শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ ও আরাধনা
ড. সনজিত পাল
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সব বৈদিক শাস্ত্র একবাক্যে স্বীকার করে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ব্রহ্মা, শিব আদি সব দেব-দেবীর উৎস। অথর্ব বেদে (গোপালাতাপনী উপনিষদ ১/১৪) বলা হয়েছে, ‘ব্রহ্মা, যিনি পূর্বকালে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেন, তিনি সেই জ্ঞান সৃষ্টির আদিতে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে প্রাপ্ত হন।’ নারায়ণ উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘অথ পুরুষো হ বৈ নারায়ণোহ কাময়ত প্রজাঃ সৃজেয়েতি’-‘তারপর পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ প্রাণী সৃষ্টির ইচ্ছা করেন।’ উপনিষদে আরও বলা হয়েছে, ‘নারায়ণ হতে ব্রহ্মার জন্ম হয়, নারায়ণ হতে প্রজাপতিদের জন্ম হয়, নারায়ণ হতে ইন্দ্রের জন্ম হয়, নারায়ণ হতে অষ্টবসুর জন্ম হয়, নারায়ণ হতে একাদশ রুদ্রের জন্ম হয় এবং নারায়ণ থেকে দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম হয়।’ এই নারায়ণ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের স্বাংশ-প্রকাশ। বেদে (নারায়ণ উপনিষদ ৪) বলা হয়েছে, ‘ব্রহ্মণ্যো দেবকীপুত্রঃ’-‘দেবকীপুত্র শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান’। সেখানে (মহা উপনিষদ ১) আরও বলা হয়েছে, ‘সৃষ্টির আদিতে কেবল পরম পুরুষ নারায়ণ ছিলেন। ব্রহ্মা ছিল না, শিব ছিল না, চন্দ্র ছিল না, আকাশ-নক্ষত্র ছিল না এবং সূর্য ছিল না।’ মহা উপনিষদে আরও বলা হয়েছে, শিবের জন্ম হয় পরমেশ্বর ভগবানের ভ্রুযুগলের মধ্য থেকে। বেদে বলা হয়েছে, ‘ব্রহ্মা ও শিবের যিনি সৃষ্টিকর্তা, সেই পরমেশ্বর ভগবানই হচ্ছেন সবার আরাধ্য।’ মোক্ষধর্মে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘প্রজাপতিগণ, রুদ্র ও অন্য সবাইকে আমি সৃষ্টি করেছি, যদিও তারা তা জানেন না। কারণ, তারা আমার মায়াশক্তির দ্বারা বিমোহিত।’ বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে, ‘নারায়ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান আর তার থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়, তার থেকে শিবের জন্ম হয়।’
কলি যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনার উপায় সম্পর্কে তিনি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় সখা অর্জুনকে বুদ্ধিযোগের ব্যাখ্যা করেছেন। বুদ্ধিযোগের অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম। সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তি। বুদ্ধির অর্থ হচ্ছে বোধশক্তি এবং যোগের অর্থ হচ্ছে অতীন্দ্রিয় কার্যকলাপ অথবা যোগরূঢ়। কেউ যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আলয় ভগবৎ-ধামে ফিরে যেতে চান এবং সেই উদ্দেশ্যে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ-সেবায় সম্যকভাবে নিযুক্ত হন, তখন তার সেই কার্যকলাপকে বলা হয় বুদ্ধিযোগ। পক্ষান্তরে বুদ্ধিযোগ হচ্ছে সেই পন্থা, যার ফলে জড়ো জগতের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করা যায়।
কেউ যখন মানবজীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হওয়া সত্ত্বেও কর্মফল ভোগের প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে, তখন সেই স্তরে সাধিত কর্মকে বলা হয় কর্মযোগ। কেউ যখন জানতে পারে, পরম লক্ষ্য হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীকৃষ্ণকে জানার জন্য মনোধর্ম-প্রসূত জ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করে, তাকে বলা হয় জ্ঞানযোগ। কেউ যখন পরম লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হয়ে ভক্তি সহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, তখন তাকে বলা হয় ভক্তিযোগ বা বুদ্ধিযোগ এবং সেটিই হচ্ছে যোগের পরম পূর্ণতা। যোগের এই পূর্ণতাই হচ্ছে জীবনের সর্বোচ্চ সিদ্ধির স্তর। আমাদের উচিত সদ্গুরুর আশ্রয়প্রাপ্ত হয়ে ভগবানের আরাধনা করা। পারমার্থিক উন্নতি সাধনের জন্য যথার্থ বুদ্ধি যদি না থাকে, তাহলে শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের অন্তরস্থল থেকে তাকে যথাযথ নির্দেশ প্রদান করেন, যার ফলে তিনি অনায়াসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যেতে পারেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই কৃপা লাভের একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে, কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে প্রীতি ও ভক্তি সহকারে সর্বক্ষণ ভগবানের সেবা করা। ভক্ত যদি আত্মোপলব্ধির বিকাশ সাধনে যথার্থ বুদ্ধিমান না হন, কিন্তু ভক্তিযোগ সাধনে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী হন, তাহলে ভগবান তাকে সুযোগ প্রদান করেন, যার ফলে তিনি ক্রমেই উন্নতি সাধন করেন এবং অবশেষে তার কাছে ফিরে যেতে পারেন।
ড. সনজিত পাল : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা
