সবুজ দ্বীপের মতো : সুফিয়া কামাল
কুদরত-ই-গুল
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ব্যক্তিকে ব্যাখ্যা করতে হলে, তখন ব্যক্তির বেড়ে ওঠা, তার রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের আলোকেই করতে হয়। কারণ ‘ব্যক্তি’ হয়ে জন্মায় না, হয়ে ওঠে। এই হয়ে ওঠার পেছনে নানা বিষয় জড়িত এবং জারিত থাকে। এটা হলো ঐতিহাসিক বাস্তবতা। সুফিয়া কামালও তার বাইরে নন। তার বাল্যজীবন, সাহিত্যিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন এবং সাংগঠনিক জীবন গভীরভাবে পাঠ করলে তার হদিস মেলে।
এ কথা সবার জানা, তিনি জন্মগ্রহণ করেন একটি চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক আধা-সামন্তবাদী সমাজের ভিতরে। ব্যক্তি জীবনের সংগ্রাম, ওই বৈরী পরিবেশে তার ‘বাংলা ভাষা শিক্ষা সংগ্রাম’ ও সেই ভাষায় সাহিত্যের ফুল ফোটানো এবং তা একটা রাষ্ট্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে শেষাবধি টেনে নিয়ে যাওয়া ব্যাপকার্থে বিরলই বটে। তার সেই সংগ্রাম শুধু কোন নির্দিষ্ট লেখালেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সে সীমাবদ্ধতার জাল ছিঁড়ে ফেলেছেন সাংস্কৃতিক এবং সাংগঠনিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। মূলত তার এ সাংস্কৃতিক এবং সাংগাঠনিক তৎপরতা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক নানা বাঁক বদলের ভেতর দিয়ে। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন চূড়ান্ত অর্থে সক্রিয়, সজাগ এবং স্বরাট। অনেকে মনে করেন, বেগম সুফিয়া কামাল হলেন বেগম রোকেয়ার বর্ধিত রূপ। কথা সত্য ব্যাপকভাবে মিল থাকলেও বেগম রোকেয়ার সংগ্রাম ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বেগম সুফিয়া কামালের চেয়ে ভিন্ন। এ ভিন্নতায় সুফিয়া কামাল কীভাবে ‘খালাম্মা সুফিয়া কামাল’, ‘জননী সাহসিকা’ হয়ে উঠলেন তার সুলুক সন্ধান করা দরকার। আমরা জানি, সংস্কৃতি হলো রাজনীতির নির্যাস। আর রাজনৈতিক চেতনা বাহিত সংস্কৃতির ধারা ব্যক্তির মধ্যে ফল্গুর মতো প্রবাহিত হয়। আর যারা সংস্কৃতির ওই ধারাকে চর্চার ভেতর দিয়ে নিয়ে যান, তারা হয়ে ওঠেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সুফিয়া কামাল ওই সংস্কৃতিরই একজন অন্যতম সেবক ছিলেন।
মূলত, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনিবার্যভাবে এ রাষ্ট্রের স্বপ্ন, কুলি, মজুর, কৃষক, ভবঘুরে, রাজনীতিক, কবি, কেরানি, বুদ্ধিজীবী-অবুদ্ধিজীবী সবার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল। সুফিয়া কামালও তার বাইরে ছিলেন না। এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। তিনি দেশ ভাগের বছরেই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন এবং লেখালেখির পাশাপাশি নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু যখন পাকিস্তান তার খোলস ভেঙে ঔপনিবেশিক কায়দায় রাষ্ট্রের মর্যাদা থেকে বাংলা ভাষাকে হটিয়ে দেওয়ার সবরকম পাঁয়তারা করে তখন, সুফিয়া কামাল সোচ্চার হন অধিকার আদায়ের দাবিতে। তিনি ভাষা আন্দোলনের সময় মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিলের আয়োজন করেন, পালন করেন সক্রিয় ভূমিকা। পরবর্তী সময়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে তিনি সমর্থন করলেও তেল ও লবণের দাম বাড়ার প্রতিবাদে সমমনা নারীদের নিয়ে তৎকালীন মন্ত্রী আতাউর রহমান খানের পথ আগলে দাঁড়ান। এমন নজিরও বিরল নয়।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করলে তিনি স্বৈরাচারের নাকের ডগায় থেকে ভয়ভীতি-নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষো করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নেন এবং ছাত্র-সমাজের ওপর হত্যা-নিপীড়নের জন্য পাকিস্তান সরকারের দেওয়া ‘তখমা-ই-পাকিস্তান’ নামক পুরস্কারটি বর্জন করেন।
প্রতাপশালী লৌহ মানবখ্যাত আয়ুব খানের ঔদ্ধত্যের সামনে যখন বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছেন, তখন তিনি হয়েছেন সোচ্চার। আয়ুব খান বাঙালিদের ‘জানোয়ার’-এর সঙ্গে তুলনা করায় ভরা-মজলিসে তিনি মুখের ওপর উচ্চারণ করেছেন সেই কিংবদন্তিতুল্য বাক্য, ‘আপনি তো সেই জানোয়ারদেরই প্রেসিডেন্ট!’ এমন বাক্য উচ্চারণের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা এবং সততার প্রয়োজন হয়; যা তার ছিল। এতে বোঝা যায়, তিনি মোসাহেবিকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সততার কথা উল্লেখ করে আবুল ফজল তার রচিত ‘লেখকের রোজনামচা’ বইয়ে এক দুর্দান্ত বয়ান হাজির করেছেন। তিনি বলছেন, ‘সুফিয়া কবি হিসাবে যত বড় না তার চেয়ে অনেক বড় মানুষ হিসাবে... ব্যক্তিত্ব আর চরিত্রের দিক থেকে। সুফিয়ার বৈশিষ্ট্য আর বড় আকর্ষণ এ ব্যক্তিত্ব আর চরিত্র যা সবদিক দিয়েই অনন্য আর অদ্বিতীয়। দৈহিক অবয়বে ছোটখাটো সুদর্শনা পরম স্নেহশীলা ও কোমল স্বভাবা সুফিয়া যে প্রয়োজনে কতখানি কঠিন হতে পারেন, পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী আর ছাত্রছাত্রীদের কাছে তা অজানা নয়। আয়ুবীয় সামরিক শাসনের জাঁতাকলে অনেক ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবীকেও ভেঙে চুরমার হতে দেখেছি, বহু সংগ্রামী বিপ্লবীকে মাথা নুইয়ে মুচড়ে ত্রিভঙ্গ হতে। প্রলোভনের ইন্দুরকলে ধরা দেয়নি এমন বান্দা কমই ছিল সেদিন। কিন্তু সুফিয়া কামাল থেকেছেন সব সময় উন্নত শির। ঘুস বা ঘুষি কিছুতেই এ ক্ষুদ্রদেহী নম্র স্বভাবা মানুষটাকে নোয়াতে পারেনি। একখানি ক্ষুদ্র কোমল দেহের অন্তরে যে এমন শক্ত এক অদম্য মেরুদণ্ড বিরাজ করছে, তা সত্যিই অকল্পনীয়।’ কেন সুফিয়া কামাল অন্যদের থেকে আলাদা তার বহু কারণ দেখানো যেতে পারে। কিন্তু একটা কারণ উল্লেখ করা জরুরি তা হলো, আমাদের সমাজে বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত ব্যক্তি মানে মোটাদাগে নাক ওঁচা, খুঁতখুঁতে এবং অনেকটা ‘ঠুলি পরা’। এটা সবার জানা, ঠুলি পরে কোনো সমস্যা বোঝা প্রায় অসম্ভব। সমাধান তো ‘দূর কা বাত’। এই ‘ঠুলি পরা’ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের ‘অসহায়’ মানুষের তেমন কোন সংস্রব থাকে না। তাদের সঙ্গে ‘অসহায়’ মানুষের সংশ্লিষ্টতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। সেই সীমাদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি ঝুঁকিকে তোয়াক্কা না করে, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, শিরদাঁড়া খাড়া রেখে ‘অর্গানিক বুদ্ধিজীবিতা’র এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছিলেন। যেখানে তিনি ‘নারীমুক্তি’ সর্বোপরি দেশমুক্তির লড়াইয়ে হয়েছেন সক্রিয় এবং জনতার আদালতে দাঁড়িয়ে করেছেন তাদের পক্ষে ওকালতি। এমনকি দক্ষিণ বঙ্গে জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য নিজে রিলিফ বিতরণ করতে গিয়েছেন। এখানেই তার বুদ্ধিজীবিতার মাহাত্ম্য। প্রশ্ন জাগে, তাহলে এত প্রাণ-প্রাচুর্য তিনি কোথা থেকে পেলেন? এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রকৃত কবিত্ব যাদের আছে, তাদের অনেক কিছুই অস্বীকার করার অপরিমেয় একটা ক্ষমতাও থাকে। তিনি খুব সম্ভবত সেখান থেকে তথাকথিত ক্ষমতাকাঠামোকে অস্বীকার করার শক্তি অর্জন করেছিলেন।
এ ছাড়া তিনি যে বহুমুখী কাজ করার শক্তি অর্জন করেছিলেন তার মধ্যে তার নারীমুক্তি আন্দোলন এক বিরল দৃষ্টান্তই বটে। তিনি নারীদের লেখালেখিকে উৎসাহিত করার জন্য মুসলমানদের প্রথম মহিলা সচিত্র সাপ্তাহিক ‘বেগম পত্রিকা’র সম্পাদক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ‘ইন্ডিয়া উইমেন্স ফেডারেশন’ সংগঠনে প্রথম মুসলিম মহিলা সদস্য হিসাবে মনোনীত হন। দেশভাগের পর মহিলা নেত্রীদের সঙ্গে ‘শান্তি কমিটি’তে যোগদান করেন। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা কমিটির সভানেত্রী নির্বাচিত হন, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাকালীন সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এভাবে জীবনের শেষাবধি তিনি ছিলেন সক্রিয় এবং হয়ে উঠেছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের বাতিঘর।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ এক মহাকাব্যের নাম। সেই মহাকাব্যের একজন অন্যতম চরিত্র সুফিয়া কামাল। তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা লেখার পাশাপাশি ‘একাত্তরের ডায়রী’ লেখেন। যাকে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে সুফিয়া কামালের অবস্থান বোঝার জন্য জীবন্ত এক আকর গ্রন্থ বলা যায়। যার ভূমিকায় বলছেন, ‘ভূমিকা নয়, রক্তে লেখা শোক’। ভূমিকায় এক জায়গায বলছেন, ‘কাঁথা সেলাই করেছি নয় মাসে নয়টি। প্রত্যেকটি ফোঁড় আমার রক্তাক্ত বুকের রক্তে গড়া।’ তাকে অনেকে জীবনের ঝুঁকি আছে বলে চলে যাওয়াই শ্রেয় বললে, তিনি যেতে চাননি অন্য কোথাও। তিনি তার দুই কন্যাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করান। এ ছাড়া যারাই তার শরণাপন্ন হয়েছেন, তাদের অকাতরে সহায়তা করেছেন সাধ্যমতো।
অনেকে বলতে চান সুফিয়া কামাল ‘প্রগতিশীলতা’র নামে নারীদের ঘরের বাইরে আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তার আদর্শ, যাপন, লেখালেখি, সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তা একটি গভীর আর্থ-সমাজিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে। তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে অরুদ্ধ করার পক্ষে কখনো ছিলেন না। ধর্মীয় আচারের বাইরে গিয়ে নয় বরং ধর্মীয় জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন সমানতালে চলবে; তিনি সারা জীবন সেটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সামগ্রিক জীবন পর্যালোচনায় বলা যায়, সুফিয়া কামাল ছিলেন অন্তঃপ্রাণ সংগ্রামী মানুষ। ঘর আর বাহিরকে তিনি আলাদা করতে চাননি। ‘অপরায়ণ’ তার অভিধানে ছিল না। ব্যক্তি জীবনে ছিলেন কোমল, কিন্তু দেশ ও দশের দুর্যোগের প্রশ্নে ছিলেন ক্ষিপ্র। তিনি বাংলাদেশের মানচিত্রে সবুজ দ্বীপের মতো। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে এক অনন্য পোতাশ্রয়। তিনি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হোন এ কামানা করে তাকে তার জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
