সমাজব্যবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা
শ্রী চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যখন ধর্মের গ্লানি হয় ও অধর্মের উত্থান হয় তখন ভগবান এ জগতে আবির্ভূত হয়ে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমে ধর্ম সংস্থাপন করেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির পুণ্য লগ্নে আবির্ভূত হন। অষ্টমী তিথিতে আবির্ভূত হন বলে এই দিনটি জন্মাষ্টমী হিসাবে উদ্যাপন করা হয়। তার অনন্য জীবনাদর্শ ও কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুনকে নিমিত্ত করে প্রদত্ত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শাশ্বত জ্ঞান সমগ্র মানবজাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থাপনায় অত্যাবশ্যক বিষয়গুলোর অন্যতম হলো সংযত ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন, ন্যায়বিচার, সাম্যবাদ, সৎ কর্ম, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অমিয় বাণীর মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ এসব শিক্ষাই জগৎ কল্যাণের জন্য দিয়েছেন।
ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে আত্মতত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন-প্রতিটি জীবই প্রকৃত স্বরূপে আত্মা; আর এই দেহটি ঠিক পোশাকের মতো অনিত্য। সুতরাং, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, মানুষ-পশু প্রভৃতি আমাদের বাহ্যিক পরিচয় মাত্র। এসব বাহ্য পরিচয় গৌণ করে যিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদে সব শ্রেণির মানুষ, এমনকি পশুপাখির প্রতি সমদর্শী হন, তিনিই যথার্থ জ্ঞানবান। যিনি সব জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখের অনুরূপ সমানভাবে দর্শন করেন, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। এভাবে শ্রীকৃষ্ণ আমাদের প্রকৃত সাম্যবাদের শিক্ষা প্রদান করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ শৈশব থেকে বিভিন্ন অসুর নিধন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে কংস, জরাসন্ধ ও শিশুপালের মতো দুষ্কৃতকারী রাজাদের পরাস্ত করে অন্যায়কে প্রতিহত করেছেন। অর্জুনকে মহাভারতের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে তিনি দুর্যোধন-দুঃশাসনের মতো অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছেন। প্লাবদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তিনি সমাজে ন্যায়ের স্থাপনা করেছেন। জনসাধারণকে পরিচালিত করার মহৎ দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত হয়েছে, তাদের কর্তব্য সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন (গীতা ৩.২১), ‘শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষ তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সারা পৃথিবী তারই অনুসরণ করে।’ রাষ্ট্রপ্রধান, পিতা ও শিক্ষক স্বাভাবিকভাবেই জনগণের পথপ্রদর্শক। তাই তাদের উচিত, শাস্ত্রের বাণী উপলব্ধি করে, শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে জনসাধারণকে পরিচালিত করে এক আদর্শ সমাজ গড়ে তোলা। এর ফলে যে সমাজ গড়ে উঠবে, তাতে প্রত্যেক মানুষের জীবন সার্থক হবে।
শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ অনুসারে পরিচালিত আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন) একটি সমাজসেবামূলক সনাতন ধর্মীয় আন্তর্জাতিক সংগঠন। সারা পৃথিবীতে এর ৮ শতাধিক মন্দির রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইস্কন দেশব্যাপী লাখ লাখ মানুষের মাঝে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ মানবতার স্বার্থে অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম, ছাত্রাবাস ও মেডিকেল সেবার মাধ্যমে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক, সেবামূলক কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ইতোমধ্যেই ইস্কন ফুড ফর লাইফ সারা বিশ্বে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণকারী সর্ববৃহৎ সংগঠন হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এছাড়া ইস্কনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ব্যক্তিরা জুয়া খেলা, নেশা এবং অবৈধ সঙ্গ বর্জন করে নিজেদের আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার শিক্ষা লাভ করছে। ফলে যুবসমাজ মাদকাসক্তির করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাচ্ছে।
গীতায় বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুসারে যদি কোনো সমাজ পরিচালিত হয়, তবেই সমাজে যথার্থ শান্তি, শৃঙ্খলা, পারস্পরিক সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য ও সৌহার্দ প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিবছর জন্মাষ্টমী মহোৎসব উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অমৃতময় উপদেশগুলো আমরা স্মরণ ও ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করতে পারি। এভাবে তার অমিয় বাণী চিরকাল জগতে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
শ্রী চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী : সাধারণ সম্পাদক, ইস্কন বাংলাদেশ
