নজরুলের সৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতি
ড. আলী হোসেন চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নজরুল জীবন বিচিত্র এবং নানাভাবেই বর্ণিল। বাংলা সাহিত্যে বহুমাত্রিক প্রতিভায় উদ্ভাসিত এক অবিস্মরণীয় নাম। তার বৈচিত্র্যমণ্ডিত জীবনধারা যেমন বর্ণবহুল উপমায় সন্নিবেশিত, তেমনি তার নানামুখী বর্ণিল সৃষ্টি-সম্ভার নান্দনিক সম্মোহনে আবিষ্ট করে। শিল্পের চমকপ্রদ সৌকর্য নির্মাণের মধ্যদিয়ে নজরুল বিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় নবতর তরঙ্গাভিঘাতে এবং উল্লম্ফনের নবতর প্রেক্ষাপটে উত্তরিত হয়েছেন। নজরুল প্রতিভার এ দীপ্যমান উজ্জ্বলতায় এবং তার উত্থান প্রক্রিয়ায় তার মানস গঠন, তার উদ্দীপনার উৎসস্থল ও পরিচর্যার ক্ষেত্রটি বাংলাদেশ। তার সৃজন ধারার অনুশীলন প্রসারণ ও বিকাশ ক্ষেত্র বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কৈশোরে বাংলাদেশে আগমন ও পরিচয় ঘটে এদেশের মানুষ ও নিসর্গের সঙ্গে। জন্মসূত্রে তিনি ভারতের নাগরিক হলেও সম্মাননা সূত্রে নজরুল বাংলাদেশের নাগরিক। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হলেও মৃত্যু বাংলাদেশে। চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন বাংলাদেশের মাটিতেই। তিনি জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত। সুতরাং, বাংলাদেশের সঙ্গে নজরুলের একটা সরল হিসাব সহজেই নির্ণয় করা যায়। হিসাবটা উভয় দিক থেকে হতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে নজরুলের রচনা, তার সৃষ্টি গান, কবিতা, প্রবন্ধ শক্তির উৎস রূপে কাজ করেছে সর্বোপরি দ্রোহ, সংগ্রামে আর প্রত্যাশা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রণোদনা শক্তি ছিলেন নজরুল। অন্যদিকে নজরুলের প্রত্যাশা ও মানস গঠনে, উত্থানে-উত্তরণে সৃষ্টির নব, নব ধারায় নজরুল জীবনে একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতির। বাংলার লাল মাটি আর কাঁকড়ের দেশে কবির জন্ম স্বভাবতই পূর্ব বাংলার সবুজ শ্যামলের হাতছানি, প্রাণবন্ত দিনখোলা মানুষ তাদের প্রাণময় জীবন ধারা তাকে উৎসাহিত করেছে, করেছে উজ্জীবিত। একটা বিষয় লক্ষ করা যায়, কবি নজরুলের সেই সময়ের পূর্ব বাংলার সঙ্গে যখন থেকে যোগাযোগ ঘটেছে, যখন থেকে তার ক্রমাগত সফর শুরু হয়েছে তখন থেকেই যেন সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার অন্তরজাত প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেছে। তার রচনার কলেবর বেড়েছে, সৃষ্টি ধারার পরিবর্তন ঘটেছে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। কবিকে এ বাংলা আকর্ষণ করেছে, তাই তিনি বার বার এখানে ছুটে এসেছেন।
কৈশোরে ময়মনসিংহ দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তী সময় অনেক উপলক্ষ্য কিংবা উপলক্ষ্য ছাড়া কারণে, অকারণে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। কবি বাংলাদেশে মোট কতবার এসেছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই তবে সাধারণ একটি হিসাবে দেখা যায় ৩০ বারের কম নয়। ভারতের কালকাতা, হুগলি, কৃষ্ণ নগরের তুলনায় ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে তার সাহিত্যিক গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। কবি সেসময় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা দিনাজপুর, মাদারীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, সিলেট, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, বাংলাদেশের এসব অঞ্চলে কবি ভ্রমণ করেছেন, ঘুরে বেরিয়েছেন কখনো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কখনো তার বাইরে। বাংলাদেশে অবস্থানকালে কবির ১১৬টি রচনার সন্ধান পাওয়া যায়, যদিও এ সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আরও রচনার দাবি থাকলেও সংশয়হীন হওয়া যায় না। কুমিল্লা, ঢাকা এবং চট্টগ্রামেই কবির অধিক সংখ্যক রচনা রয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে থেকেও বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে তার অনেক রচনা রয়েছে। বাংলার প্রকৃতি, কবি মনে প্রভাব বিস্তার করেছে তা দেখা যায় চট্টগ্রামে রচিত সিন্ধু প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তরঙ্গ অথবা বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি, চক্রবাক, আমার সাম্পান যাত্রী না নয়, এরকম গান ও কবিতায় কবির অপূর্ব সম্মোহন এবং প্রকৃতির সুষমা দারুণভাবে শিল্পগুণে ঋদ্ধ। তেমনিভাবে কুমিল্লা ও দৌলতপুরে রচিত গান ও কবিতা প্রলয়োল্লাস, নীলপরী, খুকী ও কাঠ বেড়ালি, বিজয়নী, রাজনৈতিক কবিতা গান জাগরণী, মরণবরণ, বিজয়গান, প্রকৃতি যেমন এসেছে তেমনি দ্রোহ ও সংগ্রামের কথা শিশুতোষ আনন্দ এসেছে। ঢাকায় লেখা দাড়ি বিলাপ, চল, চল, চল, নিশি ভোর হলো, বসিয়া নদী কুলে কে গো, আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী, এতজল ও কাজল চোখে, উল্লিখিত গান এবং কবিতায় প্রকৃতি আছে প্রেম আছে আবার হাস্যরসও আছে। দাড়ি বিলাপ কবিতাটি কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে তার দাড়ি কর্তন নিয়ে হাস্যরসাত্মক। নজরুলের প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাগুলোর মধ্যে দেখা যায় কবির নিসর্গের সঙ্গে নিবিড় বন্ধন এবং সখ্য। কোনো কোনো কবিতায় প্রকৃতিই যেন চরিত্র হয়ে ওঠেছে। আর গড়ে উঠেছে কবির বন্ধন আর শোনা যায় প্রকৃতির আত্মার ধ্বনি।
এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা উল্লেখ করার মতো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কবির পরিচয় জ্ঞাপক এবং বাংলা সাহিত্যে নজরুলের স্থান নির্ণায়ক হয়ে ওঠেছে, যা ব্যাপক জনপ্রিয় সেই কবিতা কুমিল্লা থেকে কালকাতা গিয়েই রচনা করেন। এ কবিতার পাশাপাশি রচনা করেন আর একটি কবিতা ‘ভাঙ্গার গান’ (কারার ঐ লৌহ কপাট) এ দুটি রচনার প্রেক্ষাপট কুমিল্লা থেকেই সৃষ্টি। ব্রিটিশ যুবরাজ্যের আগমনের প্রতিবাদে কবি ‘জাগরণী’ গান গেয়ে মিছিল করেছিলেন এবং কুমিল্লায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। তখন তিনি কুমিল্লায় ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েছিলেন এখানকার লব্ধ অভিজ্ঞতা তার চিন্তার ক্ষেত্রে, দর্শনের ক্ষেত্র, কাব্য ক্ষেত্রে এক নবতর উল্লম্ফন, নবতর সংযোজন, নব চেতনার বিস্ফোরণ ঘটে। কুমিল্লায় লেখা না হলেও কুমিল্লা থেকে গিয়ে ২১ সালের ডিসেম্বরে কালকাতার এ দুটি বিখ্যাত সৃষ্টির ঘটনা ঘটে। কালকাতায় বসে লিখলেও কুমিল্লার গোমতী নদী এবং নার্গিসকে নিয়ে লেখা ‘আজো মধুর বাঁশরী বাজে, গানটি। এরকম গান ও কবিতা আছে যা বাংলাদেশে অবস্থানকালে রচিত না হলেও বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে লেখা।
নজরুল জীবন ও কর্মে বহুমাত্রিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতির প্রভাবক ভূমিকা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখা যায় নজরুলের সৃষ্টি উৎস কিংবা মানস গঠনে প্রণোদনা ক্ষেত্র রূপে বাংলাদেশ বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কুমিল্লায় বাংলার শ্যামল-শোভন সবুজ প্রকৃতি যেমন কবির অন্তরস্থিত বোধকে জাগিয়ে তোলে, তেমনি চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে কবি আপ্লুত হন, আত্মস্থ হন।
বাংলাদেশের কুমিল্লাতেই কবির অনেক কিছুরই সূচনা হয়েছে। অর্থাৎ কুমিল্লাতেই কবি জীবনে প্রথম ঘটেছে। তিনি কুমিল্লাতেই প্রথম প্রেমে পড়েন নার্গিসের সঙ্গে, দ্বিতীয় প্রেম প্রমীলার সঙ্গে। প্রথম বিয়ে হয় নার্গিসের সঙ্গে (স্বল্পস্থায়ী) পরে কুমিল্লারই প্রমীলার সঙ্গে বিয়ে হয় কালকাতায়। কবি প্রথম গ্রেফতার হন কুমিল্লাতে রাজনৈতিক কারণে, ‘ভিক্ষা দাওগো পুরবাসী সন্তানদ্বারে উপবাসী’ জাগরণী নামক এ গানটি গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে গাওয়ার সময় প্রতিবাদ মিছিল থেকে। দ্বিতীয়বারও গ্রেফতার হন কুমিল্লাতে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখার হুলিয়ার কারণে। নজরুল প্রথম প্রকাশ্য গায়করূপে আবির্ভূত হন কুমিল্লাতে, গানের প্রথম আনুষ্ঠানিক তালিম নেন কুমিল্লাার ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর কাছে। নিজের গানে প্রথম সুরারোপ করেন কুমিল্লাতে। প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন কুমিল্লা টাউনহল মঞ্চে। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে কুমিল্লাতেই প্রথম যুক্ত হন। অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে। কুমিল্লার দৌলতপুরেই প্রথম তাকে তরুণ কবিরূপে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সুতরাং কুমিল্লা ৫ বারে বৎসরাধিক অবস্থানকালে বহু নতুন অভিজ্ঞতা নতুন চিন্তা ও কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। কুমিল্লার বিপ্লবী নেতা অতীন্দ্র মোহন রায়ের (যার দ্বীপান্তর হয়েছিল পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার অপরাধে) নিয়মিত সান্নিধ্য লাভ করেছেন। আরেকজন প্রকাশ্যে কংগ্রেস নেতা হলেও গোপনে বিপ্লবী দলের নেতা, তিনি হলেন বসন্ত কুমার মজুমদার এবং তার স্ত্রী হেমপ্রভা মজুমদার। কুমিল্লার আরও কয়েকজন কংগ্রেস নেতার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী যিনি পরে রাজ্য কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এ ছাড়াও কবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল কুমিল্লায় শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে (পরে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ) আরও যাদের সান্নিধ্য কবির জীবনে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে তাদের একজন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, (পরে লৌক্ষ্ণ মিউজিক কলেজের অধ্যক্ষ এবং ঢাকার বুলবুল ললিত কলা একাডেমিরও অধ্যক্ষ ছিলেন।) এখান থেকেই কবি ধ্রুপদ সংগীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
ঢাকায় যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে প্রাণের বন্ধু ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তার সঙ্গে কবির দীর্ঘদিন সম্পর্ক ছিল। এ ছাড়া অধ্যাপক আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, আনোয়ারুল কাদির, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তখন কবির গানের আড্ডা ও সাহিত্যের আড্ডা জমত ঢাকার বিভিন্ন বাসায়। এ সময় সম্পর্ক তৈরি হয় কবি আবদুল কাদির ও রাণুসোম, উমা মৈত্র, ফজিলাতুন নেসার সঙ্গে। চট্টগ্রাম কবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে হবীবুল্লাহ বাহার, প্রিন্সিপাল কামাল উদ্দিন, বিপ্লবী নেতা সূর্যসেন, ব্যারিস্টার আনোয়ারুল আজিম। কবি তিনবার চট্টগ্রাম গিয়েছেন তিনবারই ওঠেছেন হবীবুল্লাহ বাহারের মাতামহের বাড়িতে। সেখানে অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে বাহার ও শামসুন নাহার দুই ভাই বোনের সঙ্গে। তারা দুজনই ছিলেন করিব ভক্ত অনরূপভাবে সিলেটে কবি দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী ও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, কুষ্টিয়ায় তারাপদ মজুমদার, ফজলুল বারী চৌধুরী, নিশিকান্ত পাত্র, ফরিদপুরে আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তরুণ কবি জসীম উদ্দীন এবং হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে। খুলনায় ডা. আবুল কাসেম, রংপুরে সাতকড়ি মিত্র। এভাবে বিভিন্ন স্থানে কবির বন্ধু, কিংবা অনুরাগী ভক্ত স্বজন সমতুল্য শুভানুধ্যায়ীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এরকম ভক্ত অনুরক্তের সংখ্যা বিপুল। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নজরুলের উপস্থিতি তার বক্তৃতা, গান ও কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে সবার হৃদয় জয় করেছিলেন, আর এভাবেই নজরুলের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ হয়। কবি বাংলাদেশে হৃদয়িক সম্পর্কে জড়িয়েছেন বার বার। নার্গিস কবির জীবনে প্রথম প্রেম। কুমিল্লার মুরাদনগরের সুন্দরী কিশোরী সৈয়দা খাতুনের প্রেমে পড়েন কবি। প্রেম গভীর থেকে গভীরতা হয়, কবি তার নাম দেন নার্গিস। প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় কিন্তু এক রাতের মধ্যেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় প্রেমে পড়েন কুমিল্লারই আশালতা সেন গুপ্তা’র, আশালতার ডাক নাম দুলী বা দোলন। কবি তার নাম দেন প্রমীলা। পরে কালকাতায় কবির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সারা জীবন প্রমীলা নজরুলের সঙ্গী। নার্গিস এবং প্রমীলা কবির দেওয়া নামেই তারা পরিচিত ছিলেন। কবির হৃদয়াবেগ সম্পর্কিত হয়েছে আরেক জনের প্রতি, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসা। নজরুল ফজিলতের প্রেমে পড়েন। গভীরভাবে ভালোবাসেন। ফজিলত কতটুকু প্রশ্রয় দিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। কবি বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে ৭টি এবং ফজিলতকে ১টি চিঠি দিয়ে ছিলেন। ফজিলাতুন্নেসা কবির জীবনে এক বিষণ্ন অধ্যায়। ফজিলাতুন্নেসার বিয়ের পর কবি লেখেন-‘বাদল বায়ে মোর/ নিভিয়া গেছে বাতি/ তোমার ঘরে আজ/ উৎসবের বাতি/তোমার আছে হাসি আমার আঁখি জল/ তোমার আছে চাঁদ/ আমার মেঘদল’।
ঢাকায় আরেক জনের সঙ্গে কবির হৃদয়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল তিনি রাণুসোম (প্রতিভা বসু)। কবির গানের ছাত্রী। তার সঙ্গেও সম্পর্ক হয়েছে। তিনি কালকাতায় রাণুসোমের গানের রেকর্ড ও করিয়েছিলেন। রাণুকে নিয়ে কবির গান-‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয়’, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, কবির সঙ্গে পরিচয় হয়। তার মেয়ে সুন্দরী আধুনিকা, ঊমা মৈত্র। নজরুল তাকেও গান শেখাতেন। নজরুল তার প্রেমে পড়েন তবে এ প্রেম বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। উমার ডাক নাম নোটন। তাকে নিয়ে কবির গান-
‘নাই পরিলে নোটন-খোঁপায়/ ঝুমকো জবার ফুল’
কবির নিজের মা জাহেদা খাতুনের সঙ্গে বছরের পর বছর যোগাযোগ না থাকলেও বিভিন্ন স্থানে তিনি ‘মা’ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে এমনি তিনজন মায়ের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রমীলার কাকি বিরজা সুন্দরী দেবী। আরেকজন হলেন নার্গিসের খালা এখতারুন নেসা। চট্টগ্রামের বাহার ও নাহারের মাকে কবি ‘মা’ ডাকতেন। কবি যখন কারাগারে অনশনরত কারও অনুরোধেই অনশন ভঙ্গ করছেন না এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন অনশন ভঙ্গ করতে। তখন কুমিল্লা থেকে বিরজা সুন্দরী দেবী জেলখানায় গিয়ে অনুরোধ করেন কবি একমাত্র তার অনুরোধেই অনশন ভঙ্গ করেন। এখতারুননেসা ও বিরজা সুন্দরী দেবীকে নিয়ে কবির কবিতা ও আছে।
কবির সমগ্র জীবনব্যাপী কালকাতায় যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, ভালোবাসা ও অভিভাবকত্বে কাটিয়েছেন তারা দুজন দিনের কবির পরম বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী তারাও বাংলাদেশের। একজন মুজাফফর আহমদ বাড়ি সন্দীপ। তিনি ছিলেন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক। অন্যজন চাঁদপুরের বাসিন্দা সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীন। তারা নিজ প্রভাবলয়ে নজরুলকে অনেক অসুবিধা সমস্যা ও বিপত্তি থেকে রক্ষা করেছেন।
নজরুল জীবন ও কর্মে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতি অনিবার্য এবং অচ্ছেদ্য একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কবির সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ও সৃষ্টির বিচারে এ কথাও বলা যায় বাংলাদেশই নজরুলকে নজরুল রূপে প্রতিষ্ঠা করেছে। নজরুলের অনুশীলন, পরিশীলন ও সৃজনীর ধারায় উৎস ভূমি বাংলাদেশ।
