চীনে আমেরিকান কবিতার পর্যালোচনা
মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
চীনের কাব্যভুবনে আজ এক আশ্চর্য বৈচিত্র্যের বিস্তার। কারও ভক্তি ফরেস্ট গ্যান্ডারের সূক্ষ্ম নীরবতায়, আবার কারও উল্লাস চার্লস বুকাওস্কির মাতাল চিৎকারে। কেউ উপভোগ করে তার বিদ্রোহী চিৎকারকে মায়াময় অনুবাদের আবরণে, কেউ গ্যান্ডারের নৈঃশব্দ্যে খুঁজে পায় জীবনের মহৎ এক ধ্যান। এ দ্বন্দ্ব নতুন নয়-১৯৯৯ সালের কুখ্যাত পানফেং বিতর্কের পর থেকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল রাইটিং’ শিবির ও কথ্যভাষার কবিদের মধ্যে বিভাজন তীব্র। একদল গ্যান্ডারের কাব্যের দার্শনিক সূক্ষ্মতায় মুগ্ধ, অন্যরা বুকাওস্কির বোহেমিয়ান দুনিয়াকে নিজেদের আত্মপরিচয় হিসাবে গ্রহণ করেছে।
গ্যান্ডার অবশ্য পুলিৎজার পাওয়ার আগেই (২০১৯-এর বহু আগে থেকেই) চীনা পাঠকের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তার Be With (অনুবাদ : ডং লি)-এর ওপর কবি সং লিন লিখেছেন-প্রেম ও মৃত্যুর জটিল মিলন যেন তাওবাদী ধারণা ‘ম্যাটেরিয়ালাইজেশন’-এরই রূপ, যেখানে মানুষ নিজের সীমা অতিক্রম করে অপরের সঙ্গে একাকার হয়। আবার ঝাই ইয়োংমিং তার Mojave Ghost/Knot-এর ভূমিকায় গ্যান্ডারের প্রকৃতিনির্ভর কাব্যচেতনায় খুঁজে পেয়েছেন চীনা দার্শনিক বিশ্বাস ‘মানুষ ও প্রকৃতির সামঞ্জস্য’-এর প্রতিধ্বনি।
অন্যদিকে বুকাওস্কি কখনো চীন সফর করেননি, কিংবা মূলধারার সাহিত্য জগতে বিশেষ সম্মানও পাননি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি হয়ে উঠেছেন কথ্যভাষার কবিদের কাছে এক বিদ্রোহী প্রতীক-প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে থাকা কবিদের ‘great loser’ নায়ক। শেন হাওবো, শিরন বুকসের প্রধান, বুকাওস্কির কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ প্রকাশ করে তাকে চীনে জনপ্রিয় করেছেন। ই শা তার দুটি কবিতার সংকলন অনুবাদ করেছেন। আর ইউ জিয়ান দুটি কবিতা লিখেছেন রিভিউ আকারে, যার একটি কবিতা চীনা কবিতা মহলে বহুল উদ্ধৃত, যেখানে তিনি বুকাওস্কিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে-‘আশ্চর্যজনকভাবে নির্মল/অগভীর হতে ভয়হীন/আর সবচেয়ে বিরক্তিকরভাবে গভীর।’ ইউ জিয়ান, ই শা, শেন হাওবো-তারা সবাই ছিলেন ১৯৯৯ সালের পানফেং বিতর্কে জনতার কবি বা পপুলার পোয়েটস–’র পক্ষে, যা ‘ইন্টেলেকচুয়াল রাইটিং’ শিবিরের কবিদের বিরোধিতা করেছিল। তবে কালের প্রবাহে সে বিভাজন আজ অনেকটা মুছে গেছে। ই শা এখন ‘পোস্টুস্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েটস’-এর অন্যতম প্রচারক, আর শেন হাওবো ‘লোয়ার বডি পোয়েট্রি’র প্রবক্তা।
এই বিভাজনের বাইরে আরেক নাম সর্বজনপ্রিয়-গ্যারি স্নাইডার। তিনি একাডেমিক থেকে আড্ডাঘর, বুদ্ধিজীবী থেকে বিদ্রোহী-সব পাঠকের কাছেই সমান গ্রহণযোগ্য। তার কবিতার দুটি ভিন্ন অনুবাদ ২০১৭ ও ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়-সি চুয়ান ও লিউ শিয়াংইয়াং কর্তৃক। প্রথমজন দিয়েছেন শৈল্পিক, প্রাচীন ছন্দমাধুর্যমণ্ডিত ভাষা, দ্বিতীয়জন নিয়েছেন সহজ কথোপকথনের ভঙ্গি। ইউ চিংয়ের বিশ্লেষণ দেখায়-এ দুটি অনুবাদ দুই আলাদা শিল্পরীতির দিক উন্মোচন করে। পাঠক স্নাইডারের প্রকৃতিনির্ভর কবিতার ভেতর একদিকে দার্শনিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে সামাজিক ও পরিবেশগত সুর অনুভব করতে পারেন, যেমনটি দু ফুর কবিতায় মেলে।
এই বহুমাত্রিক পাঠেই মিশে আছেন আর্থার স্জে। তার The Glass Constellation-র (অনুবাদ : শি চুনবো) পর্যালোচনায় কবি লান লান বলেছেন-স্জে প্রচলিত কাব্যরূপ ভেঙে দেন, হয়তো মহাবিশ্বকে সমগ্রভাবে উপলব্ধি করার তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তাকে এমন আঙ্গিক ভাঙনের দিকে নিয়ে যায়। ইউয়ান ইয়োংপিং তাকে তুলনা করেছেন ‘সালাদ’র সঙ্গে-যেখানে মহাকাশতত্ত্ব, প্রকৃতির গণিত, শাস্ত্রীয় চীনা কাব্যধারা এবং আমেরিকান আধুনিকতার চিত্রকল্প মিশে আছে।
ইংরেজি মূল পাঠ থেকে সরাসরি চীনা ভাষায় লেখা রিভিউও পাওয়া যায়। যেমন-ওয়েন জিংতিয়ান জেন হির্শফিল্ডকে উচ্চ আসনে বসিয়েছেন এক ‘আত্মার কবি’ হিসাবে। তার মতে, দীর্ঘদিন জেন অনুশীলনের ফলে যে জাগরণ, তারই আভাস মেলে হির্শফিল্ডের কবিতায়, যা আবার জাপানি দরবারি কবিতার প্রভাবেও রঙিন। তার কবিতা অনায়াসে প্রবাহিত হয়, পৌঁছে যায় দার্শনিক রহস্যে, কিন্তু কখনোই শব্দের বাড়াবাড়ি করে না। জিংতিয়ান লিখেছেন-‘তিনি ভাষার ওপর নির্ভর করেন না, কারণ ভাষার সীমা আছে অস্তিত্বের জগৎকে সংজ্ঞায়িত করার; অথচ জেন ধ্যানের কোনো সীমানা নেই। তার কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে জাগ্রত হৃদয়’ (Poetry Canon)।
লুও লিয়াংগং ও লিউ নিউয়ান ট্রেসি কে. স্মিথের Life on Mars পড়েছেন ‘ডার্ক ম্যাটার’ ধারণার আলোকে। তাদের মতে, এটি কেবল সায়েন্স ফিকশনের রূপকল্প নয়, বরং আমেরিকার সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতীক- একটি কাচ, যা বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।
চীনা সাহিত্যজগতে সাক্ষাৎকার প্রায়শই হয়ে ওঠে গভীরতর বই-সমালোচনা। যেমন-২০২৪ সালের নভেম্বরে River Yan Journal-এ মা ইয়ংবো জেন হির্শফিল্ডকে জিজ্ঞেস করেন: ‘কী আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে? আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট শিবিরের কবি? আপনার কবিতা কি নারীবাদের সঙ্গে যুক্ত? বিশ্বাস ও কবিতার সম্পর্ক কী? আমেরিকান কবিতায় আপনার ভূমিকা কোথায়?’ হির্শফিল্ড ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন উদাহরণসহ, এমনকি জটিল প্রশ্ন-‘আত্ম-অতিক্রম আর আত্ম-অন্তর্দৃষ্টি কি দ্বন্দ্ব তৈরি করে না?’-এরও জবাব দিয়েছেন নিজের কবিতার আলোয়।
এভাবেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংলাপ ক্রমশ বিস্তৃত। চার্লস বার্নস্টাইনের কবিতায় ফেং ই খুঁজে পান জেন-তাওবাদী রূপ, যেখানে নিহিলিজম ও অস্তিত্ববাদ উলটে যায় এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে। রবার্ট হ্যাসের অনুবাদ নিয়ে লিয়াও লিংপেং বলেছেন-তার শব্দ, আলো ও ছায়ার প্রতি মনোযোগ চীনা শাস্ত্রীয় কবিতার আত্মার সঙ্গে মিলে যায়।
লুইস গ্লিকের কবিতা নিয়ে অবশ্য মতভেদ প্রবল। কেউ বলেছেন তিনি ‘ভালো কিন্তু মহান নন।’ কবি ইয়িং ঝি মনে করেন, এর জন্য দায়ী দুর্বল অনুবাদ। তার মতে, গ্লিকের কবিতা আসলে গভীর, রসালো, বৈপরীত্যময় ও রসিকতায় ভরা। যেখানে চীনা নারী কবিরা ব্যক্তিগত যন্ত্রণায় থেমে থাকেন, গ্লিক অনেক দূরে গেছেন।
শুধু পুরস্কারজয়ী কবিই নন, বরং কম পরিচিত কবিরাও চীনে আবিষ্কৃত হচ্ছেন। রিচার্ড ব্রাউটিগান তরুণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন ‘ভিনগ্রহবাসী’ কল্পনাশক্তির জন্য। তাকে অনুবাদ করেছেন শিয়াও শুই ও চেন শি-যারা নতুন কাব্যভাষার খোঁজে উদ্দীপ্ত। তরুণদের প্রিয় আরেক কবি চার্লস সিমিক- সহজ ভাষায় গভীর মানবিক অনুসন্ধানের জন্য।
আরও সাম্প্রতিক দুই নাম ইলিয়া কামিনস্কি ও ওশান ভুং। বিশেষ করে ভুংয়ের কবিতা ও জীবনের গল্প তরুণদের স্তম্ভিত করেছে। তার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ভিয়েতনামের কবিতা চীনা পাঠকের কাছে নতুন এক দরজা খুলে দিয়েছে-যা পাউন্ড, এলিয়ট বা অন্য কোনো পূর্বপ্রভাবিত নামের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-এখন আর কেউ আমেরিকান কবিদের সঙ্গে দু ফু বা ওয়াং ওয়েইয়ের তুলনা করছেন না। অবশেষে, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কাব্যসংলাপ মুক্ত হয়েছে আবর্তিত প্রতিপ্রভাবের সংকীর্ণতা থেকে।
সূত্র : ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে
