Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বিশ্ব-সাহিত্যের স্মরণীয় সূচনা বাক্য

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বইয়ের সূচনা বাক্যই স্থির করে দেয় তার গতিপথ। সেটি বইয়ের কেন্দ্রীয় বিষয়টিকে সামনে আনতে পারে, উপন্যাসের বাকি অংশের জন্য একটি নির্দিষ্ট মেজাজ তৈরি করতে পারে, অথবা এমন এক চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে, যে পুরো কাহিনিকে চালনা করবে। একটি বইয়ের সেরা প্রথম বাক্যই পাঠকের অভিজ্ঞতাকে গড়ে তুলতে বা ভেঙে দিতে পারে। পাঠকরা যখন শুরুতেই কোনো বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন, তখন সেই বইটি শেষ পর্যন্ত পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। সর্বোপরি, একটি বইয়ের সেরা সূচনা বাক্য কথককে প্রতিষ্ঠা করে এবং তার দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটি কীভাবে এগোবে তারও ইঙ্গিত দেয়। বিখ্যাত লেখকদের লেখা এই বিখ্যাত সূচনা বাক্যগুলোর তালিকায় তাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিভার নিদর্শন মেলে। যদি একটি বই তার মূল বক্তব্য প্রকাশ করতে খুব বেশি সময় নেয় বা কোনো অপ্রয়োজনীয় বিষয় দিয়ে শুরু হয়, তবে পাঠক আগ্রহ হারান। জেন অস্টেন, টনি মরিসন, সিলভিয়া প্লাথ এবং চার্লস ডিকেন্সের মতো সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের অনেকেই এ ব্যতিক্রমী সূচনা বাক্য লেখার শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছেন। বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন এ তালিকাটি তৈরি করেছে লেখার গুণমান, সাহিত্য সমালোচনায় সূচনা বাক্যটির খ্যাতি, ক্লাসিক উপন্যাসগুলোর দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা এবং বাক্যটি উপন্যাসটিকে কতটা ভালোভাবে উপস্থাপন করে, তার ওপর ভিত্তি করে।

১২. ‘এ এক চিরন্তন সত্য যে, ধনবান অবিবাহিত পুরুষের একজন স্ত্রী চাই-ই চাই।’-প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস, জেন অস্টেন (১৮১৩)।

একগুঁয়ে এলিজাবেথের সঙ্গে সমান একগুঁয়ে মিস্টার ডার্সির ঘুরপথের প্রেমকাহিনি নিয়ে লেখা জেন অস্টেনের এ ক্লাসিক উপন্যাসটি ঊনবিংশ শতাব্দীর বিবাহ সম্পর্কিত একটি চিরসত্য ধারণা দিয়ে চমৎকারভাবে শুরু হয়েছে। অস্টেন এরপর সেই যুগের অনেক নিয়ম ভেঙেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তার ভাগ্যবিড়ম্বিত প্রেমিকযুগলকে ঐতিহ্যের সঙ্গেই এক করেছেন-এবং এভাবেই সেই চিরন্তন সত্যকে প্রমাণ করেছেন। এ বইটি তাদের জন্য সেরা : যারা রোমান্স উপন্যাস ভালোবাসেন।

১১. ‘বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকালের কথা, যেদিন তার বাবা তাকে বরফ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।’-ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (১৯৬৭)।

লাতিন আমেরিকার এ মহাকাব্যিক উপন্যাসের সূচনা বাক্যটি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বইটির প্রধান চরিত্রকে উপস্থাপন করে। শৈশবের স্মৃতিচারণ কর্নেলের সামরিক পদবির কাঠিন্যকে নরম করে দেয়, কিন্তু তার সম্ভাব্য মৃত্যুর দিকে তাকানো শৈশবের বিস্ময় আর পরিণত বয়সের আক্ষেপের মধ্যে এক গভীর খাদ তৈরি করে। এ বই বুয়েন্দিয়া পরিবারের প্রজšে§র পর প্রজšে§র গল্প বলে এবং একাকিত্বের মতো বিষয়কে অন্বেষণ করে। এ বইটি তাদের জন্য সেরা : যারা জাদু বাস্তবতা উপভোগ করেন।

১০. ‘ওরা প্রথমে সাদা চামড়ার মেয়েটিকে গুলি করে।’ -প্যারাডাইস, টনি মরিসন (১৯৯৭)।

সত্যি বলতে, মরিসনের যে কোনো বই-ই এই তালিকায় স্থান পেতে পারত, কিন্তু প্যারাডাইস-এর সূচনাটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। ‘সাদা চামড়ার মেয়েটিকে’ বলার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে, বাকি সবাই ভিন্ন বর্ণের-তাহলে সে সেখানে কেন ছিল এবং আর কাকে গুলি করা হয়েছিল? শ্বেতাঙ্গ আক্রমণকারীদের মুখোমুখি হওয়া একটি ছোট কৃষ্ণাঙ্গ শহরের গল্প সেসব প্রশ্নের এবং আরও অনেক কিছুর উত্তর দেয়। এ বইটি তাদের জন্য সেরা : যারা বর্ণবাদ নিয়ে গভীর ও সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন বই খুঁজছেন।

৯. ‘সব সুখী পরিবার দেখতে একই রকম; প্রত্যেক অসুখী পরিবার নিজের নিজের মতো করে অসুখী।’ - আনা কারেনিনা, লিও তলস্তয় (১৮৭৮)।

একেবারে এক বিশ্বজনীন সত্য। পাঠকের মাতৃভাষা যা-ই হোক না কেন, তিনি এই রুশ লেখকের বক্তব্য বুঝতে পারবেন। তলস্তয় একটি পরকীয়ার গল্প বুনেছেন যা একটি সাধারণ মানের মেলোড্রামা হতে পারত, কিন্তু তার পরিবর্তে এটি ঊনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক রীতিনীতি অন্বেষণ করে এবং একইসঙ্গে সমাজের নিয়ম-কানুন আর ব্যক্তিগত ইচ্ছার টানাপোড়েনকে পরীক্ষা করে। এ বইটি তাদের জন্য সেরা : যারা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা একটি ওজনদার উপন্যাস পড়তে চান।

৮. ‘এক সকালে গ্রেগর সামসা যখন অস্বস্তিকর স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল, সে দেখল বিছানার ওপর সে এক বিশাল পোকায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে।’-মেটামরফোসিস, ফ্রান্ৎস কাফকা (১৯১৫)।

একটি উপন্যাসের মূল ধারণাটিকে এক সংক্ষিপ্ত বাক্যে তুলে ধরার এটিই সম্ভবত শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। গ্রেগর রাতারাতি এক পোকায় পরিণত হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই, যে-কেউই এটা পড়ার পর জানতে চাইবে কেন এমন হলো। মেটামরফোসিস-এর বাকি অংশ ব্যাখ্যা করে, কীভাবে সে এ অবস্থায় পৌঁছাল এবং সে আবার মানব রূপে ফিরতে পারবে কি না। এ বইটি তাদের জন্য সেরা : যারা রূপান্তর (শারীরিক অথবা রূপক) নিয়ে লেখা বই উপভোগ করেন।

৭. ‘এপ্রিলের এক উজ্জ্বল অথচ শীতল দিন, আর ঘড়িগুলোতে তখন তেরোটা বাজছে।’-জর্জ অরওয়েল, ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’ (১৯৪৯)।

এ উদ্বোধনী বাক্যের প্রথম অংশ-বসন্তের এক ঝরঝরে দিন-এবং দ্বিতীয় অংশের-যা আদতে এক অসম্ভব ব্যাপার-মধ্যকার বৈপরীত্য অরওয়েলের দুঃস্বপ্নময় ভবিষ্যতের উপন্যাসটির এক অসামান্য সূচনা ঘটায়। স্পষ্টতই, সে জগতে সবকিছু স্বাভাবিক নয়, যেখানে ‘দ্য পার্টি’ নামক এক শক্তি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এবং এক সাধারণ মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখায়। ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং’-এই বিখ্যাত উক্তিটির উৎস যাদের অজানা, তাদের জন্য এ বই অবশ্যপাঠ্য।

৬. ‘দূরের জাহাজে নাকি সব মানুষের আকাঙ্ক্ষা ভরা থাকে।’-জোরা নিল হার্সটন, ‘দেয়ার আইজ অয়্যার ওয়াচিং গড’ (১৯৩৭)।

নিল হার্সটনের লেখনী যেন এক বিশুদ্ধ কবিতা, আর এই প্রথম বাক্যটি অজানাকে ঘিরে থাকা স্বপ্নময়তাকে অসাধারণভাবে ধারণ করে। যে জিনিস ধরাছোঁয়ার বাইরে, তা যেন কাঙ্ক্ষিত সবকিছু হওয়ার আশ্বাস দেয়; কিন্তু বাস্তবে কোনো ‘জাহাজ’-ই সকলের ইচ্ছেপূরণ করে না। লিঙ্গ ও বর্ণবৈষম্যের এ অসামান্য আখ্যানটি জেনি নামের এক নারীর পথচলার গল্প বলে, যে টি কেক নামের একজনের প্রেমে পড়ে। যারা হারলেম রেনেসাঁস যুগের কোনো ক্লাসিক সাহিত্যকর্মের স্বাদ নিতে চান, এই বই তাদের জন্য এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা হবে।

৫. ‘আমাকে ইসমাইল বলে ডাকুন।’-মবি ডিক, হারম্যান মেলভিল (১৮৫১)।

সাদামাটা, সোজাসাপ্টা ও নিরহংকার-মেলভিলের এ তিমি-সমান বিশাল উপাখ্যানের প্রথম বাক্যটি এভাবেই পরিচয় করিয়ে দেয় এক স্পষ্টভাষী কথকের সঙ্গে। যদিও, পরবর্তী সময়ে বোঝা যায়, এ কথক হয়তো ততটাও নির্ভরযোগ্য নন যতটা প্রথমে মনে হয়েছিল (নইলে সোজাসুজি ‘আমার নাম ইসমাইল’ বললেই তো পারতেন)। তিনি তার ক্যাপ্টেনের সেই বিশাল তিমি ‘মবি ডিক’কে শিকার করার দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা দেন। এ বইটি তাদের জন্য সেরা : যারা সামাজিক ভাষ্য পড়তে ভালোবাসেন এবং তিমি মাছের চর্বি নিয়ে লেখা দীর্ঘ অনুচ্ছেদ পড়তে যাদের আপত্তি নেই।

৪. ‘সেটা ছিল এক অদ্ভুত, গুমোট গ্রীষ্মকাল, যে গ্রীষ্মে রোজেনবার্গদের বৈদ্যুতিক চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, আর আমি জানতাম না নিউইয়র্কে আমি কী করছিলাম।’-দ্য বেল জার, সিলভিয়া প্লাথ (১৯৬৩)।

একটি সফল গল্প বলার অনেকটাই নির্ভর করে তার সময় ও স্থানকে প্রতিষ্ঠা করার ওপর, আর প্লাথ তার উপন্যাসের প্রথম বাক্যেই এ কাজটি অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে করেছেন। লাইনটি কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বা ঠিকানা না দিলেও, তার কাছাকাছি একটা অনুভূতি এনে দেয়। তার এ উপন্যাসটি এক দ্বিধাগ্রস্ত কথকের অবসাদের গভীরে তলিয়ে যাওয়ার কাহিনি বলে, যার আংশিক কারণ ছিল সামাজিক প্রত্যাশার চাপ। যারা কবিতা এবং বিষাদময় অথচ কাব্যিক লেখা ভালোবাসেন এ বইটি তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

৩. ‘সেটা ছিল এক অন্ধকার ঝোড়ো রাত।’-এ রিঙ্কল ইন টাইম, ম্যাডেলিন ল’এঙ্গেল (১৯৬২)।

এ লাইনটি বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেলেও, এর পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। এটি নিখুঁতভাবে এ উপন্যাসের সুর, মেজাজ ও প্রত্যাশা তৈরি করে দেয়, যেখানে এক কিশোরী তার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খুঁজে বের করার অভিযানে নামে। এর সরল সুর এবং সোজাসাপ্টা বর্ণনা (কোনো বাহুল্য ছাড়াই) এমন এক প্রত্যাশা তৈরি করে যা ল’এঙ্গেল পূরণ করেন-এক রোমাঞ্চকর কিন্তু জয়যোগ্য অভিযানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। শিশুসাহিত্যের অনুরাগীদের জন্য এ বইটি অসাধারণ।

২. ‘আমি এক অদৃশ্য মানব।’-ইনভিজিবল ম্যান, র‌্যালফ এলিসন (১৯৫২)।

এলিসনের কথক শুরুতেই সবটা খোলাসা করে দেন। তিনি পাঠককে বলেন যে তিনি অদৃশ্য, এবং শিগ্গির এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই অদৃশ্য হয়ে থাকা আসলে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয়ের এক রূপক। এ নামহীন নায়ক (পাঠকের কাছেও যিনি অদৃশ্য) বর্ণবাদের কারণে পেশাগত সাফল্যের স্বপ্ন পূরণের জন্য সংগ্রাম করে চলেন। যারা জিম ক্রো যুগের আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের কঠোর বাস্তবতা সম্পর্কে পড়তে চান এ বইটি তাদের জন্য সেরা।

১. ‘এটা ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, এটা ছিল নিকৃষ্ট সময়।’-এ টেল অফ টু সিটিজ, চার্লস ডিকেন্স (১৮৫৯)।

ডিকেন্স সম্ভবত সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রারম্ভিক লাইনটি লিখেছেন এ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যে, পরিস্থিতিভেদে দুটো বিপরীতধর্মী জিনিস একইসঙ্গে সত্যি হতে পারে। উপন্যাসটি লন্ডন ও প্যারিসের কয়েকটি পরিবারের দীর্ঘ কাহিনিকে অনুসরণ করে, যারা উত্তাল ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান-পতন, যেমন-ভালোবাসা, বিচ্ছেদ এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পথ চলে। ডিকেন্সের ভক্ত এবং মহাকাব্যিক পারিবারিক আখ্যানের অনুরাগীদের জন্য এ বই অবশ্যপাঠ্য।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম