Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মানস ভূগোলে মুসলিম সমাজ

Icon

ড. নূর-ই আলম সিদ্দিকী

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মানস ভূগোলে মুসলিম সমাজ

বিভাগ পূর্ব-চল্লিশের লেখকদের মধ্যে আবুল ফজল, মাহাবুব উল আলম, আবুল মনসুর আহমদ, শওকত ওসমান এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-৭১) বাংলা সাহিত্যে মুসলমান সমাজকে শিল্পিত রূপ দেন। এসব লেখকের মানস চেতনাস্নাত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যিকদের প্রভাবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কল্লোল সাহিত্যরীতিও আত্মস্থ করেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, কারও রচনায় কল্লোলের শৈল্পিক উৎকর্ষ প্রতিফলিত হয়নি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পূর্ব-বাংলায় সাহিত্য চর্চার প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সাহিত্য অঙ্গনে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সমরেশ বসু, বিমল কর ও জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী গল্প-উপন্যাসে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। 

বিষয়গত দিক থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এসব লেখকের কাছে ঋণী হলেও অল্প সময়ের ব্যবধানে রচনার প্রকরণ ও স্টাইলে প্রাতিস্বিক হয়ে ওঠেন। পূর্ববঙ্গের সাহিত্য জীবনধারা নিরীক্ষার দুর্বলতা থেকে তার স্পর্শে মুক্তি পায়। সোজা কথায় বাংলা সাহিত্যের রূপ বদল ঘটে তার হাত ধরে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সৃষ্টি কোনো আকস্মিক বিষয় ছিল না। ‘সর্বাধুনিক তত্ত্ব বা দর্শন জারিত পরিশ্রুত মন নিয়ে পোশাকে দারুণ ভদ্রলোক ওয়ালীউল্লাহ্ সারা জীবন তার মানস দেয়ালে পূর্ববঙ্গের জনজীবন ও জনসংস্কৃতিকে চিত্রায়ণ করেছেন।’ তিনি তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজের অন্বেষু জীবনচিত্রকে শিল্পরূপ দিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

প্রতিশ্রুতিশীল লেখক হিসাবে নিজের ভেতর শিল্পীসত্তাকে গভীরভাবে লালন করেছিলেন। লেখার সূচনাকালে তার সৃষ্টিতে বিষয়গত বৈচিত্র্য খুব একটা দৃশ্যমান না হলেও গল্পের ভাষা ও প্রকরণ ছিল বিস্ময়কর। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ‘বাঙালি মুসলমান সমাজের একান্ত নিজস্ব সংকট, অন্বয়, শূন্যতা, কূটাভাস তার গল্পবীক্ষার প্রধান অবলম্বন।’ সংগত কারণে ওয়ালীউল্লাহ তার সাহিত্যে মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি চিত্রায়ণে পথিকৃতের আসন অলংকৃত করেন। আবহমানকাল থেকে বাঙালি সংস্কৃতিতে হিন্দু মুসলমানের সহাবস্থান। কিন্তু বাংলা আকাশে লক্ষ করলে দেখা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে ১৯৪৭ পূর্বভাগ পর্যন্ত বাংলা কথাসাহিত্যে মুসলমান সমাজের অন্তর্জীবনের ছবি দু-একজন ছাড়া অন্য কারও রচনাতে তেমন অবয়ব পায়নি বললেই চলে। 

বিষয়টি সম্পর্কে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেন-‘‘মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে আমার দুটো গল্প প্রসিদ্ধ ‘রূপো বাঙাল’ ও ‘আহ্বান’। আমি আরও গল্প লিখব এদের নিয়ে। কিন্তু উপন্যাস হয় না জানো তো? অর্থাৎ আমার দ্বারা হয় না। মুসলমান সমাজকে আমি কতটুকু জানি তাদের আচার-বিচার, ধর্ম বিশ্বাস এ সম্বন্ধে ঘনিষ্ঠভাবে না জানলে তা নিয়ে উপন্যাস লেখা চলে কি?’’ স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ওপার বাংলায় সাহিত্যিকদের লেখায় মুসলমান সমাজ শ্রীশৈলবালা ঘোষজায়া, সত্যেন সেন ও গৌরকিশোর ছাড়া অন্য কারও লেখায় তেমন করে প্রতিফলিত হয়নি, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এ প্রেক্ষাপটে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পূর্বসূরির দায় নিয়ে এ জগতে প্রবেশ করেন। উল্লেখ্য পূর্বজ ও সমকালীন লেখকদের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর পার্থক্য হলো তিনি মুসলিম পরিবারের এবং এতদিনের অরূপায়িত লোক মানসের আড়ালে থাকা মুসলমান সমাজকে সাহিত্যে চিত্রিত করেন।

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতি রূপায়ণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র মানসপ্রবণতা প্রসঙ্গে গবেষক উল্লেখ করেন-‘‘ওয়ালীউল্লাহ্ সময় ও পরিসরের সন্ধি-বিসন্ধি অনুশীলন করতে গিয়ে জোর দিয়েছেন মানুষের উপর। বাঙালির ইতিহাসের চরম বিনিপাতের পর্বে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের মেধাগ্রাসী, সংস্কৃতিগ্রাসী, চেতনাগ্রাসী বিষবাষ্প যখন সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল, ধর্মীয় পরিচয় হয়ে ওঠেছিল সাহিত্যের নিয়ামক, সেই দুঃসময় সংবেদনশীল সাহিত্যস্রষ্টার জন্য ছিল পরীক্ষার সময়। অনালোকিত মুসলমান সমাজের ভেতর ও বাহিরকে শিল্পের আধেয় করে তোলার মানে ‘মুসলিম সাহিত্য’ রচনা নয় বরং বাঙালির খণ্ডিত পরিচয় পেয়ে সম্পূর্ণতা দান।’’ যা ওয়ালীউল্লাহর সৃষ্টির মধ্যেই পাঠক পেয়ে যায়। 

ওয়ালীউল্লাহর কাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল মুসলমানের আত্মিক ভুবন আবিষ্কার এবং একইসঙ্গে তাকে শিল্পের মর্যাদা দান। এক্ষেত্রে দুটি বাতাবরণ তার সামনে দৃশ্যমান হয়। এক. তিনি যাদের জন্য লিখছেন তারাই ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন। দুই. চল্লিশ-পূর্ব সময়ের বাংলা সাহিত্য মানে বাঙালি হিন্দুর সাহিত্য এবং একই কারণে তা মুসলমান স্বার্থবিরোধী। বিষয়টি সম্পর্কে গবেষকের উদ্ধৃতি গভীর তাৎপর্য বহন করে। ‘খাঁটি ইসলামিক সাহিত্য নির্মাণের জন্য বাঙালিদের সব চিহ্ন মুছে ফেলার উৎকট উদ্যোগ, কেননা সহজ সমীকরণ অনুযায়ী বাঙালি মানে হিন্দু। এ যুক্তিহীন গোঁড়ামি পেয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি অন্ধতায়, যেহেতু বাংলা সাহিত্যের প্রবহমান ধারায় মুসলমান সমাজকে দূরীকৃত ও প্রত্যাখ্যাত অপর হিসাবে প্রান্তিকায়িত করে রাখা হয়েছিল।’ 

কিন্তু লেখক মাত্রই বিশ্বাস করেন, মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল সেখানে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাই নিঃশব্দ জাতিভেদ নয়, সম্প্রীতি সংযোগের পাঠাতনে দাঁড়িয়ে মানবিক উদারতায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মনোজগতের ভিন্নতর সত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন। দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারায় বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমানকে এক ও অবিভাজ্য চেতনায় মিলিত হতে দেয়নি। ফলে কৃত্তিবাস থেকে আলাওল, বৈষ্ণব পদাবলী ও ইউসুফ জুলেখা, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন, জীবনানন্দ-নজরুল এমনকি ওয়ালীউল্লাহও বিন্যস্ত হয়েছেন স্বতন্ত্র অবস্থানে। ‘আমরা’ ‘ওরা’র এ বিভাজনের বিপরীতে, তাই ওয়ালীউল্লাহ’র রচনা হয়েছে বিভেদমূলক সংস্কৃতিক রাজনীতির প্রতিষেধক।

সাহিত্যের উষর প্রান্তরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জীবনের নির্যাস নিয়ে বঞ্চিত মুসলমান সমাজের মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর এক্ষেত্রে অকৃত্রিম দেশপ্রেম বোধ তাকে উজ্জীবিত করেছে সৃষ্টির মহাসমুদ্রে অবগাহন করতে। দেশভাগের বিক্ষিপ্ত ও বিপন্ন সময়ে তাই যে ১৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সোহরাওয়ার্দী’র বৃহত্তর বাংলার পক্ষে অভিমত দেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। আবু সয়ীদ আইয়ুবসহ সেদিনের যৌথবিবৃতির গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। ‘হিন্দু ও মুসলমান রাষ্ট্রনায়কদের বিভেদগামী ও বিপথগামী নেতৃত্বের ভয়াবহ পরিণাম চোখের সামনে স্পষ্ট দেখেও কি আমরা আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দ্বারা মাউন্টব্যাটেনের রোয়েদাদকে ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে বাংলাকে পুনর্গঠিত ও পুরুজ্জীবিত করতে আত্মদানে এগিয়ে আসব না?’ 

মুসলিম সমাজের প্রতি গভীর টান ছিল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র। বিদেশের মাটিতে বসেও গল্প রচনা করেছেন অন্তর্গত তাগিদে। সৃজনশীল সাহিত্যিক হিসাবে সৃষ্টির আঙিনায় পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিক্রিয়া ও প্রবণতাকে সমকালীন পাশ্চাত্য ভাবনার সমান্তরালে প্রতিবিম্বিত করে কথাসাহিত্য পর্যবেক্ষণে তৎপর হয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকায় উচ্চবিত্ত সমাজের হয়েও তার কোনো সমস্যা হয়নি। তার লেখায় উঁচুতলার মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে নিচুতলারও। প্রচলিত ধর্মাচরণে আস্থাহীন ওয়ালীউল্লাহ মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য জীবনচর্চার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। একথা স্পষ্ট, ওয়ালীউল্লাহ সমসাময়িক সময়ে হিন্দু সমাজকে নয়, মুসলিম সমাজকে নিয়ে লেখার প্রয়াস পেয়েছেন। আধুনিক মুসলিম লেখকদের লেখার প্রকৃতি সম্পর্কেও তিনি একটি পরিচ্ছন্ন প্রতিকৃতির বিগ্রহ নিজের মধ্যে মূর্ত করেছিলেন। ১৯৪৩ সালের ১৪ জুলাই মাসিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদক কাজী আফসার উদ্দিনকে লেখা পত্রে তিনি লেখেন-‘আমরা মুসলমান হয়তো বা কয়েক ঘর আমরা শহরে বাস করি এবং আমাদের বাড়ি শহরে। তাছাড়া যে বিরাট সমাজ সভ্যতার জঞ্জাল, সে সমাজের পক্ষে আধুনিক সাহিত্যের তেমন প্রয়োজন আছে কি? এবং সে সাহিত্য যদি ব্যর্থ হয়, তবে সে ব্যর্থতা হবে সেই রকম-ভারতীয় শিল্পকলা ছেড়ে। কোনো কিছুর মধ্যস্থতা না নিয়ে এক লাফে সুরিয়লিজম শুরু করে যে ব্যর্থতা। আমার তো তাই মত, তবে সেই মত খণ্ডন করতে রাজি আছি, যদি শান্তিপূর্ণ যুক্তি পাই এর বিরুদ্ধে।’ 

লেখার সূচনা লগ্নে স্ব-ধর্মের মানুষের সমস্যার প্রতি তার তীক্ষ্ম আকুতি ছিল। মাত্র একুশ বছর বয়সে বন্ধুকে লেখা এক পত্রে তিনি লেখন-‘I want to write মুসলমান সমাজকে নিয়ে-আমার সমগ্র মনের ইচ্ছে সেদিক পানে। এও একরকম Passion থেকে সৃষ্ট। মুসলমান সমাজ সম্পর্কে আমরা কেউ হয়তো অজ্ঞ নই, কিন্তু অধঃপতনের এই যে একটা চূড়ান্ত অবস্থা-এ অবস্থা নিয়ে লিখে আমি আমার লেখা কলঙ্কিত করতে চাই।-আমি আমার আঁকা ছবিতে সে সমাজকে প্রতিফলিত করতে চাই; যাতে তারা নিজের সুষ্ঠু চেহারা দেখবার সুযোগ পায়।’ প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’য় (১৯৪৪) সমাজের নিচুতলার মানুষকে শিল্পরূপ দিয়েছেন। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘দুইতীর’ (১৯৬৫)। উভয় গ্রন্থে মুসলিম সমাজের ভেতর-বাহিরের অজানা অধ্যায়কে তিনি উন্মোচিত করেছেন শৈল্পিক ব্যঞ্জনায়। তার ‘পাগড়ি’, ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতায়’ এবং ‘সতীন’ গল্পে মুসলিম সমাজের বহুবিবাহ প্রথাকে প্রতিপাদিত করেছেন। ‘বংশের জের’ গল্পে পরিস্ফুটিত করেছেন বহুবিবাহ ও বর্ণ-বৈষম্যকে। ‘গ্রীষ্মের ছুটি’ গল্পে প্রতিভাত করেছেন লোকবিশ্বাস, লোকপুরাণ ও কুসংস্কার। বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালু’ এবং ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় উদ্ভাসিত করেছেন ধর্মের নামে প্রতারণা ও ভণ্ডামি এবং নাটক ‘বহিপীর’, ও ‘তরঙ্গভঙ্গে’ উদ্বেলিত হয়েছে মুসলমান সমাজের নানাবিধ সমস্যার কথকতা। সমাজ-সজ্ঞান মনোবাস্তবতার লেখক হিসাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একজন বিরলপ্রজ মুসলিম লেখক, যিনি চিত্রকরের চোখের আলো ফেলে দেখেছেন মুসলমান সমাজের ভেতর-বাহির। 


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম