অনুবাদক ও ধর্মবেত্তা ভাই গিরিশচন্দ্র সেন
সেলিম আকন্দ
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০) পবিত্র কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক। তার সমকালে মাওলানা নঈম উদ্দিন, আকবর আলী প্রমুখ কুরআনের খণ্ডিত অংশের অনুবাদক ছিলেন। কেউ এক পারা কেউ বা দুই-তিন পারা। কিন্তু বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ভাই গিরিশচন্দ্র সেনই বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ কুরআন শরীফ অনুবাদ ও প্রকাশ করেন। সনাতন হিন্দু-বাঙালি সেন পরিবারে জন্মগ্রহণকারী গিরিশচন্দ্র সেন নিজের চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। কিন্তু ৪২ বয়সে তিনি যখন কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক পবিত্র কুরআনের বাংলা অনুবাদ কর্মের জন্য নির্দেশিত ও মনোনীত হন তখন তিনি উপলব্ধি করেন, তার যথেষ্ট আরবি ভাষার জ্ঞান নেই। আরবি ব্যাকারণের নিয়মকানুন তিনি তেমন বেশি জানেন না যদিও তখন পর্যন্ত তিনি উর্দু ও ফারসি ভাষা থেকে বেশ কয়েকটি গ্রন্থের অনুবাদ কর্মের জন্য স্বনামখ্যাত। তা সত্ত্বেও মূল আরবি ভাষা থেকে পবিত্র কুরআনের অনুবাদ সুসম্পন্ন করার মানসে ভালোভাবে আরবি ভাষা রপ্ত করার জন্য মনোনিবেশ করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ঢাকা, কলকাতা ও লখনৌর ভালো আরবি জানা মুফতি-মৌলভী-মুন্সির শরণাপন্ন হন। এসব ওলামা-মাশায়েখের কাছে তিনি গভীর মনোনিবেশ সহকারে আরবি ভাষা আয়ত্ত ও আত্মস্থ করেন। এরপর তিনি কুরআনের অনুবাদ করেন। ১৮৮৬ সালে তার অনূদিত বাংলা ভাষায় কুরআন শরিফ প্রকাশিত হয়। এভাবে সব কুসংস্কার, অচ্ছুত মার্গের ঊর্ধ্বে থেকে অমুসলিম বিধর্মী হিসাবে পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ কর্ম সম্পন্ন করে তিনি মুসলিম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম লেখালেন। সেই থেকে সেকালের, এমনকি এ কালেরও অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন বাঙালি মুসলমানের কাছে পবিত্র কুরআনকে নিজের ভাষায় সরলভাবে জানার ও বোঝার দ্বার উন্মোচিত হলো। এ মহৎ কর্মের জন্য অমুসলিম হয়েও সব বাঙালি মুসলমানের কাছে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন চির নমস্যজন হয়ে আছেন।
ক্ষণজন্মা এবং মুক্তমনা গিরিশচন্দ্র সেন ১৮৩৪ সালে নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে দেওয়ান বৈদ্য বংশ নামক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পারিবারিক উপাধি ছিল সেন। পিতা মাধবরাম সেন এবং পিতামহ রামমোহন সেন ছিলেন সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় পণ্ডিত। উভয়ই ফারসি ভাষায় একাধিক গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করেন। গিরিশচন্দ্র সেন অনুবাদের অভ্যাসটা ঐতিহ্যগতভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। সাত বছর বয়স পর্যন্ত পিতা, পিতামহ, পিতৃব্য ও গৃহশিক্ষকের কাছে সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি, ইংরেজি ও বাংলা ভাষা এবং ইতিহাস ও ভূগোল বিষয় পড়াশোনা করেন। এরপর তাকে ঢাকার পোগোজ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে পড়া না পারার কারণে শিক্ষকদের হরহামেশা বেত্রাঘাতে তার মন বিষিয়ে উঠেছিল। অগত্যা একদিন তিনি স্কুল থেকে পালিয়ে যান। