Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

মিলনের চ্যালেঞ্জ এবং

Icon

ফরিদুর রেজা সাগর

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইমদাদুল হক মিলন সত্তরের ঘরে পা দিচ্ছে। তার জন্মদিন ঘিরে নানা অনুষ্ঠান হবে। তাকে নিয়ে পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হবে। টেলিভিশনের পর্দায় মিলনের নাটকও থাকতে পারে। মিলন সম্পর্কে অনেক কথাবার্তা হবে। সত্তর হলে কি একজন লেখকের ধারা পালটে যায়? সত্তর হলে কি একজন মানুষের জীবন স্বভাব পালটে যায়? কথায় বলে শরীরের সঙ্গে মানুষের মনের কোনো যোগাযোগ নেই। মিলনের শরীর সত্তর বছরের একজন মানুষের, কিন্তু মনটা কখনোই ওই বয়সি মানুষের মতো নয়। মিলন সারা জীবনই তার বয়সের চেয়ে এগিয়ে ছিল। শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো ক্ষমতাবান লেখকের ‘সংশপ্তক’ নতুন করে টেলিভিশনের পর্দায় উপস্থাপনের সাহস ছিল ইমদাদুল হক মিলনের। তরুণ নাট্যকার তিনি। তারপরও সাহস করেছেন-সুহৃদ অগ্রজের কাহিনিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার। তবে এ ব্যাপারে প্রখ্যাত নাট্য পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন এবং রিয়াজউদ্দিন বাদশার ভূমিকাও স্মরণ করতেই হয়। চ্যানেল আই যখন শুরু হয় তখন স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্পর্কে অনেকের নেতিবাচক ধারণা ছিল। ভবিষ্যৎ দেখতে পান বলেই ইমদাদুল হক মিলন তখন চ্যানেল আইয়ের প্রথম দিনের প্রথম নাটকটি রচনার দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন নাটকটি আমি পরিচালনা করব-সেক্ষেত্রেও আমি রাজি আছি।

এই নতুন পরিচালকের নাটকে তখন অনেক বড় শিল্পী অভিনয়ের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আর ইমদাদুল হক মিলন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কণ্ঠশিল্পী শুভ্রদেবকে নাটকের প্রধান শিল্পী নির্বাচন করেন। নিজের বয়সের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন মিলন। ঠিকাদারি কাজ থেকে শুরু, পরে জীবিকার জন্য জার্মানিতে গিয়েছেন। ফলে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা এক শক্তিমান লেখকের রচনা। এই যে এই লেখাটিতে যেমন উচ্চারণ করছি, ইমদাদুল হক মিলন আমার বন্ধু। আমার মনে হয়, চার যুগ আগে যদি এ লেখাটা লিখতাম তখনো লেখার শুরুতেই একই কথা বলতাম, ইমদাদুল হক মিলন আমার বন্ধু। এখন যেমন সে বলে, চার যুগ আগে মিলনও বলত, সাগর আমার কাছের বন্ধু।

সাম্প্রতিক একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে আমি আর মিলন বসেছিলাম। কথার শুরুতে মিলনকে সৌজন্যতায় ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। অনুষ্ঠান চালাকালীন হঠাৎ মিলন দর্শকের উদ্দেশে বলল, সাগর আমাকে ‘আপনি’ করে আলোচনা চালাচ্ছে। কিন্তু এ মানুষটি আমার দীর্ঘকালের বন্ধু। সুতরাং আমরা ব্যক্তিজীবনে পরস্পরকে ‘তুমি’ করে বলি। এ মুহূর্ত থেকে কথামালা ‘তুমি’ করে বললে সহজ হয়।

চ্যানেলটির কয়েক কোটি দর্শকের সামনে যখন মিলন এ উচ্চারণ করেছিল, তখন সব বাঙালির বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমরা দুজনে অনেক দিনের বন্ধু!

মিলন থাকত পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। সেখানে একজন সফল লেখক ছিলেন, যে আমাদেরই বন্ধু। সেই বন্ধুটি আমাদের সঙ্গে ঢাকার নানা পত্র-পত্রিকায় লিখে যাচ্ছিলেন। সম্ভবত তাকে দেখে মিলনের মনে হলো, ওই মানুষটি যদি ওরকম লেখালেখির জন্য আলাদা ‘সম্মান’ নিয়ে সবার বন্ধু হয়ে উঠতে পারে তবে আমি কেন নয়? মিলন লিখতে শুরু করল। তারপর থেকে আর তার কলম থামল না। ‘লেখক’ হিসাবে পরবর্তী সময়ে সে জয় করে নিল পাঠকের মন, সেই ইতিহাস তার সত্তরতম জন্মদিনে অনেকেই লিখবেন। বলবেন। আমি সেই প্রসঙ্গেই যাব না।

শুধু ‘লেখক’ হয়ে ওঠার গল্পটা যে কী ভীষণ কঠিন এবং লেখালেখিতেই শুধু থাকার জন্য নিরন্তর কত ধরনের লেখা তাকে লিখে যেতে হয়েছে তা বন্ধু হিসাবে দেখেছি খুব কাছ থেকে!

আমাদের দেশের বাংলাভাষায় লেখালেখি নিয়ে প্রসঙ্গপূর্বক ব্যাখ্যা করতে গেলে মিলনকে এজন্যই আনতে হবে আলাদাভাবে। শুধু লেখালেখি করে, লেখালেখিতে থেকেই একটা জীবন ধারণ ও চলমান রাখা যে কারো পক্ষে চ্যালেঞ্জ হতে পারে, সে চ্যালেঞ্জ সাফল্যের চেহারা নিতে পারে ইমদাদুল হক মিলন প্রথম আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তা প্রমাণ করেছে। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ প্রমাণের জন্য মিলনকে নানারকম লেখা লিখতে দেখেছি। নানারকম লেখালিখতে যাওয়া মানে নানারকম সমালোচনা। মিলন সবসময় সেই সমালোচনা কাঁধে বহন করার সহ্য শক্তি নিয়ে অবিরত লিখেই গেছে। আমার বন্ধুটি জানত, পৃথিবীতে একটা শ্রেণি আছে, লিখে যায়। আরেকটা শ্রেণি শুধু সমালোচনা করে যায়। তার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল, তার কোন লেখাটা তাকে কোন জায়গায় পৌঁছে দেবে। এ পরিষ্কার চিন্তার মধ্যে কখনো কোনো জড়তা দেখতে পাইনি। মিলন নিজে থেকে একটা লেখা লিখে বলত, বন্ধু আমার এ লেখাটা তোমাদের পড়ার দরকার নেই। কারণ, লেখাটা উপার্জনের জন্য লিখতে হয়েছে। আবার অন্য আরেকটা লেখা শেষ করে বলত, আমার এ লেখাটা পড়ো। ভালো লাগবে। ভালো না লাগলে বকা দিয়ো। বন্ধুর সেসব লেখা পড়ে আমরা গর্বিত হয়েছি।

বন্ধুবৎসল মিলন ছোটদের জন্য একটা উপন্যাস লিখে। ‘চিতা রহস্য’। ছোটদের জন্য অসামান্য রচনা। সেই বইটি উৎসর্গ করেছিল আমাদের সব কাছের বন্ধুদের। আমাদের মন আনন্দে ভরে যায় সেই দিনটিতে। আমিসহ ‘উৎসর্গ’ পাতায় নাম ছিল বন্ধু আফজাল হোসেন, আবদুর রহমান, আলিমুজ্জামান, খন্দকার আলমগীর, দিদারুল আলম আর সাহানা বেগমের। একপর্যায়ে এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় মিলন ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করে ‘নূরজাহান’। আমরা বন্ধুরা প্রতি সপ্তাহে সেই ধারাবাহিকের লেখা পড়ি আর উদ্বেলিত হই। আমরা তখন ‘দৈনিক আজকের কাগজ’ বের করছি। সেখানে সত্যি নূরজাহান-এর একটা রিপোর্ট ছাপা হয়। সে ঘটনাকে পটভূমি করে মিলনের কলম চলতে থাকে। আমরা বন্ধুরা তখনই আলোচনা করছিলাম, এ উপন্যাস একসময় এ দেশের সাহিত্যে বড় আকারের এক সম্মানের জায়গা কেড়ে নেবে। বন্ধু মিলন এখনো যেভাবে তার লেখাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে তার নাট্য রচনাকে, ভালোবাসে তার প্রফেশনকে সেটা নিশ্চয়ই অনেক তরুণের অনেুপ্রেরণা।

পাক্ষিক ‘আনন্দ আলো’র সম্পাদক রেজানুর রহমান বিশেষ সংখ্যা বের করার পরিকল্পনার শুরুতে আমাকে প্রশ্ন করে ‘সাগর ভাই, যদি মিলন ভাইয়ের লেখা চাই তবে তার জন্য কত বাজেট ধরব? কত দিতে হবে তাকে? উনি তো এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবেন না।’ আবার উপন্যাসটি ছাপা হয়ে বেরোনোর পর রেজানুর রহমান এসে বলে, ‘সাগর ভাই, অন্য কোনো লেখক তো ফোন করল না। শুধু আপনার বন্ধু ফোন করল, টাকাটা কবে দিচ্ছি সেটা জানতে।’

মিলনকে লেখার টাকা যথাযথভাবে এবং সময়মতো দিতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, আমার এ বন্ধুটি যে আপাদমস্তক লেখক হিসাবেই আছে। লিখে জীবন নির্বাহ করেছে। লেখালেখির পেশাতেই সে রয়েছে রক্তমাংসে অস্থিমজ্জায়।

সম্প্রতি আমাদের এ বন্ধুটির কলকাতা থেকে বই প্রকাশিত হয়েছে একটি বই উৎসর্গও করেছে আমাকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছে-‘বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর। যে বন্ধুর ঋণ এক জীবনে শেষ করা যাবে না’। আমি বলি বন্ধুর কাছে কোনো ঋণ থাকে না। থাকে শুধু স্মৃতি ও ভালোবাসা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম