Logo
Logo
×

প্রকৃতি ও জীবন

পরিবেশবান্ধব পাট নিয়ে পাঠ

Icon

এস এম মুকুল

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কালের ইতিহাসে বাংলার প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে পাটের গৌরবময় অবদান রয়েছে। পাটের আরেক নাম সোনালি আঁশ। চিরসবুজ বাংলার অকৃত্রিম বন্ধু। একসময় নদীমাতৃক দেশজুড়ে যেদিকে তাকানো যেত সেদিকেই ছিল সবুজ পাটের ক্ষেত। পাট জলবায়ু সহনশীল ফসল। কারণ সাময়িক খরা কিংবা জলাবদ্ধতায় পাটের তেমন ক্ষতি হয় না। পাট উৎপাদনে খুবই কম সার লাগে। মজার ব্যাপার হল, নির্মল বাতাস সৃষ্টির অন্যতম কারিগর পাটগাছ। কারণ পাটগাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে আর অক্সিজেন ত্যাগ করে যা গ্রহণ করে আমরা বেঁচে আছি।

বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জলবায়ু পাট চাষের জন্য উপযোগী। পাট বৃষ্টিনির্ভর ফসল। পাট চাষ থেকে পশুখাদ্য, সবজি এবং পাটজাত বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। শুকনো পাট পাতার পানীয় ‘চা’ হিসেবে পান করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন হয়েছে। ঘন ও উঁচু ফসল হওয়ার কারণে পাট বনভূমির মতো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। পাট গাছকে যদি প্রকৃতির নিবিষ্ট সেবক বলা হয় তবে তা অত্যুক্তি হবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, পাট গাছ প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন ও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান মাটিতে সরবরাহ করে। ফসল হিসেবে একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতির মাঝে নিঃসরণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেনসমৃদ্ধ রাখে। পাট ফসলের কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা প্রতি বর্গমিটার জায়গায় ০.২৩ থেকে ০.৪৪ মিলিগ্রাম। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল- পাট পৃথিবীর গ্রিন হাউস গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে।

পাটকাঠি পাট চাষের আর এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পাটের আঁশের দ্বিগুণ পরিমাণ পাটকাঠি উৎপাদিত হয়। ঘরের বেড়া, ছাউনি এবং জ্বালানি হিসেবে পাটকাঠির ব্যবহার রয়েছে। বাঁশ ও কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাটকাঠি ব্যবহৃত হয়। জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পাটকাঠির ব্যবহার যত বাড়বে গাছ কেটে বন উজাড়ের প্রবণতা তত কমবে। ফলে গাছ পরিবেশকে মানুষের বাস উপযোগী করে তুলবে। গাছের ফল, ফুল মানবজাতিকে পুষ্টি ও ঔষধি উপকরণ জোগাবে। কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় আর পশুপাখির নিরাপদ বাসস্থান হবে। আবার জ্বালানি হিসেবে পাটকাঠির ব্যবহার পরিবেশের জন্য সহায়ক। আমরা আরও সহজভাবে বলতে পারি- যে জমিতে পাট চাষ হয় সে জমিতে অন্য ফসলও ভালো হয়। পাট উৎপাদনকালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাতা ঝরে গিয়ে মাটিতে মিশে যায়। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর গড়ে ৯৫৬.৩৮ হাজার টন পাটপাতা এবং ৪২৩.৪০ হাজার টন পাটগাছের শিকড় মাটির সঙ্গে মিশে যায়, যা জমির উর্বরতা ও মাটির গুণগতমান বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে যা মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। পাট গাছের শেকড় মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে। শেকড় মাটির গভীর থেকে অজৈব খাদ্য উপাদান মাটির উপরের স্তরের সঙ্গে সংমিশ্রণে সঞ্চালকের ভূমিকা রাখে। আর এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে এবং মাটিতে পানি চলাচল স্বাভাবিক থাকে। এছাড়াও ফসল কাটার পর জমিতে পাট গাছের গোড়াসহ শেকড় পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সারে পরিণত হয়। ফলে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের মৌসুমে সারের খরচ কম লাগে। আবার পাট জাগ দেয়ার পর আঁশ ছাড়া অন্যান্য অংশ, জাগ ও আঁশ ধোয়া তলানী উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। পাট জাগ দিলে সেখান থেকে মাছের উত্তম খাবার মেলে।

পাটজাত পণ্য সহজে মাটিতে মিশে যায়, ফলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। পাটের পরিবেশবান্ধব বহুমাত্রিক ব্যবহার বিশ্বে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব মনোভাব নিয়ে সচেতন ভূমিকায় পাটের তৈরি পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে সুতা, পাকানো সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট ব্যাকিং ইত্যাদি। পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট ইত্যাদিও পাট থেকে তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সঙ্গে পাটের মিশ্রণ করা হয়। কৃষিপণ্য এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি বস্তাবন্দি ও প্যাকিং করার জন্য পাটের চট ব্যবহার করা হয়। পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে- প্রসাধনী, ওষুধ, রং ইত্যাদি। জানলে অবাক হবেন, বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনসুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া ইউরোপের বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, ওডি ফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের জিএম মটর, জাপানের টয়োটা, হোন্ডা কোম্পানিসহ নামিদামি সব গাড়ি কোম্পানিই তাদের গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও ডেশবোর্ড তৈরিতে ব্যবহার করছে পাট ও কেনাফ। বিএমডাব্লিউ পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিন কার’ যার চাহিদা এখন তুঙ্গে।

বাংলাদেশে পাটের পণ্যের মধ্যে প্রধান পণ্য হল বস্তা, যা ধান-চাল পরিবহন ও সংরক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাট কাটিংস ও নিুমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল। বর্তমানে জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড় ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, রেল, সড়কসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অবকাঠামো তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হিসেবে জিওটেক্সটাইলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বজুড়ে নানা কাজে ‘মেটাল নেটিং’ বা পলিমার থেকে তৈরি সিনথেটিক জিওটেক্সটাইলের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ও উৎকৃষ্ট জুট জিওটেক্সটাইলের কদর বাড়ছে।

পাটকাঠির আরেক নাম রুপালি কাঠি। বাংলাদেশ থেকে পাটকাঠির কালো ছাইয়ের প্রধান আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। বর্তমানে চীন ছাড়াও তাইওয়ান, জাপান, হংকং ও ব্রাজিলেও পাটকাঠির ছাই রফতানি হচ্ছে। চীনসহ বিভিন্ন দেশে পাটকাঠির ছাই থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী পণ্য, এয়ারকুলার, পানির ফিল্টার, বিষ ধ্বংসকারী ওষুধ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ও ক্ষেতের সার ইত্যাদি তৈরি করা হয়। পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বনের গুণগতমান সর্বাধিক। তাই বিশ্ববাজারে এর চাহিদা ও মূল্য দুটিই বাড়ছে। এছাড়াও পাটকাঠি থেকে কয়লা বা অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন করা হয়। ইউরোপে ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্টে এর অনেক চাহিদা রয়েছে।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম