Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

রাষ্ট্র ও টেক্সটের দ্বন্দ্ব-সংলাপ

Icon

সুহৃদ সাদিক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাফাত আলমের ‘বাংলাদেশ পাঠ : সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার অনুষঙ্গে’ গ্রন্থটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ-পদ্ধতির রূপরেখা তৈরি করে। গ্রন্থটি ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে, ‘বাংলাদেশ’কে আধেয় করে রচিত টেক্সটে নিহিত ক্ষমতাগত সংঘাত, দ্বন্দ্ব, প্রতিরোধ ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ধারাবাহিকতা অনুধাবনের পঠনভিত্তিক কেতা তুলে ধরে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত আদর্শ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সীমাহীন সম্ভাবনা, পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম ও ধাপে ধাপে তার বিস্তার এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ গঠনের দীর্ঘ পথপরিক্রমা-এই প্রতিটি বিষয়ই যুক্তিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে গ্রন্থটির প্রবন্ধগুলোয় চিত্রিত হয়েছে। এ লেখাগুলোতে ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং ভাষা-চেতনার দ্বন্দ্বময় সম্পর্ক উঠে এসেছে প্রাঞ্জল ও বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে। ফলে বইটি নিছক একটি সাহিত্য-সমালোচনা নয়, বরং বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের গতিপ্রকৃতি অনুধাবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সোর্স। পাঠক এতে সাহিত্য ও ইতিহাসের সংলাপের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও জাতিসত্তার গভীর অন্তর্গত গতিবিধি অনুভব করতে পারবেন।

গ্রন্থটিতে সংকলিত ১২টি প্রবন্ধের প্রতিটিতেই ‘বাংলাদেশ’ কেবল শিরোনামে নয়, ধারণাগতভাবেও উপস্থিত। প্রতিটি রচনায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ঘটনাপরম্পরা অনিবার্য উপাদান হিসাবে যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একটি মৌলিক ও দিকনির্ধারক অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিল পূর্ববাংলার জনমানুষের অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও এক ধরনের রাজনৈতিক মোহ। কিন্তু অচিরেই ঘটে মোহভঙ্গ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমনমূলক শাসন, সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যার শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’। এ আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ছিল না, বরং এটি সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের জন্য এক ঐতিহাসিক লড়াই। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন : সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার অনুষঙ্গে ইতিহাসের পুনঃপাঠ’ শীর্ষক প্রবন্ধে রাফাত প্রচলিত ইতিহাসের কাঠামো অতিক্রম করে আন্দোলনের পটভূমিতে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতার অন্তর্নিহিত ভূমিকা অন্বেষণ করেছেন। প্রবন্ধটি ভাষা আন্দোলনের ভিন্নতর পাঠ উন্মোচনের মাধ্যমে ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ত্রিমাত্রিক সংলাপ রচনায় সক্ষম হয়েছে।

গ্রন্থটির অন্তর্ভুক্ত ‘পাঠ্যপুস্তকে নজরুল : রাষ্ট্রের চোখে নজরুল-পাঠ (বাংলাদেশ ২০২২)’ এবং ‘আল মাহমুদের প্রবন্ধে বাংলাদেশের পাঠ ও পাঠান্তর’ প্রবন্ধদ্বয়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক উন্মোচিত হয়েছে। লেখক বিশ্লেষণ করেছেন, রাষ্ট্রীয় পাঠ্যপুস্তক কেবল শিক্ষার মাধ্যম নয়, বরং ইতিহাস ও জাতিসত্তা নির্মাণের এক কৌশলগত প্রক্রিয়া। সে অর্থে নজরুলকে রাষ্ট্র কীভাবে উপস্থাপন করতে চায় বা করেছে, তার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতা এবং মানবিক রাজনৈতিক বয়ান কীভাবে পাঠ্যপুস্তকে রূপান্তরিত হয়েছে, তা লেখক গভীর অনুসন্ধিৎসায় তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে, আল মাহমুদের গদ্য ও প্রবন্ধে যে ‘আমার’ বা ‘আমাদের’ বোধ প্রকাশ পেয়েছে, তা রাষ্ট্র ও জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক, ভূখণ্ড ও চেতনার এক ভিন্নপাঠ গড়ে তোলে। আল মাহমুদের দৃষ্টিভঙ্গি মূলধারার জাতীয়তাবাদী বয়ান থেকে আলাদা, যা তাকে এক স্বতন্ত্র ও নিঃসঙ্গ কণ্ঠস্বর হিসাবে প্রতিপন্ন করে। রাফাত আলম লিখেছেন : ‘আল মাহমুদের দৃষ্টিতে ও সৃষ্টিতে বাংলাদেশের পাঠ কেবল পাঠের মধ্যে সীমায়িত থাকে না; জাতীয়তাবাদী হেজিমনির সাপেক্ষে পাঠান্তরভুক্ত হয়ে যায়।’ এ দুই প্রবন্ধে পরিষ্কার দেখা যায়, সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বদের ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও জাতির সাংস্কৃতিক প্রকৃতি ও রূপান্তর বিশ্লেষণ সম্ভব।

‘বাংলাদেশ পাঠ : সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার অনুষঙ্গে’ গ্রন্থটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক দীর্ঘ ও বহুস্তরিক অভিযাত্রার অনুসন্ধান। ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের জনমানস, তাদের আকাঙ্ক্ষা, প্রতিরোধ ও আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম এতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। গ্রন্থটির আয়োজনে লেখকের এ রাষ্ট্রের চেতনাগত ও কাঠামোগত উন্নতির পেছনে একটি মানবিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। যারা মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণে মানুষের জাগরণে আস্থা রাখেন, তাদের জন্য বইটি চিন্তার খোরাক জোগাবে ও প্রাসঙ্গিক পাঠ হিসাবে কাজে লাগবে। বাংলাদেশ পাঠ : সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার অনুষঙ্গে : রাফাত আলম । প্রকাশনা : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। মূল্য : ৬০০।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম