দেবী দুর্গা যেভাবে ‘সর্বজনীন’ হলেন
পলাশ চৌধুরী
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অসুরকে বিনাশ করে পৃথিবীর সবার জন্য সাম্য-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতেই দেবী দুর্গার আবির্ভাব। প্রতীকী বা রূপক অর্থে হলেও দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার পূজা করে এক অনাবিল প্রশান্তি লাভ করে সনাতন ধর্মানুসারীরা।
মার্কন্ডেয় পুরাণ বলে, ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে কলিঙ্গে দুশিরা নামে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। উল্লেখ্য, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের হাত ধরে উড়িষ্যায় দুর্গার আগমন। সেদিক থেকে বলতে গেলে, দুর্গোৎসবটা মোটেও হঠাৎ করে জন্ম নেওয়া মহোৎসব নয়। এর শেকড় বহু আগের।
বাংলায় তখন উপচে পড়ছে সম্পদ। হিন্দু সমাজে চিরভাস্বর হয়ে থাকার মানসে এক মহাযজ্ঞ সাধন করতে আগ্রহী হলেন রাজা কংসনারায়ণ। তার ইচ্ছার কথা শুনে পরগণার শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ শ্রী রমেশ শাস্ত্রী বিশ্বজিৎ, রাজসুয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ-এই চারটি ‘মহাযজ্ঞ’র প্রস্তাব করলেন। প্রথম দুটি শুধু সার্বভৌম সম্রাটরা করতে পারেন, আর পরের দুটি কলিতে নিষিদ্ধ। দুর্গোৎসব ভিন্ন অন্য কোনো মহাযজ্ঞ উপযুক্ত নেই, যা সব যুগে সব জাতির মানুষই করতে পারে এবং এক যজ্ঞেই সব যজ্ঞের ফল লাভ হয়।
সমাগত সব পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রীর এই মতে সমর্থন দেওয়ায় কংসনারায়ণও রাজি হলেন। বর্তমান রাজশাহীর তাহেরপুর কলেজ মাঠে তথা কংসনারায়ণের রাজবাড়ীর আঙ্গিনায় দেবীর বোধন হয়। সোয়া ৫০০ বছর আগের সেই পূজায় স্বর্ণনির্মিত বিগ্রহসহ ব্যয় হয় লাখ টাকা, যার বর্তমান মূল্য ছয়শ কোটি টাকা।
মধ্যযুগেও বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সেসময় পূজা হতো মূলত রাজ-রাজরাদের প্রাসাদে, নাটমন্দিরে। সেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। তথাকথিত নিম্নবর্ণের বা দরিদ্র শ্রেণির প্রজারা তাদের রাজাদের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়িয়ে পূজার আমোদে মেতে উঠতে পারত না। তথাকথিত উঁচু শ্রেণির লোকজন (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) শ্রেণিবিভেদটাকেও আভিজাত্যই ভাবত। এ বিভাজনের আক্ষেপ অনেকটাই ঘুচে যায় ‘বারোয়ারি’ পূজার প্রচলনে।
‘বারোয়ারি’ শব্দটির উৎপত্তি ‘বারো’ ও ‘ইয়ার’ (বন্ধু) শব্দ দুটি থেকে। গ্রামের ১২ জন সদস্য মিলে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এই পূজার প্রচলন করেন বলে এর নাম হয় ‘বারোয়ারি’। বারোয়ারি পুজোর প্রচলন সম্পর্কে জানা যায়, সেন আমলে বাংলায় হিন্দুধর্ম রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং সমাজে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তৎকালীন সেন বংশের ও তাদের পরিবারের দুর্গাপূজা রমরমা ও বহুল প্রচলিত ছিল। আনুমানিক ১১৬৬ সালে সেন রাজবাড়িতে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। সেখানকার প্রজারা দুপুরবেলা সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে নিয়ে সেনবাড়ির সদর দরজায় উপস্থিত হন প্রতিমা দর্শনের জন্য। কিন্তু দ্বাররক্ষীরা তাদের প্রবেশে বাধা দেয়। বহু চেষ্টার পরও প্রতিমা দর্শনের অনুমতি না মেলায় অপমানিত বোধ করে তারা বাড়ি ফিরে আসেন এবং সবাইকে একথা জানান। একরকম বিবাদের জেরেই ১২টি গ্রামের যুবকরা মিলে এ পূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
কলকাতায় ১৯২৯ সাল থেকে সিমলা ব্যায়াম সমিতি পূজার প্রচলন করে আসছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ বিপ্লবী ও সে সময়ের রাজনৈতিক নেতারা যুক্ত ছিলেন এ পূজায়। নেতাজী সুভাষ বোসও এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, যার রেশ ধরে পূজাটি ‘নেতাজির পুজো’ নামে খ্যাত হয়। এভাবেই একসময়ের রাজ-রাজরাদের আভিজাত্যের দুর্গাপূজা সময়ের পরিক্রমায় সর্বজনীন হয়ে ওঠে।
পলাশ চৌধুরী : গণমাধ্যম ও সংস্কৃতিকর্মী
palashchow.news@gmail.com