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তার ওই পর্যন্তই। বাড়ি ফেরত অস্থির ও আনমনা বালক গিরিশ চন্দ্রকে তার পিতা শানখোলা গ্রামের কৃষ্ণচন্দ্র রায় নামক ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের এক পণ্ডিতের কাছে প্রেরণ করেন। এ পণ্ডিতের কাছে তিনি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য রপ্ত করেন। এরপর চাকরির সন্ধানে তিনি ময়মনসিংহ শহরে আসেন। এখানে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাচারিতে নকলনবিশ হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ময়মনসিংহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মৌলভী আব্দুল করিম ছিলেন ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় পণ্ডিত। চাকরির অবসরে জ্ঞানপিপাসু গিরিশচন্দ্র সেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় পড়তে শুরু করেন। এ সময় তিনি স্কুল শিক্ষক হাওয়ার মানসে শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুবাদে সহজেই তিনি ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের দ্বিতীয় পণ্ডিতের চাকরি পান। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার ময়মনসিংহের মফঃস্বল প্রতিনিধি হিসাবে যোগদান করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি এ পত্রিকায় তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তা ছাড়া তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘সুলভ সমাচার’ নামক দুটি পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। এ সময় নিজ উদ্যোগে ‘মহিলা’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। তৎকালীন পশ্চাদপদ নারী সমাজের জাগরণের ক্ষেত্রে এ মহিলা পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া এ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তার রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ অলঙ্কার না ইধফমব ড়ভ ঝষধাবৎ এ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। পিছিয়ে পড়া বাঙালি নারী সমাজের জাগরণের লক্ষ্যে তিনি ময়মনসিংহে এবং নরসিংদীতে দুটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।
গিরিশচন্দ্র যেমন জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, তেমনি ছিলেন অনেকটা স্বভাবসুলভ বোহেমিয়ান ধরনের। কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ একদিন তিনি ময়মনসিংহ ত্যাগ করে কলকাতায় গমন করেন। কলকাতায় যাওয়ার পর তার সঙ্গে পরিচয় হয় রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্ম ধর্মের তৎকালীন প্রচারক ও প্রধান সংগঠক কেশব চন্দ্র সেনের। তৎকালে কেশব চন্দ্র সেন ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত ব্রাহ্ম নববিধান শাখার আচার্য। অল্প সময়ের মধ্যেই কেশব চন্দ্র সেনের সঙ্গে গিরিশচন্দ্র সেনের সখ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি কেশব চন্দ্র সেনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সনাতন হিন্দু ধর্মের বহুত্ববাদের বিপরীতে একাত্মবাদ তথা ব্রাহ্ম মতবাদে দীক্ষা লাভ করেন। এরপর নববিধান শাখার পক্ষে ভারত এবং বর্তমান মায়ানমারের বহু জায়গায় প্রায় ৪ বছর ব্যাপী ধর্মের প্রচার কাজে অংশগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজ তার নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘ভাই’ উপাধিতে ভূষিত করে। সেই থেকে তিনি ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
এ সময় নববিধান সভার সভ্যগণ সব ধর্মের সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে নিজের মাতৃভাষায় সম্যক রূপে অবহিত হওয়া। গিরিশচন্দ্র সেনের ওপর দায়িত্ব বর্তায় বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের। কিন্তু এ কাজে হাত দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, আরবি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তিনি সম্যকরূপে অবহিত নন। এরপর তিনি অনুসন্ধান করতে থাকেন ভূ-ভারতে অবস্থিত আরবি ভাষা ও সাহিত্যের প্রখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তিত্বকে। তৎকালীন লখনৌতে তিনি এরূপ পণ্ডিতের সন্ধান পান। আরবি ভাষা ও সাহিত্য জ্ঞানানুসন্ধানে তিনি কলকাতা থেকে লখনৌতে গমন করেন। শুরু হয় তার আরবি ভাষা, ব্যাকারণ ও সাহিত্যের জ্ঞানার্জনের প্রথম পর্ব। লখনৌতে আরবি ভাষা, ব্যাকারণ ও সাহিত্যের বিশিষ্ট পণ্ডিত মুফতি মাওলানা এহসান আলীর কাছে মনোযোগ সহযোগে তিনি তালিম নিতে থাকেন। এখানে তিনি দেওয়ান-ই-হাফিজের পাঠও গ্রহণ করেন। এরপর ওস্তাদ মুফতি এহসান আলীর পরামর্শে আরবি ভাষা, ব্যাকারণ ও সাহিত্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান-অর্জনের লক্ষ্যে আবার তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। এখানে তিনি একজন দক্ষ মুফতি মৌলভীর কাছে পুনশ্চ আরবি ভাষার ব্যাকারণ ও সাহিত্য সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞানানুসন্ধান করেন। এরপর আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। এখানে নন্দগোলার মুফতি মৌলভী আলিমুদ্দিনের কাছে আরব জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, ব্যাকারণ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে তিনি আরবি ভাষার বর্ণমালা, শব্দ, ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, ছন্দ, সুর ও তাল সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এভাবে মূল আরবি ভাষা থেকে পবিত্র কুরআন অনুবাদের নানা কলাকৌশল ও দক্ষতা ব্যাপকতর রূপে অর্জন করার পরই তিনি অনুবাদে হাত দেন। অন্য ভাষার একটি গ্রন্থ নিজের মাতৃভাষায় অনুবাদের জন্য ওই মূলভাষা সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের এ বন্ধুর পথ, যা গিরিশচন্দ্র সেন পাড়ি দিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা সত্যি বিরল।
১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত পবিত্র কুরআনের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। নানা আশঙ্কা থেকে এক্ষেত্রে অনুবাদক হিসাবে নিজের নাম তিনি আড়ালে রাখেন। আসলে একজন হিন্দু কর্তৃক পবিত্র কুরআনের অনুবাদকর্মকে মুসলিম সমাজ কীভাবে গ্রহণ করে তা দেখা এবং পর্যবেক্ষণ করার জন্যই অনুবাদক হিসাবে নিজের নাম তিনি আড়ালে রাখেন। অনূদিত গ্রন্থটিতে প্রকাশক হিসাবে গিরিশচন্দ্র সেন এবং মুদ্রক হিসাবে তারিণীচরণ বিশ্বাসের নাম ছিল। ৩২ পৃষ্ঠার এ খণ্ডের মূল্য ছিল মাত্র চার আনা। কিন্তু গিরিশচন্দ্র সেনের আশঙ্কা অমূলকরূপে প্রমাণিত হয়। হাতে গোনা দুই একজন আলেম-ওলামা এর সমালোচনা করলেও অধিকাংশ শিক্ষিত মুসলিম সমাজ তার অনুবাদ কর্মের সবিশেষ প্রশংসা করেন। বহু বুজুর্গ আলেম গিরিশচন্দ সেনের প্রশংসনীয় এ উদ্যোগের সাধুবাদ জানিয়ে ব্রাহ্মসমাজের কাছে চিঠি পাঠান। একটি প্রশংসাপত্রে উল্লেখ করা হয়-আমরা বিশ্বাস ও জাতিতে মুসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতোদৃশ চেষ্টা ও কষ্ট সহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এইজন্য আপনার নিকট আমাদের অত্যন্ত আত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা’।
বস্তুত ধর্মভীরু সিংহভাগ মুসলমানের কাছে পবিত্র কুরআনের প্রথম খণ্ডের অনুবাদ কর্মটি বিপুলভাবে সমাদৃত হয় এবং তিনি প্রশংসার পুষ্পাঞ্জলিতে বরিত হতে থাকেন। তার এ অনুবাদ কর্মটি এতই সাড়া ফেলে যে, নিমিষেই প্রথম মুদ্রণের ১০০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়। ফলে বিপুল চাহিদার নিমিত্তে প্রথম খণ্ডের ঘন ঘন মুদ্রণ বের হতে থাকে। উল্লেখ্য, এতদিন মুসলমান নর-নারী শুধু আরবি হরফে পবিত্র কুরআন পাঠ করতে পারতেন। আরবি ভাষা না জানার কারণে এর মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম হতেন না। গিরিশচন্দ্র সেনের পবিত্র কুরআনের ১ম খণ্ড বাংলায় অনুবাদের ফলে মুসলিম সম্প্রদায় কুরআনের মর্মার্থ যথার্থরূপে জানা ও বোঝার সুযোগ পায়। মুসলিম সমাজের কাছ থেকে এরূপ প্রশংসাসূচক অভিনন্দন বার্তা, আগ্রহ এবং উদ্দীপনা দেখে গিরিশচন্দ্র সেন পবিত্র কুরআনের বাকি অংশ অনুবাদের লক্ষ্যে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। মূলত অভাবিত সাড়া পাওয়ার পর গিরিশচন্দ্র সেন পবিত্র কুরআনের বাকি ২৯ পারা অনুবাদে আগ্রহী হন এবং এ কাজে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ কুরআনের সম্পূর্ণ খণ্ড ১৮৮৬ সালে ১২ খণ্ডে একত্রে প্রকাশিত হয়। মূল কুরআনের পাশাপাশি এ অনুবাদে তিনি বিখ্যাত তফসির গ্রন্থগুলো থেকে সাহায্য নেন এবং টীকা-টিপ্পনী রচনা করেন। সম্পূর্ণ খণ্ডে প্রথম তিনি স্বনামে আত্মপ্রকাশ করেন। তার জীবদ্দশায় পবিত্র কুরআনের তিনটি সংস্করণ বের হয়।
মৃত্যুর প্রায় ২৬ বছর পর ১৯৩৬ সালের ২৪ নভেম্বর নববিধান পাবলিকেশন থেকে গিরিশচন্দ্র সেনের কুরআনের চতুর্থ সংস্করণ বের হয়। এ সংস্কারের ভূমিকা লেখেন মওলানা আকরম খাঁ। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘তিন কোটি মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা, তাহাতে কোরআনের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এদেশের কোনো মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তখন আরবী-পারশী ভাষায় সুণ্ডিত মুসলমানের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তাহাদের মধ্যকার কাহারো কাহারো বাংলা সাহিত্যের ওপর যথেষ্ট অধিকার ছিল। তাহাদের রচিত বা অনূদিত বিভিন্ন পুস্তক হইতে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ তাহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই। এই গুরু কর্তব্যভার বহন করার জন্য সুদূর সংকল্প নিয়া সর্বপ্রথমে প্রস্তুত হইলেন বাংলার একজন হিন্দু সন্তান, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন-বিধান আচার্য কেশবচন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে। গিরিশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে’। উল্লেখ্য, নানা প্রমাণিত দলিল দস্তাবেস থাকা সত্ত্বেও, গিরিশচন্দ্র সেনকে কেউ কেউ পবিত্র কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদকের কৃতিত্ব দিতে সংশয় ও দ্বিধাবোধ করেন। কেউ কেউ অমূলক ও বিভ্রান্তিকর বিতর্ক সৃষ্টি করেন। কিন্তু গিরিশচন্দ্র সেনই যে পবিত্র কুরআনের সম্পূর্ণ ৩০ পারার প্রথম অনুবাদক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান রচিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ‘গিরিশচন্দ্রই সর্বপ্রথম কোরআন শরীফের সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ এবং মিশকাত শরীফের প্রায় অর্ধাংশের অনুবাদ প্রকাশ করেন। ‘কবি আব্দুল কাদির ‘কুরআন মজিদের বাংলা অনুবাদ’ নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘গিরিশ বাবু তার এ অনুবাদ কার্য শুরু করেন ১৮৮১ সালে এবং সমাপ্ত করেন ১৮৮৬ সালে। প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ কোরআনের তরজমাকরণ, মুদ্রণ, প্রকাশনা-সবকিছুই সমাপ্ত হয়ে যায়। ‘প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ তার ‘বাতায়ন’ গ্রন্থে লেখেন, ‘বাংলা ভাষায় তিনি সকলের আগে ওই অনুবাদ করেন। ধর্ম জিজ্ঞাসা ছিল তার অন্তরের অন্তরতম আকাক্সক্ষা। সেই পরম জিজ্ঞাসার মহান তাগিদে তিনি একান্ত যত্নে, একান্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে ইসলাম সম্বন্ধে অধ্যয়ন ও আলোচনা করেন’। এ ছাড়া ডক্টর মুহাম্মদ মজীবুর রহমানের পিএইচডি গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চা’, মাওলানা নূরু মুহাম্মদ আজমীর ‘বাংলা ভাষায় কোরআন পাকের অনুবাদ ও তাফসীর’ প্রবন্ধ এবং অধ্যাপক ড. শফিউদ্দিন আহমদের ‘কোরআনের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’ গ্রন্থে অকাট্য প্রমাণসহ গিরিশচন্দ্র সেনকে পবিত্র কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক হিসাবে বরিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্র সেনের জীবনীকার ড. কাজী মোতাহার হোসেন তার ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তার বিশেষ কৃতিত্ব এই যে তিনি ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্রের আদেশে ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থাদি যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথে পাঠ করে কোরআন শরীফের প্রথম বাংলা তরজমা করেন’।
বস্তুত অসাধ্য শ্রম, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার ফলস্বরূপ কুরআন মজিদের সম্পূর্ণ অনুবাদ শেষে আবেগ-আপ্লুত অনুবাদক, হর্ষ-বিষাদ উপলব্ধি প্রকাশ করেছিলেন, ‘আজ কোরআনের সমাপ্ত দেখে আমার মনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদ উপস্থিত হইয়াছে যে, এতকালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই জন্য যে, ইহার প্রথম অংশ শ্রীমাচার্য কেশব চন্দ্রের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম। তিনি তাহাতে পরম আহ্লাদিত হইয়াছিলেন এবং তার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। শেষাংশ তাহার চক্ষু গোচর করিতে পাইলাম না’। মূলত এই অস্ফুট উচ্চারণ একজন গুরুভক্ত সফল শিষ্যের সাবলাইমের স্মারক অভিব্যক্তি।
পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ছাড়াও গিরিশচন্দ্র সেন আরও ৪১টি গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। তার প্রথম গ্রন্থ ‘ব্রহ্মময়ী-চরিত’ ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় গ্রন্থ হিতোপদেশমালা প্রকাশিত হয় ১৮৭১ সালের ১৩ নভেম্বর। এ ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, ধর্ম ও নীতি ( ১৮ জুলাই-১৮৭৩), ধর্ম-বন্ধু (২০ আগস্ট-১৮৭৬), দরবেশদিগের উক্তি (১৯ আগস্ট-১৮৭৭), নীতিমালা (১৯ আগস্ট-১৮৭৭) দরবেশদের ক্রিয়া (তাসাউফ ১৮৭৮), দরবেশদিগের সাধন প্রণালী (০৭ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯), প্রবচনবলী (২০ জানুয়ারি-১৮৮০), তাপসমালা (১৮৮০-১৮৯৫), তত্ত্ব কুসুম (২০ এপ্রিল-১৮৮২), তত্ত্ব রত্নমালা (২৫ সেপ্টেম্বর-১৮৮২) মহাপুরুষ চরিত (১৮৮৩-১৮৮৬), পরমহংসের উক্তি ও জীবনী (২৪ ফেব্রুয়ারি-১৮৯৩), হাদিসের পূর্ব-বিভাগ (২৪ জানুয়ারি- ১৮৯২) কাব্য লহরী (১৮ জুন-১৮৯৭) হাদিসের উত্তর-বিভাগ (২৫ সেপ্টেম্বর-১৯০৮), চারিজন ধর্মনেতা (২৫ জুলাই-১৯০৬), আত্মজীবনী ( ১৯০৬), মহালিপি (১৯০৯) সতীচরিত (২৫ জানুয়ারি-১৯১১) ইত্যাদি।
মূলত ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ছিলেন একান্তভাবেই নির্লোভ, মুক্তমনা, উদারচেতা এবং অসাম্প্রায়ীক মনোভাবের অধিকারী একজন সাদা মনের মানুষ। ঢাকার গিরিশ প্রেস, নিজ বাস্তুভিটা এবং অর্জিত সমূদয় সম্পত্তি তিনি ১৯১০ সালে ১৫ আগস্ট মহাপ্রয়াণের কিছুকাল আগে মানব কল্যাণে দান করেন। গিরিশচন্দ্র সেন তার জীবনব্যাপী মিশনারিসুলভ কৃত-কর্মের জন্য, সর্বত্যাগী মনোবৃত্তির জন্য, আপন মহৎ কর্ম নিষ্ঠার জন্য , বিশেষ করে ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদক হিসাবে ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানের মনে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।
