|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তন্বী আর তুষার দুজনে ভাইবোন। গোলগাল, ফরসা, পাতলা ঠোঁট ও খাঁড়া নাকের চেহারার তন্বীর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ওর মায়াবী চোখ দুটো। স্তন যুগল পরিপুষ্ট না হলেও ফুটন্ত যৌবন তার পরিধেয় বস্ত্র ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চায়। তার শ্যাম্পু করা মিশমিশে কালো ঝরঝরে চুল যে কোনো মেয়ের ঈর্ষার কারণ হবে। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। বেশ কয়েকটি প্রেমের প্রস্তাব সে গ্রহণ করেনি। তুষার একটি সরকারি কলেজে পড়ে। সে আগামী বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। তুষার বুবুর কথা শুনে এবং বুবুও প্রাণ দিয়ে ছোটভাইকে স্নেহ করে। ছোটভাই ঠিকমতো খেয়েছে কিনা, ঠিক সময় ঘুমাল কিনা, পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের সঙ্গে মিশে কিনা-এসব বিষয়ে দেখাশোনার ভার যেন মা তন্বীর ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন। তুষার বুবুর সব কথা শুনলেও লুকিয়ে লুকিয়ে সে ফেসবুক চালায়। এটা চালানোর অনুমতি বুবু এখনো তাকে দেয়নি। আরেকটা বিষয়েও তুষার বুবুর আদেশ অমান্য করে। বুবু বলেছে, এক ঘণ্টার বেশি কম্পিউটারে গেম খেলা যাবে না। কিন্তু সে অবসর পেলেই আর বুবু যদি ভার্সিটিতে থাকে, তবে অনেকক্ষণ ধরে গেম খেলে। তারা দুজনেই পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই বলা চলে। তাদের বাবা ব্যাংকার এবং মা গৃহিণী। তাদের সংসার বেশি সচ্ছল না হলেও একরকম সচ্ছলই ধরা যায়। আর দশটা পরিবারের মতোই তাদের পরিবারেও সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, অভাব-অভিযোগ ইত্যাদি আছে।
বর্ষাকালের একদিন। সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তন্বী গেছে ভার্সিটিতে ও তুষার গেছে কলেজে, বাবা অফিসে। পাড়ার কুকুরগুলো নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে ঢুকে ঘুমাচ্ছিল। কাকেরা ভিজে একসার। চড়ুইরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে এবাড়ির কার্নিশ ওবাড়ির ঝুলবারান্দায় টানান দড়ির ওপর বসে খুনসুটি করছিল। তন্বীদের বাসার বিপরীত দিকে যে ভবনটি আছে, তার ছাদবাগানে পেয়ারা গাছে বসে অস্থিরতা প্রদর্শন করছিল দুটো টুনটুনি। বাগানের ডালিম গাছে এক জোড়া ঘুঘুকে দেখা গেল অনন্যোপায় হয়ে চুপিসারে ভিজতে। আতাগাছে কয়েকটি বুলবুলি লাল পুচ্ছ দুলিয়ে পাকা আতাফলে ঠোকর দিয়ে দিয়ে ফল ভক্ষণ করছিল। মেঘলা আকাশে কয়েকটি জংলি কবুতর বৃষ্টিকে তাচ্ছিল্য করে পুব দিক থেকে এসে পশ্চিম দিগন্তে বিলীন হয়ে গেল। পাড়ার কোথাও কোথাও দু-ইঞ্চি পরিমাণ পানি গিয়েছিল জমে। তার ওপর দিয়েই রিকশাগুলো টুংটাং শব্দ করে আর অটোরিকশাগুলো বিচিত্র রকমের ভেঁপু বাজিয়ে পানিতে সরসর ধ্বনি তুলে যাতায়াত করছিল। টং দোকানগুলো ক্রেতারা যাতে না ভিজে চাপান করতে পারে, সেজন্য প্লাস্টিকের পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। তুষার বাসায় ফিরেছে বিকালে। তার বোন এখনো ফিরেনি। হয়তো লাইব্রেরিতে পড়া শেষ করে সন্ধ্যায় ফিরবে।
তন্বীর মা কী যেন কাজ করছিলেন। এমন সময় পরপর কয়েকবার কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। এভাবে কে কলিং বেল বাজায় দেখার জন্য তিনি তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে গেলেন। দেখলেন দরজায় তন্বী দাঁড়িয়ে আছে। তার আলুথালু চুল, জামায় বালি, কাদা-ময়লা লাগান, এখানে-ওখানে ছেঁড়া, ওড়না নেই, পাজামাটাও ঠিকমতো পরনে নেই, মুখে আঘাতের চিহ্ন। তাকে দেখে মা বুঝতে পারলেন কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। তিনি বিস্ময় নিয়ে বললেন, কী হয়েছে তোর? এ কথার জবাবে তন্বী হাউমাউ করে কেঁদে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর বলতে লাগল আমার সব শেষ হয়ে গেছে, মা। ওরা আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। ওরা আমার জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছে। আমার আমি বাইরে মুখ দেখাব কী করে, মা?
-কে তোর সবকিছু শেষ করে দিল? বলবি তো?
-ওই মাস্তান হান্নান আর তার সহযোগী। আমি দ্বিতীয় জনকে চিনি না। একথা বলে সে আরও জোরে কাঁদতে লাগল। মা তার মেয়েকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। তিনি তার স্বামীকে ফোন দিলেন। তিনি কাছাকাছি চলে এসেছেন বলে জানালেন। হট্টগোল শুনে তুষারও দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোর বুবু। তার বোন কোনো জবাব না দিয়ে আবারও উচ্চ স্বরে কান্না করতে লাগল। বাবা বাসায় এসে বিস্তারিত সব শুনলেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, তার পরিবারের কেউ এরকম ঘটনার শিকার হতে পারে। পত্রপত্রিকায় এরকম ঘটনার কথা তিনি অনেক পড়েছেন। কিন্তু তার পরিবারে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে, একথা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে হয় সেটাও তিনি জানেন না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তিনি শুধু মেয়েকে বললেন, শান্ত হও, মা। তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ফোন দিলেন, সব খুলে বললেন। বন্ধু পরামর্শ দিল থানায় জানাতে। তিনি স্ত্রীর মুখের দিকে চাইলেন। তার স্ত্রী বলল, ওকাজ করতে যেও না। তাহলে আমাদের মেয়ের বিয়ে কখনো হবে না।
স্ত্রীর মতের বিরুদ্ধে গিয়েই বাবা মেয়েকে নিয়ে থানায় গেল। ওসি সাহেব যখন জানতে পারলেন যে, হান্নান এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তখন তিনি বিরস মুখে বললেন, সে এরকম ঘটনা অনেক ঘটিয়েছে। সে ওই ক্লাবেই সাধারণত এ ধরনের অপকর্মগুলো করে থাকে। তন্বীদের বাসায় আসার পথে একটি ক্লাব আছে। ওখানে বিভিন্ন রকমের এবং বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজন সন্ধ্যার পর থেকেই আড্ডা দেয়। ওসি সাহেব আরও জানালেন যে, হান্নানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকে, বড় কর্তাদের কাছ থেকে ফোন আসে। যার কারণে হান্নানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা পর্যন্ত গ্রহণ করা যায় না। তিনি সাফ-সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি নিরুপায়। তাই কন্যাকে নিয়ে পিতা এক বুক দুঃখ আর তার অক্ষমতার জন্য আকাশ পরিমাণ গ্লানি নিয়ে ঘরে ফিরলেন।
তন্বী ভার্সিটিতে যায় না, ঠিকমতো খায় না। এমনকি ঠিকমতো ঘুমায়ও না। সে দিনে তিন-চারবার কখনো কখনো এরও বেশিবার গোসল করে। বাবা-মা দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাতযাপন করতে লাগলেন। তারা একদিন মেয়েকে নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার সবকিছু শুনলেন, তন্বীর সঙ্গে কথা বলে ওষুধ লিখে দিলেন। ওষুধ খেয়ে তন্বী সারাটা দিন এবং রাতেও ঘুমায়। এভাবে মাস দুয়েক যাওয়ার পর সে একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মাকে বলল যে সে ভার্সিটিতে যাবে। এদিকে তার এক সেমিস্টার নষ্ট হয়ে গেল।
তুষার সব জানে, সব বুঝে। কিন্তু সে কী-ই-বা করতে পারে। তার বন্ধু-বান্ধবরা-তো সবাই নিরীহ ছেলে। তারা কখনো কোনো খারাপ কাজ করে না। এমনকি সিগারেট পর্যন্ত খায় না। তাই সে-তো হান্নানের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না। এ দু’মাস যে কীভাবে গেছে, সেটা একমাত্র সে-ই জানে। সে বুবুর কাছে যেতে পারেনি, তার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি, বুবু তার চুল আঁচড়ে দেয়নি, তার খোঁজখবর নেয়নি। তার খুব খারাপ লাগত। কিন্তু কাউকে কিছু বলত না। শুধু নীরবে কলেজে যেত এবং আসত। আজ যদি মন্টুটা থাকত, তাহলে সে অনেক সাহস পেত। মন্টু পিয়নের ছেলে এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। পড়ালেখায় যেমন ভালো, তেমন দুর্দান্ত সাহসীও ছিল। এসএসসির পর আর পড়তে পারেনি টাকার অভাবে। এখন কোথায় আছে কে জানে! শুনেছে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার পর কাকে নাকি মন্টু চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে। তার ফোন নাম্বারটা পর্যন্ত নেই। যাইহোক, ঘটনা-দুর্ঘটনা, শোক-তাপ, বিয়োগ-ব্যথা, বিরহ-যন্ত্রণা ইত্যাদির পরও জীবন তার আপন গতিতে চলতে থাকে। কোনো কিছুর জন্যই জীবন থেমে থাকে না। সে এক অন্তঃশীলা স্রোতস্বিনী নদীর মতো। সর্বদা বহমান থাকে, চলমান থাকে। তন্বীদের জীবনও একদিন স্বাভাবিক হয়ে এলো। তবে কোথায় যেন একটু ছন্দপতন ঘটেছে। সংসারে আগের ছন্দ আর কখনো ফিরে এলো না।
শীতকাল। রাত দেড়টা বাজে। আজ কুয়াশা পড়েছে অনেক। সব ঢাকা শহরকে প্রকৃতি আপন চাদরে ঢেকে দিয়েছে। সড়কের বাতিগুলো কুয়াশা ভেদ করে রাস্তাকে আলোকিত করার চেষ্টা করছে। তন্বীদের বাসায় যাওয়ার পথে একটা মাঠ আছে। মাঠের ঘাসের কচি ডগাগুলোর ওপর শিশিরের কণা জমে আছে। সব বাসা-বাড়ির আলো নিভে গেছে কেবল দু-চারটা বাদে। কোনো কোনো ঝুলবারান্দায় লাল-নীল বাতি জ্বলছে। আকাশের চাঁদ কোথায় পালিয়েছে কে জানে! তারাদেরও সাক্ষাৎ মিলছে না। ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকাদের ডাক ভেসে আসছে। দূর থেকে ভেসে এলো ভয়ার্ত পাখির আর্তচিৎকার। নীরবতা খান খান করে দিয়ে একটি কুকুর ডেকে উঠল। প্রতিউত্তর দিল আরেকটি কুকুর। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। কেবল মূল সড়কে কিছু যানবাহন সশব্দে চলাচল করছে হেডলাইট জ্বালিয়ে।
সেই মাঠেরই রাস্তাসংলগ্ন একটি স্থানে ক্লাবটি অবস্থিত। বাইরে বাতি জ্বলছে। ভেতরে আলো আছে। ওখানে দুজন মাত্র রয়েছে। তারা দুটো চেয়ারে বসে আছে আর গল্প করছে। তাদের সামনে টেবিলে রাখা আছে দুটো মদের গ্লাস, একটি প্রায় খালি মদের বোতল, প্লেটে গরুর মাংস। আরেকটি প্লেটে আছে পরোটা। মাংস ও পরোটা প্রায় শেষ। দুজনের হাতেই সিগারেট জ্বলছে। তাদের কথা-বার্তা শুনে যে কেউ বুঝবে যে, তারা প্রায় মাতাল হয়ে গেছে। এদের একজন হান্নান ও অপরজন তার সহযোগী। তারা যে কক্ষে বসে পানাহার করছিল, তার দরজাটি সশব্দে খুলে গেল। একজন আততায়ী রিভলভার হাতে কক্ষে প্রবেশ করল। হান্নানের সহযোগী আততায়ীকে দেখে টলায়মান হাতে তার কোমরে গোঁজা পিস্তলটি বের করে আততায়ীর দিকে তাক করার চেষ্টা করল; কিন্তু তার আগেই আততায়ীর ছোড়া গুলি এসে তার চোখ ভেদ করে খুলির কিছুটা অংশসহ পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে চেয়ারেই ধপাস করে পেছনের দিকে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। এবার আততায়ী হান্নানকে লক্ষ করে পরপর দুটো গুলি ছুড়ল। একটি লাগল তার কপালের ঠিক মাঝে, আরেকটা গলায়। সে চেয়ারসহ চিত হয়ে পেছনের দিকে পড়ে গেল। আততায়ী কাজ সেরে পালিয়ে গেল নির্বিঘ্নে।
পরদিন টিভিতে সংবাদে বলল, সন্ত্রাসী হান্নান ও তার সহযোগী গুলিতে নিহত। এ ব্যাপারে জড়িত থাকার সন্দেহে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আসলামকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
পনের দিন আগের ঘটনা।
সন্ধ্যাবেলা তুষার কম্পিউটারে গেম খেলছিল। এমন সময় একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে তার মোবাইলে কল এলো। সে কল রিসিভ করতেই শুনল মন্টুর গলা। মন্টু জিজ্ঞেস করছে:
-তুই বাসায় আছিস?
-হ্যাঁ, কেন?
-একটু বাইরে আয়। তোর সঙ্গে কথা আছে।
-ঠিক আছে। আসছি।
তুষার বাইরে গিয়ে দেখে মন্টু কার্টুন ট্যাপে মোড়ান একটি জুতার বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মন্টু বলল:
-এই বাক্সটা এক সপ্তাহের জন্য রাখ।
-না, পারব না। মা রাগ করবে।
-প্লিজ, তুষার! মাত্র এক সপ্তাহের জন্য রাখ। এরপর আমি এটি তোর কাছ থেকে নিয়ে যাব।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এক সপ্তাহের বেশি যেন না হয়।
তুষার ভারী জুতার বাক্সটি নিয়ে সবার অলক্ষ্যে তার পড়ার টেবিলের বড় ড্রয়ারে রেখে দিল। মন্টু এক সপ্তাহের কথা বললেও আজ পনের দিন হতে চলল সে আসেনি।
