Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

হাসান হাফিজের কবিতা

প্রেম ও সৌন্দর্যের শৈল্পিক রূপায়ণ

Icon

মর্তুজা হাসান সৈকত

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সত্তরের অগণন কবির বর্ণিল নাম থেকে অল্প কিছু নাম বেছে নিতে হলেও কবি হাসান হাফিজের নাম অবলীলায় চলে আসে। সময়ের প্রবহমানতায় তিনি যেমন বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবির তালিকায় নিজেকে অনিবার্য করেছেন একইভাবে এ দশকে আবির্ভূত হওয়া অন্যসব কবিদের চেয়ে নিজেকে আলাদা করে তুলেছেন। এর কারণ হচ্ছে-হাসান হাফিজ ভাষা ও প্রকরণের একটি নির্দিষ্ট ঘরানায় তার কবিতাকে আটকে রাখেননি। ছন্দবদ্ধ, ছন্দহীন, গদ্যঢং; সব রকমের কাব্য প্রচেষ্টাতেই তিনি নিজেকে বহুমুখী করে তুলেছেন। পাঁচ দশকেরও অধিককাল ধরে কবিতার পথে হেঁটে হেঁটে তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক কবিতার ভুবন।

সাহিত্যের পথে হাসান হাফিজ মূলত কবিতার প্রেমে মগ্ন হতে চাওয়া মানুষ। প্রেম এবং বিরহ তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। সৃষ্টির প্রেরণা তিনি খুঁজে পান প্রেমে, পরে তা ছড়িয়ে দেন তার পাঠকের মাঝে। তবে এই প্রেম কেবল নারী-পুরুষের প্রেম নয়, আরও অনেক বড়। এই প্রেম মানবিক প্রেম, এই প্রেম স্বদেশে প্রেম। প্রেমের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা তার পাঠককে কেবল আলোড়িতই করে না, করে ঋদ্ধ এবং আত্মসচেতন।

হাসান হাফিজ তার ‘শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থে পাঠককে নিয়ে যান এক চিত্রকল্পের ভেতর। চিত্রকল্প নির্মাণ করতে গিয়ে কবি সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ব্যবহৃত শব্দগুলো থেকেই শব্দ বেছে নিয়েছেন। উপমার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই গড়ে তুলেছেন কবিতার কলেবর। দৃশ্যের বর্ণনায়, চিত্রকল্পের বর্ণনায় মুনশিয়ানা দেখিয়ে তৈরি করেছেন কাব্যের আখ্যান। তার উপমা, চিত্রকল্প এতটাই হৃদয়গ্রাহী আর জুতসই যে, পাঠক ভুলে যান কখন সে কবিতার অতলে ডুবে গিয়েছিলেন। ‘সমুদ্র পাহাড় তীর্থ তুমিই তো’ এমনই একটি কবিতা। প্রেমিক কবি হাসান হাফিজ এ কবিতায় উচ্চারণ করেন, ‘কষ্ট করে সমুদ্রে যাওয়ার/ কোনো/ প্রয়োজন নেই/ তোমার চোখই হচ্ছে ধরিত্রীর একমাত্র/ ঘনকালো সমুদ্র অথৈ/ ওতে উষ্ণ/ নোনা জল/ নিমজ্জিত বিলীন হওয়ার’

ঘুরপ্যাঁচ পথ হাসান হাফিজের পছন্দ নয়, তার কবিতার একটি অন্য রকম সারল্য আছে। কবিতায় ভাষার গতিময়তা সৃষ্টিতেও কবি বিশেষভাবে পারঙ্গম। কবি বিশ্বাস করেন সহজ স্বচ্ছন্দতায় বিচরণে সক্ষম কবিতা। এ কারণেই, ভাষাকে সহজবোধ্য করেছেন তিনি, কবিতাকে নিয়ে গেছেন সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায়। প্রকৃতপক্ষে হাসান হাফিজ এমন এক বিরল প্রজাতির কবি, যার বলার ভঙ্গি তাকে আলাদা করে দেয়। সমকালীন ভাষাভঙ্গির মধ্যেও এমন এক শব্দের ব্যঞ্জনা তিনি তুলে আনেন, যা তার কবিতাকে করে তুলেছে অনন্য। নান্দনিকতার মূল সুর যদি হয় সৌন্দর্য, সেই সৌন্দর্যের সফল রূপায়ণের এক দক্ষ কারিগর হাসান হাফিজ।

তার কবিতা পড়তে পড়তে আমার বারবার মনে হয়েছে; নস্টালজিয়া, প্রেম-বিরহ, ক্ষোভ-ঘৃণা-দ্রোহ, আত্মদ্বন্দ্ব, ত্যাগ-তিতিক্ষা হাসান হাফিজের কবিতার মূল ভাব। ফলে নারী প্রেমের আনন্দ-বেদনা তার কবিতায় উঠে এসেছে বারবার। কবি যে নারীর ভালোবাসার অমৃত পেয়েছেন কেবল তা নয়, কষ্টের বিষও পান করেছেন। ‘ঘুণ’ কবিতায় তার উচ্চারণ; ‘বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস/দুঃখজাত পরবাস/তবুও তোমার কাছে আসি/বেদনাবর্ণিল মোহে/মৃত্যু ও পতন ভালোবাসি’। অন্যদিকে, বিষের যন্ত্রণায় নীল হয়েও আশ্রয় খুঁজেছেন প্রিয়তমা নারীর আঁচলে। তাকে পেতে চেয়েছেন যে কোনো মূল্যে। ‘আরাধনা’ কবিতায় দয়িতার কাছে কবির এ সমর্পণই ফুটে উঠেছে; ‘শিশির ঝরছে, ঝরো/ঠোঁটে আমার তপ্ত তৃষা/একটু দয়া করো।/রোদ উঠছে, ওঠো/ কাঠচাঁপা ফুল আস্তে আস্তে/ বিকাশমান ফোটে।/ পাপড়ি খুলছে, খোলো-/ আমাকে নাও নিংড়ে খুঁড়ে/ অমর করে তোলো।’

হাসান হাফিজের দেখার দৃষ্টি সরল। সহজতাই তার লেখার প্রাণ। সহজভাবে কী সব সুন্দর কবিতা লিখেছেন তিনি। তার কবিতা পড়তে পড়তে একজন সচেতন পাঠক হিসাবে আমার মনে হয়েছে; হাসান হাফিজ মানুষের জন্য লেখেন। ‘যুগল অন্ধ যুগলবন্দী’ কবিতায় জাত রোমান্টিক কবি উচ্চারণ করেন; ‘হৃদয়-চেরা তন্তু রঙে/ তোমার জন্য তৈরি হলাম/ ভালোবাসার সমুদ্র পাড়/ এলানো এক সিঁড়ি/ ঘাম ঝরানো/ পরিচর্চায়/ তোমাকে ফুল ফোটাই দীপ্র/ হোক না ক্ষণিক আয়ু’

‘হাসান হাফিজের প্রেমের কবিতা’ পাঠ শেষে মনে হয়-অপূর্ব শব্দ বিন্যাসে ব্যক্তিগত শোক-দুঃখ আর ক্ষোভ-অভিমানকে অপরিহার্য শিল্প সত্ত্বায় রূপান্তরিত করেছেন তিনি। আমাদের শুনিয়েছেন; স্বপ্ন ও সুন্দরের গান; শব্দ, বাক্য, অনুভব ও চিত্রকল্পের মুনশিয়ানায় কবিতাকে এমন এক সামগ্রিকতায় বেঁধেছেন, যেখানে পাঠককে আটকা পড়তেই হয়।

শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা : হাসান হাফিজ।

অক্ষর প্রকাশনী। মূল্য : ২৫০ টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম