|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আবেগ, চিন্তা, তথ্য প্রকাশের অনন্য প্লাটফর্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একদিকে মানুষের জীবনকে উন্নত করে তুলেছে, অন্যদিকে এর অপব্যবহারে সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন অপকর্ম, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশে-বিদেশে কী ঘটছে তা ছবিসহ তাৎক্ষণিকভাবে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছে সবাই। তথ্য, ছবি, ভিডিও, নিজস্ব মতামত ইত্যাদির আদান-প্রদানও খুব সহজ হয়ে গেছে।
সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মানুষকে আধুনিক করে তুলছে দ্রুত, অপরদিকে নিঃসঙ্গতা অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরছে আষ্টেপৃষ্ঠে। একদিকে মানুষ ক্যারিয়ারের পেছনে যন্ত্রের মতো ছুটে চলছে, অন্যদিকে জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছে মানবিক গুণাবলি।
এ মাধ্যমগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং দিন দিন পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। কাছের মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে আর দূরের মানুষ কাছে আসছে। স্কুল-কলেজের পুরোনো বন্ধু-বান্ধব নতুন করে উষ্ণ সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে পরিবারের আপনজনদের বহুদিনের বিশ্বাস ও নির্ভরতায় ফাটল ধরছে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সন্দেহ করছে, কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে নানারকম অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে ভাঙছে মানুষের সাজানো সংসারও।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষতিকর দিকগুলো হলো-অনেকে প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে আকর্ষণীয় ছবি দিয়ে ফেক আইডি খুলে মানুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্নভাবে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে। গোপন ছবি, অন্তরঙ্গ ভিডিও ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে নানাভাবে হেনস্তা করে। তরুণ-তরুণীরা প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে এবং আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।
কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ভুল, বানোয়াট খবর অপপ্রচার করে এবং অনেকে তা সত্য বলে মেনে নেয়, বিন্দুমাত্র যাচাই না করে। ফলে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহের সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনার জন্ম দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যা এদেশের বহুদিনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ফাটল ধরিয়েছে। এছাড়া সমাজে অস্থিরতা, ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া এবং বিয়ে বিচ্ছেদের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, এখানে গড়ে প্রতিদিন ৩৯টি বিয়ে বিচ্ছেদ, প্রতি ঘণ্টায় একটি বিয়ে বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া পুরো দেশে বিগত সাত বছরে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইদানীং আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
এই মাধ্যম আমাদের মানবিক গুণাবলিকে প্রভাবিত করছে। মানি লন্ডারিং, আক্রমণাত্মক গেম্স, ধর্ষণের মতো অপরাধেও জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকে। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। মানসিকভাবে আমরা অনেকে আনস্টেবল অবস্থায় আছি। এর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে রাগ, ক্রোধ, অবসাদ, বিষণ্নতা, একাকিত্ব, হতাশা ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার রোধ করতে পারলে উল্লিখিত সমস্যার সমাধান সম্ভব। এর নেতিবাচক দিকগুলো পরিহার করে ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করা জরুরি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিবারের কর্তা ও কর্ত্রীর সচেতন হওয়া। সন্তানদের সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া, সব ধরনের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া এবং বন্ধুসুলভ আচরণ করা। ভুল পথে গেলে সন্তানকে তা বুঝিয়ে বলা, প্রাপ্তবয়স্ক না হলে হাতে স্মার্ট ফোন তুলে না দেওয়া।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার না করে এর প্রয়োজনীয় ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারের আপনজনদের সময় দিতে হবে। তবেই নির্মল আনন্দে কাটিয়ে দেওয়া যাবে ক্ষুদ্র জীবনের বাকিটা সময়।
সারমিন মতিন মিতু : কবি ও প্রাবন্ধিক
