|
ফলো করুন |
|
|---|---|
২৯ এপ্রিল কেশবপুরে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ধানের বিচালি বেঁধে বাড়িতে আনার সময় জোহর আলী সরদার নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। ২৭ এপ্রিল নওগাঁর রাণীনগরে তীব্র গরমে জমিতে ধান কাটার সময় ‘হিট স্ট্রোকে’ রেজাউল ইসলাম নামে এক কৃষি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ২৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরে বোরো ধান কাটতে গিয়ে সাপের কামড়ে আজাদ মিয়া মৃত্যুবরণ করেন। এ রকম ঘটনা প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে। তারপরও কৃষকরা দেশের চাকা সচল রাখতে দিন-রাত পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে চলেছেন। আর এর মাধ্যমে তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন। দাবদাহ, শৈত্যপ্রবাহ, রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান-যাই হোক, প্রতিদিন কাজ করতে হয় তাদের। মে দিবস কী তা জানা নেই কৃষকদের! তারা শুধু জানেন, একদিন কাজ করতে না করলে পরদিন পেটের ভাত জোগাড় হবে না।
শ্রমিকদের সম্মানে মে দিবস জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে পালন করে বিশ্ব। কিন্তু কৃষকরা কি তা জানেন? তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন বোরো ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে তুলতে। গ্রামে বড় হওয়ায় আমি কৃষিকাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাই জানি এক কেজি চাল উৎপাদন করতে কৃষকের কী পরিমাণ পরিশ্রম হয়। অথচ অনেক সময় কৃষক তার প্রকৃত উৎপাদন খরচও পান না। তবুও তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করে যান। আসলে শ্রমের ফলে মানুষ শুধু নিজের প্রয়োজন মেটায় না, উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে। সমাজের যা কিছু সমৃদ্ধি, তা উদ্বৃত্ত সৃষ্টির ফলেই সম্ভব হয়েছে। এই উদ্বৃত্তটা আত্মসাৎ করার কারণেই একদল সম্পদশালী হয়, আর বাকিরা হয় নিঃস্ব।
এটা আজ দিবালোকের মতো সত্য, আমাদের দেশের কৃষক উৎপাদিত পণ্যে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বেশি দাম দিয়ে খুচরা বাজার থেকে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ভোক্তারা। অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে মাঠে কৃষক ও বাজারে ভোক্তাদের ঠকতে হচ্ছে। আসলে কৃষকের এ দুর্দশা স্থায়ী রূপ পেয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে চালু হওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। এর ফলে ব্রিটিশ শাসক ও বাংলার কৃষকদের মধ্যে কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রভু, জমিদার, জোতদার, নায়েব, বরকন্দাজ সবার ‘খাই’ মেটাতে কৃষক হয়ে পড়েছিল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর।
এটা ঠিক, দেশ আজ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু আমাদের কৃষকরা মধ্যস্বত্বভোগীদের সেই ‘চিরস্থায়ী দৌরাত্ম্য’ থেকে কতটা মুক্তি পেয়েছেন? শুধু তিন বেলা ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাই কি কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা? বছরের পর বছর ধান চাষ করেও কৃষক কোনো লাভ করতে পারছেন না। গত ৫ বছরে ধান চাষের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ, কিন্তু সেই তুলনায় ধানের উৎপাদন বেড়েছে নগণ্য। ধান চাষে কৃষক কোনো লাভ করতে না পারলে কেন তারা ধান চাষ করবেন? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বেঁধে দেওয়া মূল্যে ব্যবসায়ীরা খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রি করছেন না। সরকারি সংস্থাগুলো নিত্যপণ্যের যে মূল্য প্রকাশ করে, বাজারে তার সঙ্গেও কোনো মিল পাওয়া যায় না। চাহিদা ও সরবরাহের তথ্যেও রয়েছে গরমিল।
দেশের কৃষকের স্বার্থ রক্ষা না হলে এর সার্বিক ফলাফল কোনোভাবেই ইতিবাচক হওয়া সম্ভব নয়। তাই কৃষকের ন্যায্যমূল্য ও অধিকার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম : উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
mbashirpro1986@gmail.com
