Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

১৯৮৮

Icon

ফরিদুল ইসলাম নির্জন

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গভীর রাত। চারদিকে জলারণ্য। ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা অজানা আওয়াজ, মাঝেমধ্যে জলের সুরধ্বনি বাজছে। ঘোর আঁধারে বসে আছে সুফিয়া। বুকের ভেতর শোকের হাহাকার। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় শোকপাথর। আর্তনাদ কেউ শুনছে না। তার কান্নার শব্দ, শোনার কেউ থাকলে তো শুনবে! বহুদূরে জোনাকির আলোর মতো হারিকেন জ্বলছে, সন্ধ্যা তারার মতো জ্বলছে হ্যান্ডলাইট। তারা সবাই যেন বধির, চোখে দেখে না। মাছ ধরতে কেউ এসেছে কিন্তু সুফিয়ার কাছে ভিড়ছে না। মনের ভেতর চাপা আতঙ্ক আর ভয় ঘিরে ধরেছে। মৃত মানুষ নিয়ে কতক্ষণ থাকবে অপেক্ষায়। মানুষ কি অদ্ভুত! বেঁচে থাকলে তার কত যত্ন, কত কথোপকথন, কত ভালোবাসা, কত মায়া, কত হাহাকার। অথচ মরে যাওয়ার পর সে মূল্যহীন। তাকে দেখে অজানা ভয়, বুক ধড়ফড়। পরিস্থিতি এমন, তার সঙ্গে কোনোকালে যেন সম্পর্ক ছিল না, কোনোকালে যেন কথা হয়নি, ভালোবাসা বিনিময় হয়নি, চোখে চোখ রাখেনি, মনের সঙ্গে মন মিলিয়ে দেখেনি, শরীরের সঙ্গে শরীর আলিঙ্গন হয়নি। সে যেন ভিন্ন কোনো গ্রহের, ভিন্ন কোনো মানুষ। অপরিচিত, অজানা কেউ ভয় দেখাতে এসেছে।

চোখের সামনে প্রিয় মানুষটির লাশ ভাসিয়ে দিতে হবে। কত লাশ এভাবেই ভাসিয়ে দেওয়া হয়, কেউ আবার দেয় কলার ভেলাতে। দাফন করার কোনো সুযোগ নেই। চারপাশে অথৈ জলের ভেতর ভাসিয়ে দেবে। চলে যাবে ভাসতে ভাসতে কোনো এক অচেনা গ্রামে, ভাগ্য খারাপ হলে শেয়ালের খাদ্য হবে। কোনো মানুষের দেখা নেই, কারও সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ নেই। এ গভীর রাতেও, সবাই নিজেকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। কেউ মাছ ধরার কাজে, কেউ পরিবার পাহাড়া দেওয়ার কাজে, কেউ আবার দলবেঁধে বসে গল্পগুজবে। সাপের উৎপাত বেশি। কখন এসে ছোবল দেয়, বোঝা মুশকিল।

বুকের ভেতর ধড়ফড় বাড়ছে সুফিয়ার। বাস্তব জীবনকথন যেন কোনো সিনেমার কল্পকাহিনী। যে মানুষটি গত সন্ধ্যারাতে ছিল একসঙ্গে, পাশাপাশি একই বিছানায় ঘুমিয়ে যাওয়ার আগেও কথা হলো, কীভাবে আগমী দিন চলবে তার শলাপরামর্শে দুজনের আলাপন। অথচ এ গভীর রজনিতে নিথর দেহ, মৃত মানুষ। মানুষের মৃত্যু কত সহজ, কত নির্মম। মানবজনমে আসার সিরিয়াল আছে, যাওয়ার নেই। ভাবতেই চোখজুড়ে আষাঢ়ের ঢল। জীবন যেন ভাসমান কস্তুরি, কখন কোনখানে গিয়ে থামে, কেউ বলতে পারে না। ছোট মেয়েটির দিকে তাকাতেই তার হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে একাকার। মেয়েটি জীবনে কখনো আর বাবা ডাকতে পারবে না, বাবার কাঁধেতে চড়ে কখনো আর হাঁটে বা খেতে-খামারে যেতে পারবে না। কখনো আর বাবার সঙ্গে, একসঙ্গে বসে খেতের আইলে ভাত খেতে পারবে না। যার বাবা নেই, সে যেন মরুভূমির ভেতর বিধ্বস্ত কোনো পথিক, সে যেন মাঝিবিহীন নৌকার যাত্রী। বাবা মানে মাথার ওপর আকাশ, একবার অনুভব করেন, মাথার ওপর আকাশ না থাকলে কি হবে আপনার।

পাশের ঘরটি ডুবে, শুধু চাল কোনোমতে জেগে আছে। সেই ঘরটি একটু বেশি নিচু ছিল। ঘরের চালে মুরগি আর সাপ একসঙ্গে। এ নির্জন রজনিতে বিপদে সবাই যেন এক হয়ে পাশে, এটা এক নজিরবিহীন। এদিকে সুফিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিতে কাউকে খুঁজছে, কিন্তু কেউ তো নেই। সবাই যেন হারিয়ে গেছে রূপকথার দেশে, যাদের দেখা যায়, তারা ভূতের নগরীর কেউ।

সুফিয়ার স্বামী মোবারক আলী। বছর পাঁচেক ধরে তারা বিয়েতে জুটি বেঁধেছে। নতুন সংসার স্বপ্নের ভেতর বাঁচিয়ে রেখেছে তারা। সুফিয়ার শরীরের রং উজ্জ্বল না হওয়ার জন্য এলাকায় বিয়ের প্রস্তাব তেমন আসত না। এত গুণবতী তবুও যেন তার শরীরের রং নিয়েই মাতোয়ারা সবাই। সত্যিকারভাবে যারা বলে বেড়ান, নারীদের শরীরের রং কিছু নয়, তাদের গুণ সবকিছু। একটা সময় তার প্রিয়জন খুঁজতে ঠিকই শরীরের রং দেখে জীবনসঙ্গী বেছে নেন। কতজন এসে কতোভাবে বুঝিয়ে যেত কিন্তু বিয়ে করার কথা কেউ বলত না। মোবারক আলীর বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। কোনো ভাই-বোন নেই। কিছু জমিতে হালচাষে জীবন চলত। কোনো কোনো দিন অন্যর জমিতে কাজ করে দিত, বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে ভালোই জীবন চলত। সুফিয়া বাবার কাছে যে জমির ভাগ পেত, তা ভাইদের কাছে বিক্রি করে সেই টাকা বরকে দেওয়ার শর্তে, একই গ্রামে বিয়েতে জুটিবদ্ধ হয়।

মোবারক আলী ভীষণ সরল-সহজ। মারপ্যাঁচ কিছু বুঝত না। গতরাতে শুয়ে ছিল একসঙ্গে। একসময় হঠাৎ পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে লাফিয়ে ওঠে। সিঁথান থেকে লাইট নেয়, তারপাশেই টেঁটা ছিল সেটা হাতে নেয়। আলো ধরতেই দেখে বড় কিছু পানিতে নড়ছে। এমনটি দেখে তড়িঘড়িতে বুঝতে পারে, তাদের মেয়ে জলি পানিতে। জলির মা লাফ দেয় পানিতে, দ্রুত তাকে তুলে জড়িয়ে ধরে। সুফিয়া দ্রুত ঘুম থেকে উঠে দেখে, জলি নেই তার পাশে। পানিতে তার স্বামীর হাতে। দুই হাতে করে জলিকে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দেয়। পেটে চাপ দিয়ে, মুখে মুখ মিলিয়ে পানি বের করে সুস্থ হয়। জলির জ্ঞান ফেরে। তারপর বুকে জড়িয়ে নেয় সুফিয়া। হাউমাউ করে কান্নার বেগ তোলে। মেয়েটির শেষ জীবন হতে পারত আজকে। জলিকে ঘুম পড়িয়ে, শুয়ে পড়ে তারা। সুফিয়ার আবার ঘুম ভেঙে যায়। বুকের ভেতর আনচান, কেমন যেন ভয়, শূন্যতা। তারপর দেখে জলি ঘুমিয়ে। কিন্তু তার স্বামীর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। ‘জলির বাবা, ও জলির বাবা’ বলে ডাকে, তবুও কোনো প্রতিউত্তর মেলে না। এবার তার ভয়টা বেড়ে যায়। মাথার ভেতর দুঃশ্চিন্তা হানা দেয়। হাতের রগ দেখে, কিন্তু নড়ে না, কথা বলে না। তার এ ডাকের চিৎকারে জলির ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে কান্নায় ব্যস্ত হয়। এক পর্যায়ে বুঝতে পারে সে আর বেঁচে নেই, জগত থেকে চিরবিদায়। তবে তার মনের ভেতর প্রশ্ন ঘুরপাক, কীভাবে মারা গেল তা বুঝছে না। তার হৃদয়জুড়ে হরেক রকমের সন্দেহ অভরায়ণ্য। কেনো ভূত-প্রেত, জিন-পরি গলা টিপে মেরে ফেলেনি তো, আবার ভাবছে সাপের কামড়ে মরছে। সুফিয়ার মা-বাবাও অনেকে আগেই বলেছিল, এখানে বাড়ি না নিতে। যেখানে কোনো প্রতিবেশি নেই, সুখ-দুঃখ দেখার কেউ নেই, একাকী থাকার সেখানে কোনো মানেই হয় না।

১৯৮৮ সাল। হঠাৎ করে লাগাতার বৃষ্টি। উজান থেকে জলের আগমন। এমন বৃষ্টি আর হুটহাট জলের আগমন কয়েক দশকে হয়নি। ক্ষণিকের মধ্যে ডুবে যায় চারদিক। মানুষ বুঝে ওঠার আগেই, বাড়ি-ঘর তলিয়ে যায়। অলিদহ গ্রামের বাড়িগুলো বেশ দূরে দূরে। পাঁচটি পাড়ার ভেতর মধ্যেপাড়ায় একটু ঘনবসতি। তা ছাড়া সবখানে দূরে দূরে ঘর বাড়ি। ঘরগুলো টিনের, তবে সবার না। বেশিরভাগ পাটখড়ি দিয়ে বেড়া, ঘরের চালে ছন। সেই ছনের ওপর আবার পলিথিনের কাগজ দিয়ে মোড়ানো। কোনো ঘর ছন দিয়ে বানানো, ছন দিয়েই বেড়া। ঘনবসতি পাড়াতে ছোট ছাপড়ার সংখ্যা বেশি, বাঁশ দিয়ে মাচা পাড়া। কেউ কেউ টালির চাল, বেড়া দিয়েছে পাটখড়িতে। সেখানেই রাত যাপন। বন্যায় সব তলিয়ে গেছে। হঠাৎ করে মানুষ জলবন্দি হয়ে যায়। নিজেদের কীভাবে বাঁচাবে তার জন্য সবাই উন্মাদ, বেঁচে থাকার আকুতি। বেশিরভাগ মানুষের গরু-ছাগল ছিল, রাখার কোনো যায়গা না পেয়ে, নিরুপায় হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। যেদিকে মন চায়, চলে গেছে সেদিকে। কেউ আবার ঘরের চালেই রেখেছে। মৃত গরু, ছাগল বা অন্য প্রাণী ভেসে বেড়াচ্ছে। কখনো দেখা যাচ্ছে কলার ভেলাতে মানুষের লাশ ভেসে যাচ্ছে..., হাঁস মুরগি সবচেয়ে বেশি বিপদে। সাপে, শেয়ালে খেয়ে ফেলে। কোনো কোনো মুরগি পানিতে পড়েই মারা যাচ্ছে। হাঁসগুলো সারা দিন জলের ভেতর ঘুড়ে বেড়ায়, রাতে একটু আশ্রয়ের জন্য খুঁজে জায়গা পায় না। পরে রাতেও থাকে জলের ভেতর। সে সুযোগটা শিয়াল নেয়। মানুষ কীভাবে থাকবে বেঁচে, কী খাবে, সেটার ভেবে দেখার সুযোগ নেই, আর প্রাণীকূলের চিন্তা। কেউ টিনের চালের ওপর বাঁশের মাচা পেরে রয়েছে। মাইল দশেক দূরে বিশ্বরোড চলে গেছে। সুফিয়া আর মোবারক যেতেও চেয়েছিল প্রথমে। কিন্তু ঘর ছেড়ে যাওয়াটা তারা মেনে নিতে পারেনি। সেখানে জায়গা পাওয়াটাও কঠিন। সেই বিশ্বরোডের রাস্তা ইটের খোয়া। গাড়ি চলাচল বন্ধ। রাস্তার পাশে সারি সারি কুঁড়েঘর তুলে রয়েছে মানুষগুলো। বিপদি মানুষের মিলনমেলার। খাবারের সীমাবদ্ধতা, বেঁচে থাকার লড়াই। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘হে মহাজীবন’ কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন দুটির মতো, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’।

কেউ গমের ছাতু খেয়ে, মুড়ি ভিজিয়ে, কেউ আটা দিয়ে ফেন বা রুটি বানিয়ে, কেউ চিড়া ভিজিয়ে খায়। ভাত খুব কম মানুষই রান্না করছে। তরকারিতে কারও লবণ, কারও ঝাল কম, মোট কথা বেঁচে থাকার জন্য রান্না, স্বাদের জন্য নয়। রিলিফ আসবে, আসবে বলছে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। কত এনজিও থেকে মানুষ আসে। প্যান্ট আর জামা পরা মানুষ দেখলেই দৌঁড়ে এগিয়ে আসছে। একটু আকুতি, একটু বেঁচে থাকার ছায়া, একটু খাবারের জোগান...। এ বুঝি কিছু দিয়ে যাবে। প্যান্ট পরা মানুষ দেখলেই বড় কোনো অফিসার ভাবছে। তাকে চারপাশ ঘিরে ধরছে লোকজন। তারা প্রশ্ন করছে, ‘আপনারা কি খেয়ে বেঁচে আছেন’? সবার কাছ থেকে উত্তর শুনে... আশ্বাস দিচ্ছে খুব শিগ্গির চাল, ডাল, তেল, বিস্কুট এনে আপনাদের দেওয়া হবে। তাদের এই আশ্বাস বুকে ধারণ করে নিচ্ছে। সেসব লোকদের কিছু না খাওয়াতে পেরে অনেকের কষ্টে হৃদয় ফেটে পড়েছ। কিন্তু যারা লিস্ট করছে, তারা আর ফিরে আসছে না। তারা আসবে, আসবে বলে সবাই বিশ্বাস আর ভরসা দিলেও, তারা আসছে না।

গতকাল মোবারক আলী সারা দিন কাজ করেছে। মোবারক আলী মানে সুফিয়ার স্বামী। তাদের ঘরের জন্য বাঁশ ছিল না। মধ্যে পাড়ার নামদার আলীর বড় বাঁশবাগান, সেটাও ডুবন্ত। তাকে মাছ দেওয়ার শর্তে বাঁশ দেওয়ার সম্মতি দেয়। পানির ভেতর বহু কষ্টে বাঁশ কেটে, তা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর ঘরের ভেতর বাঁশ দিয়ে কোনো রকমে তারা তিনজন শুতে পারে, সেই ব্যবস্থায় গড়ে তোলে বাঁশের মাচা। পোশাক-আশাক তেমন নেই। পাতিলগুলো একটি বস্তায় তুলে বাঁশের ডাবে রেখেছে। কেউ কেউ ডিঙ্গি নৌকার ওপর সময় পার করছে, সেখানে মাটির চুলাতে অনেক কষ্টে রান্নায় ব্যস্ত। তবে সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাতে হয়, যখন বৃষ্টি পড়তে থাকে, কেউ বড় কচুর পাতা মাথায় ধরে রাখে। আসলে এত পানি ভাবতেই সবাই দিশেহারা।

সুফিয়া ভাবছে তার স্বামীর লাশ কি করবে। এভাবে কলার ভেলায় ছাড়া যদি ভাসিয়ে দেয়, তাহলে অনেকেই তাকে সন্দেহ করবে। কেউ ভাববে সেই হয়তো তাকে মেরে ফেলে লাশ গুম করেছে। তার কারাগারে যাওয়বার আগেই, ভংয়কর শাস্তি দেবে গ্রামের মানুষ, তারপর হয়তো পুলিশে ধরিয়ে দেবে। একপর্যায়ে খুনি হিসাবে ফাঁসি হয়ে যেতে পারে..., নানা রকমের জল্পনা-কল্পনা সৃষ্টি হবে। তাই লাশ সকাল পর্যন্ত রেখে, তারপর কোনোভাবে হোক একটা কিছু করা যাবে। এ সমাজে সবার পরামর্শ ছাড়া, নারীদের একক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। বুকের ভেতর জলিকে জড়িয়ে রেখেছে। হারিকেনের আলো জ্বলছে। চোখের সামনে মোবারকের সবকিছু ভেসে বেড়াচ্ছে। হৃদয়ে কান্নার ঢল নামছে।

অনেক ভাবনার ভেতর, তার মনের গহিনে একটা প্রশ্ন খোঁচা দিচ্ছে, ‘বেঁচে থেকেই কি লাভ’। যে মানুষটির জন্য সংসার, যার জন্য জীবনবন্দি সেইতো নেই। তাহলে কিসের আশায় সে বেঁচে থাকবে, কার সঙ্গে সংসার করবে। তারচেয়ে গলায় কিছু পেচিয়ে মারা যাওয়াই শ্রেয়। আবার একবার ভাবছে, মরে গিয়েই কি লাভ। সে মারা গেলে, কারও কিছু হবে না। কয়েকদিন শোকে কাটবে, তারপর ভুলেই যাবে। মুখে মুখে রব উঠবে, মেয়েটি আত্মহত্যা করে, নিজেকে মুক্তি দিয়েছে। বেঁচে থাকলে তো অসীম বেদনা বয়ে বেড়াতে হতো, দুঃখের সীমা থাকত না। এসব ভাবতে ভাবতে জলির দিকে তাকায়। তারপর চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরে। জলির জন্য হলেও তার বাঁচতে ইচ্ছে হয়। সে মারা গেলে মেয়েটির কি হবে, মেয়েটিকে কে দেখবে! আবার সুফিয়া মনে করে, তার মেয়েকে পানিতে ফেলে দিয়ে, তারপর সে আত্মহত্যা করবে। সারা জীবন ধুকে ধুকে মরার চেয়ে, মানুষের করুণা নিয়ে বাঁচান চেয়ে, মরে যাওয়া শ্রেয়। এটা সহজ পথ। কিন্তু নিজের বেঁচে থাকার অধিকার না থাকলেও, মেয়েটির বেঁচে থাকার অধিকার আছে। মেয়েরা নিজের জন্য কিছু করে না, তাদের জন্ম হয়েছে অন্যর জন্য। নিজের কোনো কিছু নেই। বাবার বাড়ি, তারপর শ্বশুড় বাড়ি এভাবেই চলে তাদের জনম। তার মেয়ের সংসার করার অধিকার আছে, দুনিয়ার সুখ বা দুঃখের অনুভব করার অধিকার আছে। তাই বেঁচে থাকাই শ্রেয়। যে জমি আছে, তা নিজে নিজে চাষ করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। জল নেমে গেলে, এখান থেকে বাড়ি সরিয়ে নেবে। তারপর ভাইদের কাছে বাড়ি করবে। এখানে একাকী থাকা ঠিক হবেনা।

ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে। ডান হাত দিয়ে লাইট ধরতেই দেখে মস্ত বড় এক সাপ। ফণা তুলে তাকিয়ে লাইটের দিকে। চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। তার বুঝতে বাকি নেই, এই সাপটি তার প্রিয়তমকে কেড়ে নিয়েছে। আবার এসেছে, নতুন কাউকে কেড়ে নিতে। কোলে তার মেয়েকে জড়িয়ে রেখেছে। ক্রোধে হৃদয় ফেটে যাচ্ছে। চোখ রক্তিম সূর্যের মতো টকটকে লাল। যে কোনো সময় মণি বেরিয়ে আসতে পারে। মনের ভেতর একটাই পণ, যেভাবেই হোক সাপটিকে মেরে ফেলতে হবে। স্বামীর হত্যকারীকে মারার এটাই বড় সুযোগ। মোবারক আলীর পায়ের কাছে সাপটি। বুকের ভেতর হালকা ভয়ও কাজ করছে। যদি সাপটে এসে ছোবল দেয়, তাহলে কি হাল হবে। সুফিয়া সেসব ভয়কে ছুড়ে মারে। মনের ভেতর শক্তি সঞ্চয় করে। এবার সে মেয়েটিকে কোল থেকে বিছানায় বসিয়ে রাখে, শরীরের সঙ্গে হেলান দিয়ে নেয়। আরেক হাত দিয়ে আলো জ্বালিয়ে রাখে। হাতের কাছেই মাছ ধরার টেঁটা ছিল। ধীরে ধীরে সেটা হাতে নেয়। তারপর সেটা দিয়ে মারে। তার সব রাগের বহিঃপ্রকাশ। তার নিশানা মিস হয় না। মাথাতে লেগে সাপটি টেঁটা পেঁচিয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গেই জলিকে আবার জড়িয়ে ধরে। ভয়ে কাঁপতে থাকে। শরীরের ইন্দ্রিয়গুলো নড়ে ওঠে, রক্তপ্রবাহ বন্ধের মতো। শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। তারপরও প্রশান্তি, সাপটিকে মেরে ফেলতে পেরেছে। তার স্বামীর হত্যাকারীকে নিজে শেষ করতে পেরেছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম