Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

চন্দ্রদ্বীপ অভিযান

বরিশাল ঢুকতেই সেই প্রবাদটির কথা মনে এলো, ধান-নদী খাল, এই তিনে বরিশাল। গাড়িচালক আরেকটু যোগ করলেন, ‘এখন তো শীতের মৌসুম, আপনি যদি ভরা বর্ষায় আসেন তবে টইটম্বুর পানি দেখে ভালো লাগবে।’ উচ্চারণে বরিশালের টান। বরিশাল শহরটি বেশ পরিচ্ছন্ন, যা দেখে ভালো লাগল। বরিশাল ঘুরে লিখেছেন শান্তনু চৌধুরী

Icon

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শুরুটা হল সকালের নাশতা দিয়ে অশ্বিনী কুমার টাউন হলের বিপরীতে সকাল-সন্ধ্যা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নাশতা সেরে। যেটি বিখ্যাত ৪০ টাকার লুচি-নাশতা আর ৫০ টাকা দামের সরমালাইয়ের জন্য। সেখানেই দেখা হয়ে গেল বরিশালের সাংবাদিক ফিরদাউস সোহাগ আর মাহমুদুন্নবীর সঙ্গে। তাদের সহায়তা নিয়ে রোডম্যাপটা জেনে নিলাম। আমরা মানে চার বন্ধু। আমি, মহি, জয় আর শাহীন হঠাৎ করেই বেরিয়ে পড়লাম চন্দ্রদ্বীপ অভিযানে। যে বরিশালের মানুষের এত এত কথা শুনি ঢাকায় বসে তাদের অঞ্চলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে চাওয়া। এমনিতেই আমরা মুগ্ধ শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, মুকুন্দ দাস, জীবনানন্দ দাশ আর রাজা চন্দ্রদ্বীপ এবং তার বংশধরদের ভালোবাসায়। এরপরও সেটি উপভোগ করব বলে সময় নিয়ে বের হওয়া চন্দ্রদ্বীপ অভিযানে।

শহরে নেমেই গাড়ি নিয়েছিলাম দৈনিক চুক্তিতে। অচেনা জায়গা যাতে এখানে-সেখানে নেমে গাড়িতে ওঠা-নামার যন্ত্রণা সইতে না হয়। ভুল পথে যেতে না হয়। গুয়াচিত্র দিয়ে চাখারে প্রথমেই ঢুকলাম বাংলার বাঘ খ্যাত শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের স্মৃতি জাদুঘরে। সেখানে স্থান পেয়েছে ব্যবহৃত টেবিল, খাট, আলোকচিত্র, আরামকেদারা, কুমিরের খোলস। মোট পাঁচটি কক্ষ রয়েছে এই জাদুঘরে। পাশেই শের-ই-বাংলার বাড়ি বা বৈঠকখানা। দেখলেই মনে হয় তারাই ছিলেন জনমানুষের নেতা, কতই না সাধারণ সেসব। এরই কাছ ঘেঁষে ফজলুল হক কলেজ। এই কলেজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেখানে কোনো জানালা নেই। এরপর গন্তব্য গুঠিয়া মসজিদে। বরিশাল-বানারীপাড়া সড়কের উজিরপুরের গুঠিয়া এলাকার এই মসজিদটি আধুনিক স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। এটির প্রকৃত নাম, বায়তুল আমান জামে মসজিদ। যার কেন্দ্রে রয়েছে কারুকাজ খচিত একটি গম্বুজ। অবিরাম চলে ক্লিক ক্লিক। এরপরের যাত্রা বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নে অবস্থিত দুর্গাসাগর দীঘি। এমন অপরূপ দীঘি বাংলায় খুব কমই দেখা যায়। চরদিকে বাঁধানো সুন্দর পরিবেশ। দীঘির স্বচ্ছ পানি, মাঝে কৃত্রিম বাঘ-হরিণের একঘাটে পানি খাওয়ার দৃশ্য। আর প্রকৃতি মানেই প্রেম আসবেই। আশপাশের বা দূর গ্রামের, শহরের কপোত-কপোতিরাও তাই নিজেদের উষ্ণ করে নিচ্ছিল প্রকৃতির সতেজতায়। আমরা মুখ ফেরালাম সুবিশাল বটবৃক্ষের নিচে। সেখান থেকে জানলাম চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ণ ১৭৮০ সালে তার স্ত্রী দুর্গারানীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার গভীরতা প্রমাণের জন্য এবং এলাকাবাসীর পানি সংকট নিরসনের জন্য মাধবপাশায় ঐতিহাসিক দীঘিটি স্থাপন করেন। দুর্গারানীর নামানুসারে দীঘিটির নাম হয় দুর্গাসাগর। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো মাধবপাশা জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ যেন এখনও নিজেদের অস্থিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। জমিদার বাড়ি এসে শাপলার গ্রাম সাতলা দেখে যাব না তা কি হয়? উজিরপুর উপজেলার উত্তর সাতলা গ্রামের সৌন্দর্য দেখে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। দিগন্তজোড়া শাপলা ফুল।

শাপলা কিন্তু চাষ হয় এখানে এবং শাপলা চাষ করেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী অনেকে। দেখা হল কড়াপুর মিয়া বাড়ি মসজিদ, মধ্যকড়াপুর মসজিদসহ আরও কয়েকটি স্থাপনা। এর মধ্যে মুকুন্দ দাসের কালী মন্দিরের কথা বলতে গিয়ে মুকুন্দ দাসকে একটু স্মরণ নেয়া যেতে পারে। প্রাচীন বাংলার খ্যাতিমান চারণ কবি ছিলেন তিনি। গায়ক হিসেবেও তার সুখ্যাতি ছিল। ইতিহাস বলে, তার গান শুনেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ। তৎকালীন জননেতা অশ্বিনী কুমার দত্তই এই আয়োজন করেছিলেন। মুকুন্দ দাসের স্মরণে নির্মিত হয়েছে কালীমন্দির। যদিও সেটির এখন ভগ্নদশা। দুপুরের খাবারের পর মুখে তুলে নিলাম বরিশালের বিখ্যাত ‘হক’-এর মিষ্টান্ন। সঙ্গে ক্ষীর, গুঠিয়া সন্দেশ। এরপর বেরিয়ে পড়ি শহর দেখব বলে। রবীন্দ্রনাথের পরেই অগ্রগণ্য কবি জীবনানন্দ দাশ। যিনি ফিরতে চেয়েছেন ধানসিঁড়ির তীরে। আর তার মা ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হওয়া’র ছেলে খোঁজা কবি কুসুমকুমারী দাশ। দু’জনেই বরিশালের গৌরব। রূপসি বাংলার রূপ তার মতো করে কোনো কবি মনে হয় আঁকতে পারেননি। দেখে এলাম তার কিছু স্মৃতিও। এরপরই তার স্মৃতিবিজড়িত বিএম কলেজ। যেখানে তিনি অধ্যাপনা করেছিলেন। বিশাল ক্যাম্পাস। দেখেই মুগ্ধ হওয়ার মতো। অনেকগুলো পুরনো বিল্ডিং মনে করিয়ে দেয় ঐতিহ্যবাহী এই কলেজ। কলেজের ভেতরে ঘুরে দেখলাম রয়েছে জীবনানন্দ মঞ্চ। সেখানে কবি কবি চেহারার কয়েকজন ছেলে-মেয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। সুন্দরী মেয়েরা যখন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন তখন কেমন জানি লাগে! কলেজে গিয়েও আমাদের তেমন অনুভূতি। বিএম কলেজ পেরিয়ে আমাদের যাত্রা ৩০ গোডাউন। এরপর বরিশাল টর্চার শেল দেখতে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দুটি ভবনে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকাররা নীরিহ বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন করত। সামনেই ইয়াহিয়া খানের ছবি সংবলিত একটি থু থু ফেলার ডাস্টবিন রয়েছে। সবাই একযোগে সেখানে থু থু ফেলে প্রতীকী প্রতিবাদ জানালাম রাজাকারদের প্রতি। আমাদের গাড়ির চাকা ঘুরছে। মাঝে মাঝে নানা আলোচনা। শহরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ আমরা। সঙ্গে থাকা স্থানীয়রা বললেন, এসব নাকি সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অবদান। কিন্তু নিয়তির নির্মমতা ব্রেন স্টোকে তিনি মারা যান।

অক্সফোর্ড মিশন গির্জায় আমাদের ঢোকা হয়নি নিরাপত্তার কারণে। বিশেষ দিন ছাড়া সেখানে ঢোকা নিষেধ। তবে বাহির থেকে এর নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করেছে। দেখে এলাম নতুন বাজারের কাছে কাউনিয়া মহাশ্মশান। দেশের সবচেয়ে বড় দীপাবলি উৎসব হয় সেখানে। রাজা বাহাদুর সড়কের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে কিছুটা সময় পার করে বিকেলের হাওয়া খেতে ছুটলাম বিখ্যাত কীর্তন খোলা নদীর পাড়ে। নদীর একরাশ মিষ্টি হাওয়া যেন জড়িয়ে নিলো আমাদের। নদীর পাশে পুরনো হাট। ছোট ছোট ডিঙি নৌকা ভাসছে। দূরে কোথাও যাচ্ছে ছোট লঞ্চ। হাওয়ায় কিসের যেন কানাকানি। সেই কীর্তনীয়া দল যেন রাধা-কৃষ্ণের যুগল মিলনের পদ গাইছেন। ফিরতে মন চায় না। জীবনানন্দ কী আর এমনিতে প্রেমে পড়েছিলেন। আমাদেরও প্রেম এসে যাচ্ছে। অদূরে হাওয়া খেতে আসা সুন্দরীর সঙ্গে যেঁচে গিয়ে আলাপ করতে মন চাইছে। তবে নোরাং আবর্জনায় কিছুটা জৌলুস হারিয়েছে নদী। তাই দেখে নাকি শেষবার জীবনানন্দ এসে আফসোস করেছিলেন। নদীর পাড়েই লঞ্চ টার্মিনাল। সেখানে নৌ কর্তৃপক্ষের উদ্ধারকারী জাহাজ দুর্বার ও নির্ভীক ভেসে আছে। আমাদের স্বাগত জানালেন নির্ভীকের কমাণ্ডার রফিকুল ইসলাম। ঘুরে ঘুরে দেখালেন কিভাবে জাহাজডুবির সময় তারা কাজ করেন। কিভাবে ঝড়ের সময় যন্ত্রগুলো কাজ করে। এমন নানা বৃত্তান্ত। ভাবলাম আমরা হয়তো ভাবি, ডুবে যাওয়া জাহাজ তুলতে তারা চেষ্টার ত্রুটি করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল বড় বড় জাহাজ তোলার মতো সামর্থ্য আমাদের উদ্ধারকারী জাহাজের নেই।

গোধূলিবেলা। সদর রোডের বিখ্যাত বিবির পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি একটু পরেই হয়তো ধানসিঁড়ির এই জেলা ছেড়ে পানিতে ভাসব ঢাকার উদ্দেশ্যে। বিকালের আয়োজনে বরিশালের বিখ্যাত দধিঘরের নানা উপাদান মিশ্রিত দই খেলাম সবাই। এরপর ছুটে চললাম শায়েস্তাবাদের দিকে। প্রকৃতিপ্রেমিক সোহাগ শায়েস্তাবাদ সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে থেকে চারদিকের যে অপরূপ দৃশ্য দেখালেন তা যেন ভুলবার নয়। চারদিকে সবুজের সমারোহ। দূরে কোথাও বেদেনী পল্লী। চোখের সুখ যেন আর ধরে না।

সূর্য নামে পাঠে। কুয়াশায় আমাদের দেখা হয় না। প্রাচ্যের ভেনিস ছেড়ে আমরা উঠি জলযান সুন্দরবন-১১তে। এক প্রেমিক ঘাটে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে তার প্রেমিকাকে। লঞ্চ সরে সরে আসে। প্রেমিক-প্রেমিকার মুগ্ধ দৃষ্টি সরে না। মনে হচ্ছে কোনো দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ ছেড়েছি আমরা। লঞ্চ ছুটে চলছে আপন গতিতে। আলোও সরছে। দূরে কোথাও মায়াবনে পরীদের দল মেতেছে উৎসবে। ডেকে দাঁড়িয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছি। অচিন আকাশ কানে কানে কথা বলছে। জীবনানন্দের ভাষায়, জোনাকির সঙ্গে ভেসে ভেসে পার করছি শেষ রাতে। চোখে স্বপ্নীল সুখ নিয়ে ফিরছি যান্ত্রিক নগরে।

কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে নদী ও সড়কপথে যাওয়া যায় বরিশাল। অনেকগুলো লঞ্চ ছেড়ে যায় প্রতিদিন সন্ধ্যায়। তবে ভালো কেবিন বা সিট পেতে হলে আগেই বুকিং দেয়া ভালো। বরিশালে বাসযাত্রার চেয়ে ভালো লঞ্চ যাত্রা। যেহেতু এটি বিভাগীয় শহর তাই থাকার মতো হোটেলেরও অভাব নেই।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম