মুক্তিযোদ্ধার নাম যাচাই
প্রশ্নবিদ্ধ গোপালগঞ্জের হেমায়েত বাহিনী
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানসহ হেমায়েত বাহিনীর ৩৪২ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তালিকাভুক্ত হওয়ায় নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে চূড়ান্তভাবে তালিকাভুক্ত হতে টাকার বিনিময়ে সাক্ষী বেচাকেনা চলছে। বিষয়টি নিয়ে এখন জেলাজুড়ে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বাহিনীর সদস্য ছিল সাড়ে তিনশর কিছু বেশি। কিন্তু এখন তা ৭০০ দাঁড়িয়েছে। এই বাহিনীপ্রধান হেমায়েত উদ্দীন, বীর বিক্রমসহ লাল তালিকা ও ভারতীয় গেজেটভুক্ত ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরে জামুকা ওই তালিকা সংশোধন করলেও শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন বাকি ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা।
হেমায়েত বাহিনীর প্রতিষ্ঠাকালীন একজন সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হেমায়েত উদ্দীনের নেতৃত্বে বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশালের কিছু অঞ্চল নিয়ে হেমায়েত বাহিনী গড়ে ওঠে। মূলত দুটি ধারায় হেমায়েত বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেন। এর মধ্যে একটি গ্রুপ ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং অপরটি স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরপর কোটালীপাড়ার মাঝবাড়ী স্কুলমাঠে হেমায়েত বাহিনীর ক্যাম্প ক্লোজ করা হয়। তখন হেমায়েত বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৬৫ জন। পরে স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পর কিভাবে হেমায়েত বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৭০০ হলো এবং এর মধ্যে ৬৮৩ জন কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছিলেন এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, জামুকা কর্তৃক কিছু মুক্তিযোদ্ধার তালিকা দেওয়া হয়। যাদের সম্পর্কে স্থানীয় কমান্ডাররা কিছুই জানেন না। তাদের যাচাই-বাছাই থেকেও বাদ রাখা হয়েছে। হেমায়েত বাহিনীতে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। তারা তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এখনই সময় ভুয়া বা নামসর্বস্ব অমুক্তিযোদ্ধাদের হঠানোর। সরকারি সুযোগ সুবিধা, ভাতা এমনকি তাদের ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিদেরও সরকারি চাকরির সুযোগ নিচ্ছে এসব অমুক্তিযোদ্ধা। অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে যারা মহান স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, যারা দেশের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে জীবন দিয়েছেন এই অমুক্তিযোদ্ধাদের কারণে সেই সূর্যসন্তানরা বিভিন্ন সময় অবমূল্যায়িত হচ্ছেন। জানা গেছে, অনেকে লাল তালিকা থেকে বাদ পড়ে এখন সাক্ষী কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
কেউ কেউ নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বৈধ করতে সুপারিশের জন্য ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। এক শ্রেণির লোভী ও স্বার্থান্বেষী মুক্তিযোদ্ধা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের বৈধ করার তৎপরতা চালাচ্ছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান সরদারের ছেলে পলাশ সরদার বলেন, তিনি তার বাবার মুখ থেকে শুনেছেন বিভিন্ন সময় কোটালীপাড়া উপজেলা কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এসব অমুক্তিযুদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। যা হেমায়েত বাহিনীর বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তিনি তার বাবার মুখে আরও শুনেছেন বলে জানান, কোটালীপাড়ার কুশলা ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের পানি খাওয়ানোর মতো কেউ ছিলেন না। অথচ বর্তমানে ওই ইউনিয়নের একটি গ্রামেই ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। কুশরা ইউনিয়নের সেনেরগাতি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ছৈয়দ শেখের স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার স্বামী ঘাঘর বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। তিনি (আমার স্বামী) মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। হেমায়েত বাহিনীপ্রধান হেমায়েত উদ্দীনের নিজ বোন মোমেলা বেগম অভিযোগ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার ভাতাপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য তৎকালীন কমান্ডারকে আমার স্বর্ণের চেইন বিক্রি করে ভাতার তালিকাভুক্ত হতে হয়। কোটালীপাড়া উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ লুৎফর রহমান বলেন, হেমায়েত বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা ৩৬৫ জন থাকলেও পরে তা বৃদ্ধি পায়। এরকম বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য টাকার বিনিময়ে সাক্ষী কেনাবেচা চলছে বলে আমি শুনেছি। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করব।
