মুরগি অথবা গরুর মাংস রান্না করতে শুরু করি তখন থেকেই এলিস রান্নাঘরে ঘুরঘুর করে আর বলতে থাকে, মাম, আর কতক্ষণ?

মাত্র শুরু করলাম,

একটু পরে আবারও বলবে, রান্না হয়েছে?

না সোনা, মাংস সিদ্ধ হতে সময় লাগবে।

কতক্ষণ লাগবে?

এই তো বিশ পঁচিশ মিনিট।

ওহহ মাম, প্রেসারকুকারে দিতে পারতে! তাহলে; তাড়াতাড়ি খেতে পারতাম।

আজ এলিস যত্ন করে টেবিল সাজিয়েছে। সুন্দর করে সালাদ করেছে। গাজর কেটে দুটো পাখির ছানা বানিয়ে সালাদের ওপরে ডেকোরেশন করেছে। দেখতে ভালো লাগছে। আমার মেয়েটা এত কিছু কবে শিখেছে? সেই দিনের এলিস এতটা বড় হলো কবে? আনন্দে আমার চোখে পানি চলে আসছে।

সেদিন দুপুরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশ যেন হাত-পা এলিয়ে দিয়ে মুষলধারে নামছিল পৃথিবীতে। একটানা ঝরে পড়ার সেই শব্দে ছিল নেশাধরা নৃত্যের সুর; রিমঝিম, রিমঝিম, রিমঝিম। অন্য রকম বিরতিহীন এক ভালো লাগা এসে ভর করে হৃদয় দুয়ারে। তন্ময় হয়ে শুনছিলাম বৃষ্টির গান। ঠিক সেই সময় কান্নার শব্দ শুনতে পাই। বাচ্চার কান্না! বৃষ্টির সুরের ভেতরে হঠাৎ বাচ্চার কান্নাটা কেমন যেন ছন্দপতন এনে দিল। আমি কান পেতে রইলাম। ঠিক তখনই আবার কান্নার শব্দ ভেসে এলো। মনে হলো আমার বাড়ির আশপাশেই। মনটা আর স্থির রাখতে পারলাম না। প্রধান দরজায় চলে গেলাম এক দৌড়ে। দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলাম। আনুমানিক দুবছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা কান্না করছে। কী আশ্চর্য! এ কোথা থেকে এলো? আশপাশে কেউ নেই। অনেক খুঁজেও ওর বাবা-মাকে পেলাম না। এত্ত সুন্দর একটা শিশু! দেখলেই বুকের ভেতরে কেমন যেন চিনচিন করে ওঠে। আপন আপন লাগে। এমন ডজনখানেক বাচ্চা যদি আমার ঘরে থাকত! যদি সত্যি সত্যি অনেক বাচ্চার জন্মদায়িনী মা হতে পারতাম! তাহলে কতই না ভালো হতো! হায়রে নিয়তি! বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সেই দীর্ঘশ্বাস ঝেড়ে ফেলে শিশুটিকে পরম মমতায় কোলে তুলে নিলাম। আদর করে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম, আর কান্না করতে হবে না সোনা। সোনাবাবু আমার। ওর জামার সঙ্গে একটা সেফটিপিনে আটকানো ছোট্ট চিরকুট পেলাম। তাতে লেখা, দয়া করে আমার মেয়েকে নিজের করে নিন। আমার ব্লাড ক্যানসার। হাতে আর সময় নেই।

চিরকুটটা অনেকবার পড়েছি। অনেকভাবে বিশ্লেষণ করেছি আর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রেখেছি সাবধানে। দুদিন পর ছিল কুরবানির ঈদ। কেয়ারটেকারকে দিয়ে একটা ছাগল কিনে আকিকা দিয়ে মেয়ের নাম রাখলাম, এলিস। দুবছরের এলিস সারাক্ষণ কান্না করত। তবে বাইরে ঘুরতে নিলে চুপ করে থাকত। আমি স্কুল থেকে ফিরে এলে আমার দিকে দু-হাত উঁচু করে মা মা করত। কোলে নিলে সে বুকের ভেতরে মাথা গুঁজে দিত আরাম করে। চুমু খেলে সে খুব খুশি হতো। খিলখিল করে হাসত। অনেক যত্নে তাকে বড় করেছি। তার জন্ম পরিচয় জানি না। তবে সে কাগজে কলমে আক্ষরিকভাবেই আমার মেয়ে। আমাদের মেয়ে। একজন অতিসাধারণ স্কুল শিক্ষিকার মেয়ে। মেয়ে আমার মেধাবী। পড়ালেখায় যেমন ভালো, তেমন ভালো আঁকিয়ে। দারুণ দারুণ ছবি এঁকেছে। ওর সব সুন্দর ছবিগুলো বাঁধাই করে দেওয়ালে সাজিয়ে রেখেছি।

আজ চমৎকার পূর্ণিমা। ব্যালকনিতে বসে চাঁদের রূপ দেখছি। কি সুন্দর! এটা মে মাস। এই পূর্ণিমাকে বলা হয় ফ্লাওয়ার মুন। বাংলায় বলে, বৈশাখী পূর্ণিমা। তবে এ পুণ্য তিথিতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক ভগবান বুদ্ধ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। তিনি এ তিথিতেই বোধি লাভ করেন এবং নির্বাণও লাভ করেন বলে এ পূর্ণিমাকে বুদ্ধপূর্ণিমাও বলা হয়। সে যাকগে! পূর্ণিমা সব সময় সুন্দর। অসম্ভব সুন্দর!

ইজি চেয়ারে দুলে দুলে পূর্ণিমা দেখার ভেতরে অন্য রকম আনন্দ আছে। আমি দুলছি আর কেমন যেন পিনিক পিনিক ফিল করছি। চাঁদের রূপেও এমন পিনিক পিনিক লাগে!

এলিস এসে পেছন থেকে আমার ইজিচেয়ারে দোল দিতে থাকে। কিন্তু কিচ্ছু বলে না। একটু অবাক হলাম, গপ্পু মেয়েটা হঠাৎ চুপচাপ! আমি বললাম, সোনামা কি হয়েছে?

কিচ্ছু না।

কিন্তু আমার মায়ের তো মুড অফ!

সঙ্গে সঙ্গে এলিস সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, আমার পা জড়িয়ে ধরে বলল, মাম তোমাকে একটা প্রশ্ন করি? আমি এলিসের চোখের দিকে তাকালাম। তার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শান্ত কণ্ঠে বললাম, অবশ্যই। কী বলতে চাও?

সে উদ্বেগ নিয়ে বলল, মাম, বাবার সঙ্গে তোমার শুধু বিয়ের দিনের ছবি। আর কোনো ছবি নেই কেন? এবং আমারও ছোট্টকালের কোনো ছবি নেই, কেন মাম?

এলিসের প্রশ্ন শুনে কেমন যেন মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। ঝিম মেরে বসে রইলাম কিছু সময়। তারপর ওকে বুকে টেনে আদর করে বললাম, তোমার ছোট্টকালের ছবি এবং আমাদের দাম্পত্য জীবনের সব ছবি দুটো অ্যালবামে সাজানো ছিল। জাহাজে ওঠার সময় তোমার বাবা অ্যালবাম দুটো নিয়ে যায়, তোমাকে সে ভীষণ ভালোবাসত। কে জানত সে আর ফিরবে না, চিরদিনের জন্য সাগরের বুকে হারিয়ে যাবে? হারিয়ে যাবে আমাদের জীবনের সব স্মৃতি?

মিথ্যা বলতে বলতে আমার চোখ গলে পানি ঝরতে লাগল। আমি মনে মনে আল্লাহকে বললাম, আমাকে ক্ষমা করে দিন দয়াময়। সত্যিটা মেয়েকে বলতে পারলাম না। সত্যিটা মেয়ে জানতে পারলে তার জীবন এলোমেলো হয়ে যাবে। তা ছাড়া মেয়েকে কী করে বলি যে, আমার স্বামী বাসররাতে চল্লিশ ভরি সোনার গহনা নিয়ে পালিয়ে গেছে? কী করে বলি, এলিসের বাবা-মা তাকে আমার দরজায় ফেলে রেখে গেছে? কী করে বলি গো আল্লাহ, আমি মন থেকে পুরুষ মানুষকে ঘৃণা করি, অবিশ্বাস করি? আল্লাহ গো, আমাকে ক্ষমা করে দিন সত্যিকে গোপন করার জন্য। মেয়ের সুন্দর জীবন চাই। সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম