Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও আহমদ ছফা প্রাসঙ্গিক

Icon

জাহেদ সরওয়ার

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উনিশ-শ বাহাত্তর সালে মহাত্মা আহমদ ছফা এমন একটি পুস্তিকা রচেন যার দায়ভার তাকে সারা জনম বইতে হয়েছে। এ বইটিই আহমদ ছফাকে একদিকে ঘৃণায় পর্যবসিত করেছে, তার চলার পথ সমস্যাসংকুল করে তুলেছে। আবার একজন গণবুদ্ধিজীবী হিসাবে তার পথও তৈরি করে দিয়েছে। তিনি ভবিষ্যতে কী লিখবেন, কেমন করে চিন্তা করবেন বা কার জন্য লিখবেন তাও নির্ধারণ করে দিয়েছে বলা যায়। পুস্তিকাটির নাম ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। ১৯৭২ সাল যখন মুক্তযুদ্ধের মালিকানা ছিনতাই হচ্ছিল। যখন একটি সদ্যপ্রসূত রাষ্ট্র গণমানুষের কাছ থেকে গিয়ে স্বৈরাচারের কবলে পড়ছিল। আহমদ ছফা এই লেখাটি প্রকাশের ২৫ বছর পর এ পুস্তিকা সম্পর্কে লিখেছিলেন-লেখাটি যদি না লিখতাম হয়তো আমার জীবন অন্য রকম হতে পারত। এ লেখাটির জন্যই আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর রোষ আমাকে পেছন থেকে অভিশাপের মতো তাড়া করছে। অদ্যাবধি আমি জীবনে স্বস্তি কী বস্তু তার সন্ধান পাইনি। আগামীতে কোনোদিন পাব সে ভরসাও করিনে।

আসলেও এরপর তিনি জীবনেও কোনো স্বস্তি পাননি। কারণ এই বইজুড়ে তিনি সে সময়ে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন। যেই সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তার অনিয়মের বিরুদ্ধেই তার কলম চলেছে সেলাই মেশিনের মতো। দল হিসাবে আওয়ামী লীগের চরিত্র, নেতা হিসাবে মুজিবের চরিত্র তিনি তখনই চিহ্নিত করেছিলেন সেই বইয়ে। ৭১ পরবর্তী বছরগুলোতে অবিচার অনাচার নির্যাতন রাষ্ট্রশক্তির সক্রিয় হস্তক্ষেপ যখন সামাজিক বিবেকের কণ্ঠ রুদ্ধ করে ফেলেছিল, তখন তিনি লিখেন-শেখ মুজিবুর রহমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথ পরিহার করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা আরোপ করলেন এবং সর্বময় ক্ষমতার কর্তা হয়ে বসলেন সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এ চারটি প্রতীতিকে জাতীয় মূলনীতি হিসাবে নির্ধারণ করলেন বটে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেগুলো একদলীয় আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এক ব্যক্তির শাসন ত্রাসনের হাতিয়ারে পরিণত হলো। তার মর্মান্তিক পরিণতি এই হল যে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিহত হতে হলো। রাষ্ট্রক্ষমতা বেসামরিক একনায়কের হাত থেকে সামরিক একনায়কের হাতে হস্তান্তরিত হলো।

ছফা সমাজকে স্বচ্ছ কাচের মতো দেখতে পেতেন। যেহেতু তিনি ইতিহাসের অন্তরাল থেকে পাঠ নিয়েছিলেন। সাধারণের পক্ষে তার অবস্থান থাকার কারণে তিনি সহজেই বিচার করতে পেরেছিলেন একটা সদ্যপ্রসূত রাষ্ট্রের গতি। তবে আহমদ ছফার সঙ্গে যে তর্কটা করা যায় তা হলো, ওই সময় পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা গণবিরোধী সংবিধান নিয়ে। কারণ মুজিবের স্বৈরাচারী হয়ে উঠার পেছনে যেই দলিলটির সর্বাত্মক ভূমিকা ছিল সেটা হলো ৭২-এর সংবিধান। এ সংবিধান নিয়ে যেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে সেই স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছে। এ বইয়ের সূত্র ধরে ছফার সঙ্গে আরেকটি তর্ক হতে পারে, তিনি মনে করেন একাত্তর শুধুই পাকিস্তানের বঞ্চনার ফসল। কিন্তু একাত্তর যদি অর্ধেক পাকিস্তানের বঞ্চনার ফসল হয় বাকি অর্ধেক ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনার ফসল। এবং একাত্তরপরবর্তী যে ভারতীয় রাশি রাশি বয়ান এ দেশের ইতিহাসের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যা আজ মিথ্যা বলে পরিগণিত হচ্ছে। হাসিনা তো আরও এককাঠি সরেস হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পুরোটাই তার পরিবার ও ভারতের অবদান বলে বয়ান সৃষ্টি করেছিল। তার আমলে যে পরিমাণ মুক্তিযুদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি হয়েছে তা বিস্ময়কর। এবং মুজিবকে ভারতপন্থি ক্রীড়নক নেতা হিসাবে গড়ে তোলার পেছনে ভারতের যে কসরত ও বিনিয়োগ সেসব কেন তার দৃষ্টি এড়াল?

ছফা লিখেন- মুজিবের তৈরি পথ দিয়ে একের পর এক সমরনায়কেরা সমাজের পাতাল প্রদেশ থেকে পশ্চাৎপদ ধ্যান ধারণা, ধর্মান্ধতা শুধু জাগিয়ে তুলে ক্ষান্ত হননি, সেগুলোর আইনগত স্বীকৃতি দান করে আমাদের জাতীয় জীবনের গন্তব্য অধিকতর ধোঁয়াটে এবং কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছেন।

তিনি মুজিব সম্পর্কে লিখেন-আওয়ামী লীগ শব্দ বন্ধটি বাংলা নয়। আওয়ামী লীগ শব্দটি উর্দু এবং লীগ শব্দটি ইংরেজি। তারপর শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ধরা যাক। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি না বাঙালি জাতির জনক? মুজিবকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসাবে মেনে নিলে কারও কোনো বিতর্কের অবকাশ থাকে না। কিন্তু তাকে বাঙালি জাতির জনক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে আরও একটি প্যাঁচাল বিতর্কের জন্ম দেওয়া হয় মাত্র। বাংলদেশের বাইরে ভারতের নানা জায়গায় বাঙালিরা বসবাস করে থাকেন। তারা শেখ মুজিবকে বাঙালি জাতির জনক হিসাবে মেনে নিতে স্বীকৃত হবেন না। প্রকৃত অর্থে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভুখণ্ডটিই স্বাধীন হয়েছে। তাকে যদি জাতির জনক হিসাবে মেনেও নিতে হয় বাংলাদেশি জাতির জনক বলাই অধিকরতর সঙ্গত। তাই যদি হয় তাহলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার দাবিই প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয় নাকি? বাংলাদেশি বলে কোনো জাতি যেমন নেই তেমনি কোনো পিতাও থাকতে পারে না।

এ তর্ক আমি একটু আগে উত্থাপন করলাম যে, ইতিহাস একটি চলমান প্রক্রিয়া। আহমদ ছফা এখন এ প্রবন্ধটি লিখলে হয়তো আরও র‌্যাডিকাল হতেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের স্বার্থ বা তাদের কলাকৌশল প্রয়োগের দিকটা ওই সময়ে তার লেখায় ধরা পড়েনি। তো আসলে এই লেখার যে শিরোনামটা দিয়েছি সেটার সার্থকতা তার আরেকটা বক্তব্যে স্পষ্ট হবে। -বাংলাদেশটির দুর্ভাগ্য হলো-দেশটির প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে বিপুল পরিমাণ অতীতের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। অতীতের ভূত কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে বর্তমানের নিরিখে কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করার কোনো লক্ষণ পরিদৃশ্যমান হচ্ছে না। অতীতের ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই তারা দেশটা শাসন করতে চান। তাই প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের আচরণের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য এতটাই প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে, তার মধ্যে বাংলাদেশ কতটা উপস্থিত সেই জিনিসটিই দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের যে একটি আত্মা আছে তা আবিষ্কার করতে সক্ষম নয়।

এতদিনে এই ছিল নাভিশ্বাস। কিন্তু ২০২৪ সালের যে গণজাগরণ যেই উদ্দেশ্য সেটা আমার মনে হয় এ স্থবিরতা থেকে এ বিদেশমুখিনতা থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলাদেশের আত্মা খোঁজা ও তার সমৃদ্ধির পথ আবিষ্কার করার কঠিন পথে যাত্রা। এখানেই আহমদ ছফা এখনো প্রাসঙ্গিক। বাংলা ভাষার সাহিত্য ও চিন্তাশীলতার জগতে আহমদ ছফা ছিলেন এক ব্যতিক্রমী, দৃঢ়চেতা এবং সাহসী কণ্ঠস্বর। তার সৃজন ও সক্রিয়তা শুধু একটি ব্যক্তি পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তিনি ছিলেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক, এক জাতিসত্তার অভ্যন্তরীণ আত্মসন্ধানের নির্ভরযোগ্য দিকনির্দেশক। সাহিত্যিক, গবেষক, অ্যাকটিভিস্ট এবং বুদ্ধিজীবী-এ চারটি পরিচয়ে তাকে পাঠ করা গেলেও, আহমদ ছফার মৌলিকতা ছিল তার চিন্তায়, ভাষায় এবং সমাজ বাস্তবতায় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণে।

আহমদ ছফার চিন্তার কেন্দ্রে ছিল বাঙালি জাতিসত্তার আত্ম-উপলব্ধি এবং সাংস্কৃতিক নির্ভরতার প্রশ্ন। তার বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৭৬) বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো কাজ হিসাবে বিবেচিত। তিনি এখানে বিশ্লেষণ করেন কিভাবে ঔপনিবেশিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস মিলে বাঙালি মুসলমানের মনোজগতে একটি নিরাশা ও আত্মবিরোধিতার বোধ তৈরি করেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাঙালি মুসলমানের মন এখনো দাসত্বময়। এ মনের মাঝে রয়েছে আরব, মোগল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনের গভীর ছায়া। ফলে একটি স্বাধীন জাতিসত্তা গড়ে উঠতে পারে না, যতক্ষণ না জাতি নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পায়। আহমদ ছফা লেখকরূপেও অনন্য। তার ভাষা ছিল সরল, অনাড়ম্বর, কিন্তু গভীর ও ব্যঞ্জনাময়। তিনি সাহিত্যকে এক ধরনের সমাজ বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতেন এবং সাহিত্যকে আলাদা কোনো এলিট চর্চা নয়-বরং জীবনেরই একটি রূপ হিসাবে ভাবতেন। অলাতচক্র উপন্যাসে তিনি লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী আবুল হাসান মুর্শিদীর অভিজ্ঞতা ও আত্মসংঘাত নিয়ে লিখেছেন। প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধকালীন এক নির্বাসিত বুদ্ধিজীবীর অন্তর্জগৎ। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী বইতে তিনি নারীর জটিল মনস্তত্ত্ব, সামাজিক অবস্থান এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার লড়াই নিয়ে নির্মিত এক গূঢ় উপন্যাস। গাভী বিত্তান্ত বইতে এক দারিদ্র্যকবলিত সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরে গভীর কৌতুক ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে। এটি একটি রাজনৈতিক রূপক হিসাবেও পাঠযোগ্য। ছফা কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন শিশুসাহিত্যও। কিন্তু তার লেখার মূলে সর্বদা ছিল সমাজ ও ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, নৈতিক প্রশ্ন এবং আত্মিক অনুসন্ধান। ছফা বাংলাদেশের কোনো সরকারকেই তোয়াজ করেননি। আহমদ ছফা সম্পর্কে নানা বিতর্কিত গল্প চালু রয়েছে। অনেকেই তাকে একজন ‘এক্সট্রিম’ ব্যক্তিত্ব বলেছেন-যিনি একদিকে যেমন বিপ্লবী, তেমনি আবার অত্যন্ত সংবেদনশীল। একবার এক সরকারপ্রধান তাকে ফোন করে আমন্ত্রণ জানালেও তিনি যেতে রাজি হননি। আবার শোনা যায়, বাংলা একাডেমির কোনো এক অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান উপস্থিত থাকলেও তিনি প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন, যা সে সময়কার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ ছিল। ছফার চিন্তা ও কাজ নিয়ে পরবর্তীকালে সবচেয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন আরেক চিন্তক ড. সলিমুল্লাহ খান। তার মতে, আহমদ ছফার লেখা ও বক্তব্য শুধু সাহিত্যিক নয়, দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক স্তরেও বিচারযোগ্য। সলিমুল্লাহ খানের দৃষ্টিতে ছফা ছিলেন এমন একজন লেখক, যিনি পশ্চিমা অনুবর্তিতার পরিবর্তে বাঙালি ঐতিহ্য, ভাষা ও অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে একটি নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক বুনন তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সলিমুল্লাহ খান ছফার ভাষা, মনস্তত্ত্ব, লেখকসত্তা এবং রাজনীতির ওপর বিস্তর গবেষণা করেছেন, তার ওপর বক্তৃতা দিয়েছেন এবং প্রবন্ধও লিখেছেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম