Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃৎ হামিদুজ্জামান খান

Icon

দেওয়ান সামছুর রহমান

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তখন হামিদুজ্জামান খান চারুকলায় তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এক বিকালে তাকে ডেকে পাঠালেন চারুকলার অধ্যক্ষ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। অধ্যক্ষের রুমে গিয়ে হামিদুজ্জামান জানতে পারলেন, জয়নুল আবেদিন তার কিছু জলরঙের ছবি কিনতে চান। বিষয়টি প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল হামিদুজ্জামানের। কারণ জানতে চাইলে শিল্পাচার্য বললেন, পরদিন বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রাষ্ট্রপতি চারুকলায় আসবেন, তাকে উপহার হিসাবে দেওয়া হবে সেই ছবিগুলো। শুধু এ খবরই নয়, স্যার জানালেন তিনি হামিদুজ্জামানের জলরঙের কাজগুলো ‘অসাধারণ’ বলেই মনে করেন। সেই রাতটিতে উত্তেজনায় আর ঘুম হলো না তার। পরদিন, নির্ধারিত সময়ে মঞ্চে এলেন বিদেশি রাষ্ট্রপতি। উপহারস্বরূপ তাকে তুলে দেওয়া হলো হামিদুজ্জামানের চিত্রকর্ম। মুহূর্তটি ছিল গর্বের, কিন্তু একইসঙ্গে দায়িত্বেরও। একজন তরুণ শিল্পীর হাতে দেশের প্রতিনিধিত্ব।

এই ছোট্ট অথচ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে হামিদুজ্জামান খানের শিল্পী জীবনের ভিত্তি তার কাজ কেবল ব্যক্তিগত সৃজন নয়, বরং একটি জাতির কণ্ঠস্বর। জলরঙের পাশাপাশি পরে তিনি নিজেকে মেলে ধরেন ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যেও। বলা যায় তার হাত ধরেই বাংলাদেশের ভাস্কর্য় শিল্প আধুনিকতার দেখা পায়। মেটাল, পাথর, ব্রোঞ্জে তিনি রূপ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, আত্মত্যাগ ও জাতীয় পরিচয়ের বহুমাত্রিক চিত্র। তার শিল্প শুধু দেখার নয়, অনুভবেরও যেখানে একদিকে ইতিহাসের গভীরতা, অন্যদিকে বিমূর্ত সৌন্দর্যের প্রকাশ।

১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হন। ক্লাসে সব সময় প্রথম হতেন। ম্যাট্রিক পাসের পর ভর্তি হন ভৈরব কলেজে, বিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৬৩ সালে হামিদুজ্জামান ভর্তি হন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। সেখানে তার প্রতিভা দ্রুতই স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। জলরঙে তার দক্ষতা ছিল চোখে পড়ার মতো-বিশেষ করে আলো, ছায়া এবং বাস্তবতার মেলবন্ধনে তিনি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। ১৯৬৭ সালে তিনি চারুকলা থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ভারতের মহারাষ্ট্রের এম.এস. ইউনিভার্সিটি, বরোদা থেকে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য শিক্ষার্থী হিসাবে মনোনীত হন। বরোদার শিল্পচর্চার পরিবেশ ছিল উন্মুক্ত, উৎসাহব্যঞ্জক এবং পরীক্ষাধর্মী-যেখানে তিনি তার ধারণাগুলোকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সুযোগ পান।

১৯৮৩ সালে শিল্পী হামিদুজ্জামান নিউইয়র্কের স্কাল্পচার সেন্টার স্কুল থেকে মেটাল কাষ্টিং-এ উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নিউইয়র্কের শিল্পজগৎ তাকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিমূর্ত ধারার সঙ্গে যুক্ত করে তোলে। তিনি নিজেকে শুধু একজন ভাস্কর হিসাবে নয়, বরং একটি শক্তিশালী ভাবনা ও বার্তাবাহী মাধ্যমের নির্মাতা হিসাবে গড়ে তোলেন। এ অভিজ্ঞতাগুলো পরবর্তী সময়ে তার শিল্পকর্মে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়-জাতীয় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, মানবিক আবেগ এবং বিমূর্ত রূপগুলোর মিশেলে তার শিল্প হয়ে ওঠে এক অনন্য প্রতিবেদন। হামিদুজ্জামান খানের শিল্পচিন্তা মূলত ইতিহাস, আত্মত্যাগ ও স্বজাতির চেতনা থেকে উৎসারিত। তার প্রতিটি ভাস্কর্যে থাকে নীরব ভাষ্য, দৃঢ় বার্তা এবং বিমূর্ত এক সৌন্দর্যবোধ। ভাস্কর্য তার কাছে শুধু দৃশ্যমান শিল্প নয়-এটি সময়, স্মৃতি ও সংকল্পের ভাষা।

১৯৮৮ সালে আশুগঞ্জে জিয়া সার কারখানার প্রবেশপথে নির্মাণ করেন তার বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘জাগ্রত বাংলা’। এটি একজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি, প্রতিরোধ ও বিজয়ের প্রতীক। একই ধারায় ১৯৮৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করেন ‘সংশপ্তক’, যেখানে এক আহত মুক্তিযোদ্ধা, হাত ও পা হারিয়েও রাইফেল হাতে এগিয়ে চলেছেন।

তার আরেক স্মরণীয় সৃষ্টি ‘পাখি পরিবার’, যা ১৯৮১ সালে বঙ্গভবনের ভেতরে স্থাপিত হয়। এখানে প্রকৃতি, পরিবার ও বন্ধনের প্রতীক হয়ে উঠে আসে কয়েকটি বিমূর্ত পাখির রূপ। ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অলিম্পিক স্কাল্পচার পার্কে প্রদর্শিত হয় তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কাজ ‘Steps’, যা অগ্রগতির প্রতীকরূপে সিঁড়ির ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার ভাবনা বহন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে আছে ‘শান্তির পাখি’-যেখানে ডানামেলা একঝাঁক উড়ন্ত পাখি ভবিষ্যতের আশাবাদ এবং শান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্মৃতির মিনার’ মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসাবে তৈরি, যা তার নিঃশব্দ শৈল্পিক প্রতিবাদের ধারাকে বয়ে আনে। তার শিল্পকর্ম শুধু দৃষ্টির নয়, অনুভবের-যেখানে ইতিহাসের ভার আর ভবিষ্যতের প্রত্যাশা একসঙ্গে কথা বলে।

শিল্পী হামিদুজ্জামান খান শুধু একজন সৃষ্টিশীল শিল্পীই নন, ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে যোগ দেন শিক্ষক হিসাবে। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক তিনি সেখানে ভাস্কর্য বিভাগে পাঠদান করেছেন এবং পরে বিভাগের প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার ক্লাসে ছাত্ররা শুধু ভাস্কর্য শিখত না, শিখত ইতিহাস, দেশপ্রেম ও আত্ম পরিচয়ের ধারণা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘শিল্পচর্চা কেবল হাতের কাজ নয়-চেতনার চর্চা।’

২০০৩ সালে অবসর গ্রহণের পরও তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শনী, কর্মশালা এবং বক্তৃতার মাধ্যমে তরুণ শিল্পীদের পথ দেখিয়ে গেছেন। তার অনেক ছাত্র আজ বাংলাদেশের শীর্ষ ভাস্করদের মধ্যে রয়েছেন-এটাই তার শিক্ষকের সবচেয়ে বড় অর্জন। হামিদুজ্জামান খান ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত হন-যা দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্মান। ২০২৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো নির্বাচিত হন। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের অসংখ্য প্রদর্শনী, কর্মশালা ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের পরিচালক হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তার স্ত্রী আইভী জামানও একজন প্রধিতযশা ভাস্কর। তাদের দুই ছেলে। বড় ছেলে জুবায়ের জামান কপার একজন ফটোগ্রাফার। ছোট ছেলে জারিফ হামিদুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করছেন।

নন্দিত এ ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী গত ২০ জুলাই সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন ধরেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জানাজা ও দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কিশোরগঞ্জের নিজ গ্রামে। সেখানে তার বাবা-মায়ের কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।

হামিদুজ্জামান খান ছিলেন একজন নীরব ভাষ্যকার-যিনি রং, রূপ আর গড়নের ভেতর দিয়ে বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মাণ করেছেন। তার শিল্পচর্চা কেবল একটি পেশা ছিল না, ছিল এক ধরনের দায়বদ্ধতা-ইতিহাসকে ধরে রাখার, প্রজন্মকে পথ দেখানোর এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সংলাপ গড়ার।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম