হাজার-হাজার চাষি ক্ষতিগ্রস্ত
রাজশাহীতে আম বিক্রিতে এখনো ‘ঢলনপ্রথা’
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহী অঞ্চলের আমপ্রধান চার জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরের মোকামগুলোয় আম কেনাবেচায় ‘ঢলনপ্রথা’ বাতিলের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হলেও কোথাও তা কার্যকর হয়নি। ফলে কেজির বদলে আগের মতোই মন হিসাবে বিক্রি হচ্ছে আম। মোকামভেদে আমের মন ধরা হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫৪ কেজি। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাজার হাজার আমচাষি। আমের ঢলন বা ধলতাপ্রথা হচ্ছে ৪০ সের বা কেজির মনের বদলে এলাকাবিশেষ ৪৫ থেকে ৫৪ কেজিতে মন ধরে বিক্রি করা হয়। তবে বিক্রেতা পান ৪০ কেজির দাম। বাকি ৫ থেকে ১৪ কেজি অতিরিক্ত আমের মূল্য চলে যায় আড়তদার ও ফড়িয়া-ব্যাপারীদের পকেটে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই প্রথাকে বলে ধলতা বা ঢলনপ্রথা। রাজশাহী ও নওগাঁর মোকামগুলোয়ও ঢলনপ্রথার চল রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ১১ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে আমের ঢলনপ্রথা বাতিলের বিষয়ে চার জেলার জেলা প্রশাসক, আমচাষি, বাগান মালিক প্রতিনিধি, বণিক সমিতির প্রতিনিধি ও আড়তদারদের অংশগ্রহণে একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রাজশাহী বিভাগের চার জেলার মোকামগুলোয় আম বেচাকেনায় ঢলনপ্রথা আর কার্যকর থাকবে না। ঢলনপ্রথার বদলে আম বিক্রির সময় আড়তদাররা প্রতি কেজি বিক্রীত আমের ওপর ১ টাকা ৫০ পয়সা করে কমিশন লাভ করবেন। আড়তদাররা এই কমিশন পাবেন আমচাষি বা বিক্রেতার কাছ থেকে। এ যৌথ সভার সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় সেনা ক্যাম্প, পুলিশ সুপার ও ওসিদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সাত দিনেও কোথাও ঢলনপ্রথা বাতিল হয়নি। আগের নিয়মেই বিক্রি হচ্ছে আম। ঠকছেন চাষিরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব ও বাণিজ্যিক আমচাষি আহসান হাবিব বলেন, ঢলনপ্রথার কারণে আমচাষিরা বহু বছর ধরেই শোষণ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন। এ প্রথা বাতিলের জন্য আমরা বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নিয়ে বিভাগীয় প্রশাসনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। সিদ্ধান্ত হলেও তা মোকাম পর্যায়ে এখনো কার্যকর হয়নি। ফলে দেশের বৃহৎ আম মোকাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে চাষিরা ঢলনপ্রথাতেই আম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আড়তে ৪০ কেজির মনের স্থলে ৪৫ থেকে ৫৪ কেজি পর্যন্ত নেওয়া হলেও চাষিরা পাচ্ছেন ৪০ কেজির দাম।
রাজশাহীর আম কেনাবেচার বড় মোকাম বানেশ্বর হাটেও ঢলনপ্রথায় আম বেচাকেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা। রাজশাহীর পারিলা এলাকার আমচাষি শাহিনুল মিয়া জানান, বানেশ্বরে ৪০ কেজির জায়গায় ৪২ থেকে ৪৪ কেজিতে মন হিসাব করা হচ্ছে। নওগাঁর বৃহৎ আমের মোকাম সাপাহারেও ঢলনপ্রথায় আম বেচাকেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওই এলাকার আমচাষি কামরুজ্জামান ও বেদারুল ইসলাম। তারা জানান, সাপাহারে ৪৫ কেজিতে আমের মন ধরে বেচা-বিক্রি হচ্ছে। আবার ক্যারেট বা ডালি ঠিকাতেও বিক্রি হচ্ছে।
নওগাঁর সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আহমেদ জানান, বিভাগীয় কমিশনার অফিসে গৃহীত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কার্যকরের উদ্যোগ চলমান আছে। রাজশাহীর অঞ্চল ও জেলাভেদে আম বিক্রির পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। দরদামের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে আম বেচাকেনা হচ্ছে। ঢলনপ্রথার প্রচলন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে বেশি হলেও সাপাহারে সেটা সেভাবে প্রচলিত নয়। এখানে ঠিকা ও ওজনে আম বিক্রি হচ্ছে। সাপাহারের চাষিদের থেকে কোনো অভিযোগ নেই।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢলনপ্রথার প্রচলন বেশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ও ভোলাহাটের আমের মোকামগুলোয়। গোমস্তাপুর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ী গ্রামের চাষি সহরত আলি জানান, ঢলনপ্রথা বাতিলের কথা শুনলেও মোকামে এর কোনো কার্যকারিতা নেই। বরং রহনপুর মোকামে ৫০ থেকে ৫৪ কেজিতে মন ধরে আম বেচাকেনা হচ্ছে।
চাষি ও বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢলনপ্রথা বাতিলের সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে কার্যকরের কোনো উদ্যোগ নেই। চাষি ও বাগান মালিকরা মোকামে আম বিক্রির জন্য নিয়ে গেলে কেউ ঢলন দিতে রাজি না হলে তার আম কিনছেন না আড়তদাররা।
