Logo
Logo
×

অল্পকথা

‘জয় বাংলা’ প্রতিপালনে অবহেলা কেন?

Icon

কাজী মাসুদুর রহমান

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘জয় বাংলা’ বাঙালি জাতির প্রাণের স্লোগান। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাসের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ শব্দযুগল, ধ্বনি কিংবা স্লোগান-যাই বলি না কেন-অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯২২ সালে, মতান্তরে ১৯২৪ সালে, প্রকাশিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙার গান’-এর ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতার ২৭তম চরণে প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দযুগল ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বরাক উপত্যকার বাঙালিরা এটিকে স্লোগান হিসাবে ব্যবহার করলেও একমাত্র বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির এক অমীয় স্লোগান হিসাবে এটি ইতিহাসসিদ্ধ হয়ে ওঠে। নিবিড় বিশ্লেষণে দেখা যায়, সব নিষ্পেষণ ও শোষণের বিরুদ্ধে কবি নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার সার্থক রূপকার হিসাবে বঙ্গবন্ধু বাংলায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। কথিত আছে, ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আহূত শিক্ষা দিবসের এক ঘরোয়া সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতি হেলালুর রহমান ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। আবার কারও কারও মতে, ১৯৭০ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকাস্থ পল্টনের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান বক্তৃতাকালে এটি উচ্চারণ করেন। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৭০ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুই সর্বপ্রথম জনসম্মুখে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তোলেন। এরপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ শেষ করেন তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে। সেদিন থেকে এই স্লোাগানটি মুক্তিপাগল বাঙালির স্বাধীনতার এক দুর্বার ধ্বনিতে পরিণত হয়। তখন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান হিসাবে এটি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের রচনায় এবং আনোয়ার পারভেজের সুরে এ গানটি বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি গানের মধ্যে ১৩তম স্থান অর্জন করে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ’৭৫-পরবর্তীকালে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি সমসাময়িককালে সাধারণ পাঠ্যপুস্তকেও এর প্রতি অবজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। উল্লেখ্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রণীত উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির ‘ইংলিশ ফর টু ডে’ পাঠ্যবইয়ে ইংরেজি পরিভাষায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সন্নিবেশ করা হলেও ভাষণটির শেষাংশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে গণমাধ্যমে এই নিবন্ধকার বিষয়টি তুলে ধরার পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি সংযোজন করা হয়। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১০ মার্চ বিচারপতি এফআরএম নাজমুল হাসান এবং বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ আদালতের বেঞ্চ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করতে রায় প্রদান করেন। রায়ে সাংবিধানিক পদাধিকারদের, রাষ্ট্রীয় সব কর্মকর্তাদের অনুষ্ঠানের বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করতে বলা হয়। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আ্যসেম্বলি শেষে স্লোগানটি বলতে বলা হয়। পরে ২০২২ সালের ২ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সংক্রান্ত গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু আজও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর অধিকাংশ স্থানে এ নির্দেশনা পালন করা হয় না, যা রাষ্ট্রীয় আদেশ অবজ্ঞা করার শামিল।

প্রশ্ন হলো, কেন এ অবজ্ঞা? এটা তো নির্দিষ্ট কোনো দলের বা রাজনৈতিক স্লোগান নয়। এটি একটি সর্বজনীন রাষ্ট্রীয় স্লোগান। সংশ্লিষ্ট সব স্তরে এই স্লোগান প্রতিপালন ও চর্চার বিষয়ে যথাযথ মনিটরিং হওয়া উচিত। একইসঙ্গে এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমগুলোর আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করি।

কাজী মাসুদুর রহমান : সাংস্কৃতিক সম্পাদক (সাবেক); গবেষণা ও প্রচার সম্পাদক (প্রস্তাবিত);

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, যশোর

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম