Logo
Logo
×

অল্পকথা

শিকড়ের সন্ধান দেয় লোকসংগীত

Icon

শাকিরুল আলম শাকিল

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কৃতি একটি প্রবহমান ধারা। এ প্রবাহের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কৃষ্টি-কালচার, রীতিনীতি, জীবনসংগ্রাম, কর্ম, ধর্ম, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান। আর এ প্রবাহের ধারাকে বহমান রাখে সেখানকার শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, চিত্রকর্ম। এই নিয়ামকগুলো মেলবন্ধন ঘটায় যুগের সঙ্গে যুগের। সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী মাধ্যম হলো সংগীত। আর লোকসংগীত হলো সংগীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা। এই ধারা সমাজজীবনের সাধারণ পেশাজীবী থেকে উচ্চবর্গীয় মানুষ, রাজমহল থেকে গ্রামীণ চাষাভুষা ঘরের মানুষ-সবার জীবনদর্শন ও জীবনভাবনাকে ধারণ করে। লোকসংগীতকে কেবল গায়কের কথা, সুরের মাধুর্য বা একতারা-দোতারা-সারিন্দার মূর্ছনা দিয়ে বিচার করলে অন্যায় হবে। লোকসংগীতকে উপলব্ধি করতে হবে আরও গভীর থেকে। এই সংগীতের নেপথ্যে লুকিয়ে থাকে কোনো ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা জাতির দীর্ঘকালীন জীবনযাপনের চিত্র, উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, ব্যাপ্তি, সংস্কার ও বিশ্বাসবোধের ইতিহাস; যা তাদের সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় আঞ্চলিক ও ভৌগোলিক রূপভেদ। এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যই তাকে অন্য সংগীত থেকে পৃথক করে দেয়। এককথায়, সমাজজীবনের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে লোকসংগীতে। বাংলাদেশের লোকসংগীতের ভুবন বৈচিত্র্যময়। এখানকার হাওড় অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা বিধৃত হয়েছে ভাটিয়ালির সুরে। নৌকা-মাঝি-মল্লার এই গানে যেমন নদী ও নদী-তীরবর্তী মানুষের জীবনের জয়গান গাওয়া হয়েছে, অথই জলে মাঝির বিরহ আকুলতার কথা বলা হয়েছে, তেমনই অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমি উত্তরবঙ্গের নিজস্ব গীতরীতি ও সুর সংযোজনায় সে অঞ্চলের মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা উঠে এসেছে ভাওয়াইয়া গানে। এই গানে রয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নানা চড়াই-উতরাই, অভিজ্ঞতা ও সাহসিকতার কথা। ভাওয়াইয়া গান রচিত হয়েছে মূলত নারী-পুরুষের প্রণয় ও বিচ্ছেদের ভাবের মিশেলে; তবে আধ্যাত্মিক চেতনাও পরিলক্ষিত হয় কিছু কিছু গানে, যেমন ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’। লোকসংগীতের এই বৈচিত্র্য কেবল ব্যক্তি, অঞ্চল বা সমাজজীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধেও তা দৃশ্যমান। এর একটি উদাহরণ হলো গম্ভীরা। শিবের বন্দনা করে রচিত হয় গম্ভীরা। অতীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শিবপূজাকে কেন্দ্র করে গম্ভীরা অনুষ্ঠানে একতাল, ত্রিতাল, দাদরা, খেমটা বা কাহারবা সুরে গম্ভীরা গান পরিবেশন করতেন। তবে বর্তমানে এ পরিবেশনায় কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। বাঙালি মুসলমান সমাজেও লোকসংগীতের প্রভাব স্পষ্টত ফুটে ওঠে। পির-আউলিয়া, সুফি-সাধকদের আল্লাহ-রাসুলের প্রতি ভক্তিমূলক গান বা বন্দনার সুরে বাউল গান তারই উদাহরণ। এসব ছাড়াও পল্লিগীতি, সারি, জারি, ভক্তিগীতি, দরবেশি, রাখালিয়া, আলকাপ, কুশানগান, মুর্শিদা, ঝুমুড়, পূর্বালী, গোয়ালপাড়িয়া বা সিলেটি সংগীত বাংলা লোকসংগীতের অনন্য ধারা।

লোকসংগীতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো জীবনঘনিষ্ঠ এ গান রচিত হয় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে, আবার পরিবেশিতও হয় তাদের উদ্দেশে। আবহমানকাল থেকে মানুষ জীবনসংগ্রাম থেকে সঞ্চারিত অভিজ্ঞতাগুলোকে ভাবের আকারে গানের ভাষায় রূপায়িত করে আসছে। এই ভাবের গীত পূর্বপুরুষদের সঞ্চারিত অভিজ্ঞতাকে পৌঁছে দেয় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। বর্তমানে আক্ষরিক অর্থে লোকসংগীতকে ম্রিয়মাণ মনে হলেও আশার কথা হলো, দিনদিন এই সংগীত গ্রামীণ বাংলা ও বাঙালি মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন সংগীতজগতের দিকে বিস্তৃত হচ্ছে।

শাকিরুল আলম শাকিল : শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

shakil.shakirulalam@gmail.com

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম