সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অন্তহীন অন্বেষণ
রাজীব সরকার
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সৃজনশীল রচনার যে সম্ভাবনা ও বিকাশ দেখা যায়, মননশীল রচনার ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। চিন্তাশীল রচনা তথা মননশীল সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় অনগ্রসর। ইংরেজি, ফারসি, জার্মান বা স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্য সৃজনশীলতা ও মননশীলতা উভয়ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ। এসব পাশ্চাত্য ভাষায় বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, সংস্কৃতি রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে এমন সব বই ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে যা শুধু বিষয়বস্তুর গুণে নয়, রচনাশৈলীর গুণেও সাহিত্য পদবাচ্য। আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্য সেই স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ দেশে মৌলিক চিন্তাসম্পন্ন মননশীল সাহিত্যিক দুর্লভ। সেই দুর্লভ সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তার সাহিত্যচর্চার প্রধান ক্ষেত্র প্রবন্ধ। এর পাশাপাশি তিনি অনুবাদ করেছেন, গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। একাধিক পত্রপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তার সম্পাদনা প্রতিভার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ দুই দশকের বেশি সময় ধরে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘নতুন দিগন্ত।’ একজন সমাজ সচেতন বুদ্ধিজীবী হিসাবেও তিনি সক্রিয়। বিভিন্ন অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহিত্যের ছাত্র। তবে তার মননচর্চার ক্ষেত্র সাহিত্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি এমনকি অর্থনীতি পর্যন্ত তার কৌতূহল বিস্তৃত। লেখক জীবনের শুরু থেকেই সাম্যবাদী জীবনদর্শনের প্রতি তার আনুগত্য। এ দর্শন থেকেই তিনি সমাজদেহের বিভিন্ন রোগের অনুসন্ধান করেন। রোগের কারণ হিসাবে প্রায়ই তিনি শনাক্ত করেন পুঁজিবাদকে। রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি নিয়ে নানা মত থাকতে পারে; কিন্তু রোগ নির্ণয়ে যে তিনি সফল, এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিশ্বাস করেন আন্তর্জাতিকতায়। তিনি জানেন যে, বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অবসান চান তিনি। তিনি মনে করেন মানুষের যথার্থ মুক্তির জন্য এ ব্যবস্থাটিকে উৎপাটিত করতে হবে। তিনি শ্রেণিসচেতন লেখক। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, শেকসপীয়র, টলস্টয়, ইবসেনকে মূল্যায়ন করেন। মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ চন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ বিভিন্ন রাজনীতিবিদ সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন। তাদের কৃতিত্বের পাশাপাশি সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। উদারনীতির সীমা সম্পর্কে তিনি সচেতন। যে কোনো মনীষীর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার মানদণ্ড ব্যবহার করেছেন। এতে কখনো কখনো আলোচ্য মনীষী অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গদ্যশৈলীর অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে যোগাযোগ দক্ষতা। তার গদ্য সহজেই পাঠককে আকর্ষণ করে।
স্বতন্ত্র ভাষাশৈলীর কারণে তার লেখা সহজেই চেনা যায়। গুরুগম্ভীর, গুরুত্বপূর্ণ কিংবা জটিল কোনো বিষয়ের অবতারণা করেন গল্পের ভঙ্গিতে। বলার ভঙ্গি একইসঙ্গে সরল ও সরস। এমনকি শিরোনাম কখনো কখনো কাব্যিক ব্যঞ্জনামণ্ডিত। তার কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম উদাহরণ হিসাবে উল্লিখিত হতে পারে-‘নোরা তুমি যাবে কোথায়’, ‘উন্মুক্ত পথের স্বচ্ছন্দ যাত্রী’ ‘অবনতের আত্মোন্নতি,’ ‘বেকনের মৌমাছিরা’, ‘দুই বাঙালীর লাহোর যাত্রা’, ‘স্বাধীনতার স্পৃহা, সাম্যের ভয়’, ‘কুমুর বন্ধন’, ‘শিরোধার্য যত, হৃদয়গ্রাহ্য ততোধিক’ প্রভৃতি।
পুঁজিবাদ তথা রাষ্ট্রবিরোধিতার অবস্থান থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অধিকাংশ প্রবন্ধ লিখিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগুলো সংকলিত হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ কেন জরুরী’ বইয়ে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে রাষ্ট্র নয়, সমাজই প্রধান-এ কথা রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার বলেছেন। স্বৈরতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার বিভিন্ন সৃষ্টি যেমন উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ সম্পর্কে তিনি সারগর্ভ মতামত উপস্থাপন করেছেন। ‘কুমুর বন্ধন’ প্রবন্ধটি সম্ভবত এ উপন্যাসটি সম্পর্কে আমাদের সাহিত্যে দীর্ঘতম আলোচনা। সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, শিক্ষা, রুচি ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে কুমু যোগ্য হলেও সে পরাভূত হয় ভ্রাতা বিপ্রদাস ও স্বামী মধুসূদনের প্রবলতার কাছে। রবীন্দ্রনাথের এ নায়িকাকে সমাজ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বন্দি করেছে। সামনাসামনি শুধু বন্দিনী নয়, সামাজিক সংস্কারের হাতেও বন্দিনী। প্রবলের কাছে দুর্বলের নিপীড়িত হওয়ার হওয়ার প্রতীক কুমু। ‘গোরা’ উপন্যাস সম্পর্কে লেখকের ভাবনা চিন্তা উদ্দীপক। রবীন্দ্রনাথের নাটক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও বন্ধনের সত্য অসাধারণ নৈপুণ্যে বিশ্লেষণ করেছেন।
শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, অন্যান্য বাঙালি মনীষীদের অবদান পর্যালোচনার সময়ও রাষ্ট্রবিরোধিতার মানদণ্ড ব্যবহার করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ‘বিদ্যাসাগরের কাজ’ প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। বিদ্যাসাগর যে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন অনেক সময় বিস্মৃত হই আমরা। বাংলা গদ্য, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ‘দয়ার সাগর’ হিসাবে তিনি সমগ্র বাঙালি সমাজে দেদীপ্যমান। স্বাধীনচেতা চারিত্রিক দূঢ়তা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লেখক মনে করেন, বাংলা লিখে ও বাংলা গদ্যকে আধুনিক করে বিদ্যাসাগর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিলেন নিজেকে। একটি অগ্রসর বাংলা সাহিত্য তৈরির জন্য তিনি আমৃত্যু লড়াই করেছেন। ইংরেজদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রত্যাখ্যান করে তিনি বিকল্প সাংস্কৃতিক আধিপত্য তৈরি করতে চেয়েছেন।
সাহিত্যের চরিত্র আলোচনায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বরাবরই প্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনেন সমাজ ও রাজনীতিকে। শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়, বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এ উদাহরণ দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে তার বিশেষ পক্ষপাত রয়েছে নারী চরিত্রের প্রতি। ‘শেকসপীয়রের মেয়েরা’ তার উল্লেখযোগ্য কাজ। সাহিত্যের নায়িকা চরিত্র নিয়ে এ ধরনের বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ‘নোরা, তুমি যাবে কোথায়’ প্রবন্ধে ইবসেনের নোরার সঙ্গে তিনি তুলনা করেন বঙ্কিমচন্দ্রের সূর্য্যমুখী, রবীন্দ্রনাথের কুমু ও মৃণালের। দুই ভিন্ন পরিবেশ ও সংস্কৃতির নারীর মধ্যে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেন তিনি। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ফলে ঈশ্বরের স্থানে মানুষ অধিষ্ঠিত হয় মূল্যবোধের কেন্দ্রে। বুর্জোয়া বিকাশ ঘটে ইউরোপে, ব্যক্তিস্বাধীনতা আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। নোরা সেই বোধেরই প্রতিনিধি। তার জগৎ মানুষকেন্দ্রিক, ঈশ্বরকেন্দ্রিক নয়। এ ইহজাগতিক পৃথিবীতে নারী যে পুতুল হয়ে রয়েছে এ সত্য ধরা পড়ে যায় নোরার কাছে। স্বামীর ঘর ছেড়ে সে বেরিয়ে যায় গভীর রাতে। কিন্তু গৃহত্যাগ তাকে মুক্তি দেয় না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অন্বেষণের অন্যতম ক্ষেত্র সংস্কৃতি। এ বিষয়ে নানা সময়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। সংস্কৃতি ও স্বাধীনতাকে তিনি পরিপূরক মনে করেন। সংস্কৃতির বিকাশ ও পরাধীনতা পরস্পরবিরোধী। সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য যে মূল্যবোধ ও আত্মপ্রকাশ প্রয়োজন তা স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়। সংস্কৃতিসেবীদের মনে স্বাধীনতার অনুপস্থিতি সংকট বৃদ্ধি করে। দারিদ্র্য নিঃসন্দেহে এ দেশের বড় সমস্যা। কিন্তু দৈন্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, চিন্তার ক্ষেত্রেও। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তথা আদর্শ সংস্কৃতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
পুঁজিবাদের প্রতি অনাস্থা এবং সমাজতন্ত্রে গভীর আস্থাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মূল কথা। শুধু নোরার ক্ষেত্রে নয়, মানুষ মাত্রেরই মুক্তির বড় প্রতিবন্ধক হিসাবে তিনি গণ্য করেন পুঁজিবাদকে। সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কিত প্রবন্ধে এ মতামতই বারবার ব্যক্ত করেছেন। শুধু জাতীয় জীবনে নয়, বৈশ্বিক পরিসরেও মানুষের বিকাশের পথে অন্তরায় পুঁজিবাদ। ‘বাঙালীকে কে বাঁচাবে’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন-
‘বাংলা ভাষা ও বাঙালির বর্তমান দুর্দশার কারণ এক ও অভিন্ন। সে হচ্ছে পুঁজিবাদ। বাংলাদেশ পাকিস্তানি শাসকদের বন্ধন ছিন্ন করেছে ঠিকই, কিন্তু পুঁজিবাদের শাসন ছিন্ন করতে পারেনি। ওই বন্ধন দৃঢ়তর হয়েছে। পুঁজিবাদ অর্থনৈতিকভাবে আমাদের স্বাধীন হতে দিচ্ছে না। আর সেই পরাধীনতা সর্বক্ষেত্রেই প্রতিফলিত, ভাষার ব্যবহারে তার ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। পুঁজিবাদই আমাদের অবাঙালি করছে। শিক্ষিতদের বাংলা ভুলিয়ে ছাড়ছে, অশিক্ষিতদের বাংলা শিখতে দিচ্ছে না। বাংলাদেশে এখন ধনীরা বাংলা ব্যবহার করে না, গরিবেরা ব্যবহার করতে পারে না, বাংলা আছে শুধু উপায়হীন মধ্যবিত্তের জীবনে, যে মধ্যবিত্ত সর্বক্ষণ ধনী হবার স্বপ্ন দেখে এবং ধনী হতে না পেরে গ্লানিতে ভোগে। বাংলা বুঝি ব্যর্থ মানুষদের ভাষা।’
জনগণের মুক্তির জন্য রাজনীতি ও সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বিভিন্ন প্রবন্ধে বলেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এর পাশাপাশি বলেছেন ঐক্যের কথা। ঐক্য গড়ে ওঠার প্রবল প্রতিপক্ষ শ্রেণি ব্যবধান। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব বিদ্যমান-এ সত্যকে অস্বীকার করার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে। রাজনীতির মতো নিরস বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে গিয়েও তার সাবলীলতা ও সরসতা মুগ্ধ করে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সারস্বত জীবন সাধনার অন্যতম লক্ষ্য সামাজিক পরিবর্তন। এ আকাঙ্ক্ষা তার প্রত্যেক প্রবন্ধেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি আধুনিকতার মূল্যায়ন করেছেন। আধুনিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত হয়েও অনেকে চিন্তা-চেতনায় প্রতিক্রিয়াশীল থেকে যান। চিকিৎসক, প্রকৌশলী থেকে শুরু করে এমন পেশাজীবী বহু পাওয়া যায় যারা ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের ধারক। বিজ্ঞান পড়লেই বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যায় না। কিন্তু প্রগতির অভিমুখ বরাবরই সামনের দিকে। তিনি বিশ্বাস করেন, আধুনিকতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিশীলতা। আধুনিকতার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলতার উপাদান থাকতে পারে। অন্যদিকে প্রগতিশীলতার প্রকৃত ভিত্তি ও যথার্থ লক্ষণ সামাজিক পরিবর্তন। পুরাতন সামাজিক সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার ভূমিকাই প্রগতিশীলতার প্রধান কাজ। আধুনিকতা এ দায়িত্ব থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে। এর ফলে আধুনিকতা ক্ষতিকর হতে পারে আমাদের পক্ষে-নিশ্চল ও স্থূল গ্রাম্যতার মতোই, হয়তো তার চেয়ে বেশিই। আধুনিকতার ছদ্মবেশে প্রতিক্রিয়াশীলতা গ্রাস করতে পারে সমাজকে। তিনি মনে করেন, গ্রাম্যতাকে গ্রাম্যতা বলে চিনে নেওয়া যত সহজ, ঠিক ততটাই যতটা কঠিন আধুনিকতাকে আলাদা করে নেওয়া প্রগতিশীলতা থেকে, অথবা চিনে নেওয়া তার অন্তর্গত প্রতিক্রিয়াশীলতাকে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্যচর্চার উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে রয়েছে জাতীয়তাবাদ। ‘জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন’, ‘জাতীয়তাবাদের স্বভাব-চরিত্র’ এ বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে তার আলোচিত বই ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি।’ ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’ বইয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখিয়েছেন জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম সমার্থক নয়। তাত্ত্বিকভাবে জাতীয়তাবাদ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণিবিভাজন কীভাবে বাঙালির মধ্যে অনৈক্যের জন্ম দিয়েছিল তার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। ভাষাই ছিল বাঙালির জন্য ঐক্যের ভিত্তি। অর্থনীতি বাঙালিকে এক করতে পারেনি, বিভক্ত করেছে পরস্পরবিরোধী শ্রেণিতে। এর পরিণতিতেই রাজনৈতিক বিভক্তি ঘটে। এই ভূখণ্ডে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে ইংরেজ আগমনের পর থেকে। এখান থেকেই বইয়ের বিষয়বস্তুর সূত্রপাত, সমাপ্তি ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর বিশেষ লগ্নের ঘটনাপ্রবাহে।
‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ বইটি লেখকের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসল। ১৯০৫-১৯৪৭ কালপর্বকে ধারণ করে লিখিত হয়েছে এ বই। এটি কোনো প্রথাগত ইতিহাসের বই নয়, ঘটনার বিবরণ মাত্র নয়। এক নির্মোহ অনুসন্ধানী দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন চার দশকের উত্তাল সময়কে। এ সময়ের নায়ক, খলনায়কদের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে ধরেছেন তার সহজাত সাবলীল ভাষায়। বিংশ শতাব্দীর এ ঘটনাবহুল পর্বে সমাজ ও রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিল সাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অনৈক্য ও বিদ্বেষ সাম্প্রদায়িকতার পথকে সুগম করে।
এ বইয়ের নানা পরিচ্ছেদে জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন তিনি। জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা ছিল, কিন্তু তাদের ভয় ছিল সাম্যের। জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন সময়ে সাম্প্র্রদায়িকতার রূপ পরিগ্রহ করেছে। জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আধিপত্যে জনগণের মুক্তির প্রশ্নটি আড়ালে চলে গেছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে জাতীয়তাবাদের ব্যর্থতা গণমানুষের মুক্তির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।
যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ব্যক্তিত্বের অন্যতম বিশেষত্ব। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রথম প্রবন্ধের বই ‘অন্বেষণ’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সাল থেকে ২০২৫-ছয় দশকের বর্ণাঢ্য লেখক জীবনে তার অন্বেষণ থেমে থাকেনি। তিনি অন্বেষণ করেছেন মানুষের মুক্তির, এ পথে প্রধান বাধা হিসাবে দেখেছেন পুঁজিবাদকে। বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সামাজিক বিপ্লবের গুরুত্বের কথা। সংগঠন ও সমাজবিপ্লবই পারে পুঁজিবাদকে প্রতিহত করে শ্রেণি ব্যবধানকে ঘুচিয়ে দিতে। এভাবেই সমষ্টিগত মুক্তির পথ অবারিত হতে পারে। এ লক্ষ্যে আজও অন্তহীন তার অন্বেষণ। তার একটি সাম্প্রতিক বইয়ের শিরোনাম ‘স্বপ্ন ছিল, থাকবেও’। জীবনের শেষ লগ্নে রচিত ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। এ উপলব্ধির অনুরণন দেখি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মধ্যেও। তিনি বিশ্বাস করেন, স্বপ্ন আছে বলেই আমাদের অস্তিত্ব আছে। স্বপ্ন বলে যে, মানুষের মনুষ্যত্ব অপরাজেয়।
