Logo
Logo
×

অল্পকথা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হত্যা

Icon

স্বপন কুমার দাস

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২০ জন শিক্ষক গণহত্যার শিকার হন। তাদের দুই পর্বে হত্যা করা হয়। প্রথম পর্বে ২৫ মার্চ রাতে ও ২৬ মার্চ দিনজুড়ে। এ পর্বে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে শহিদ হন ১০ জন শিক্ষক। এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। দ্বিতীয় পর্বে বুদ্ধিজীবী নিধন করা হয় ১৪ ডিসেম্বর বিজয় লাভের প্রাক্কালে। এ হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে পাকিস্তানি সৈন্যদের দোসররা। এ পর্বে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১০ জন শিক্ষক।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত ১১টার সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা সাঁজোয়া যান নিয়ে এসে নীলক্ষেত মোড় থেকে টিএসসি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তারপর তারা একযোগে উত্তরদিকে অবস্থিত ছাত্রাবাস ও শিক্ষক কোয়ার্টারগুলো লক্ষ্য করে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ ও মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। প্রথমেই তারা ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) আক্রমণ করার পথে নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার ২৩ নম্বর বিল্ডিংয়ে ঢুকে মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. ফজলুর রহমান খান ও তার ভাগনে আলী আহসান খানকে গুলি করে হত্যা করে। সেই রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তালিকা ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রথিতযশা শিক্ষকদের হত্যা করে। তাদের মধ্যে রযেছেন ফুলার রোডের ১২ নম্বর বিল্ডিংয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মো. আবদুল মুকতাদির, ১১ নম্বর বিল্ডিংয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেক, গণিত বিভাগের প্রভাষক শরাফত আলী ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আতাউর রহমান খান।

সে রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা জগন্নাথ হলে ছাত্রাবাসেও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালায়। একইসঙ্গে তারা তালিকা অনুযায়ী শিক্ষকদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করতে থাকে। জগন্নাথ হলের পূর্বদিকে বর্তমানে বুদ্ধিজীবী কোয়ার্টার বলে পরিচিত ৩৪ নম্বর বিল্ডিংয়ে ঢুকে গণিত বিভাগের শিক্ষক এএনএম মুনীরুজ্জামান ও তার পরিবারের আরও তিন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ওই ভবনের বাসিন্দা ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে। তিনি গুলিবিদ্ধ হলেও তৎক্ষণাৎ মারা যাননি। তিনি ৩০ মার্চ মারা যান।

পরদিন ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা খুব সকালে জগন্নাথ হলের অ্যাসেম্বলি ভবনে ঢুকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে গুলি করে হত্যা করে। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শিববাড়ি মোড়ে অবস্থিত একতলা বাংলোবাড়িতে বাস করা দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে এবং তার লাশ জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে মাটিচাপা দেয় অন্যদের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সাদত আলী ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল টাকা উত্তোলনের জন্য রেজিস্ট্রার ভবনের সোনালী ব্যাংকে আসেন। ক্যাম্পাসে টহলরত সৈন্যরা তাকে ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তার আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

২৫ ও ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের পর ২৭ মার্চ কার্ফ্যু তুলে নেওয়া হয় কিছু সময়ের জন্য। এ সুযোগে এ বিদ্যাপীঠটির প্রায় সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী যার যার গ্রামের বাড়ি চলে যান। অনেক শিক্ষক-ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে কিলিং মিশন কাজ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসররা মুখোশ পরে একটি মাইক্রোবাসে চেপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তালিকা ধরে ধরে প্রথিতযশা শিক্ষকদের বাসায় গিয়ে তাদের চোখ ও হাত বেঁধে গাড়িতে তোলে। তারা হলেন-বাংলা বিভাগের শিক্ষক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আবুল খায়ের এবং গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য এবং রাশীদুল হাসান, শিক্ষক ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সিরাজুল হক খান ও আ. ন. ম ফয়জুল মুহী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের ডাক্তার মোহাম্মদ মোর্তোজা। তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়।

স্বপন কুমার দাস : সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম