Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে একদিন

Icon

লেখা ও ছবি : সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গত কয়েক মাস ধরে অফিসে কাজের খুব চাপ ছিল, এর মধ্যে একজন সহকর্মী ছুটিতে থাকায় আমার কাজের পাশাপাশি তার কাজও করতে হয়েছে। কাজের চাপে পিষ্ট হয়ে মন চাইছিল কোথাও ছুট দেই। মনস্থির করলাম শুক্র ও শনিবারসহ পাঁচ দিনের ছুটি নেওয়ার। ভ্রমণসঙ্গী সানন্দাকে বলে রাখলাম, তুমি তোমার মেডিকেল থেকে ছুটির ব্যবস্থা করে রেখ। যেই বলা, সেই কাজ; নির্ধারিত দিনে আমরা রওয়ানা হলাম কক্সবাজারের পথে। রাতের আঁধার পেরিয়ে সকালবেলা গাড়ি পৌঁছাল কক্সবাজার। হোটেলে ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্র দর্শনে। সমুদ্র দর্শন শেষে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চার চাকার পাইলট ফরহাদ আমাদের নিয়ে চলছে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের দিকে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি কক্সবাজার জেলা। পাহাড়, পর্বত, ঝরনাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দিয়ে ঘেরা এ জেলা। চকরিয়া উপজেলায়ই ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক। এটি দেশের অন্যতম সাফারি পার্ক। বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল প্রজাতি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধিসহ মানুষের চিত্তবিনোদন, গবেষণা ইত্যাদি পরিচালনার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসংলগ্ন চকরিয়া উপজেলায় দেশের অন্যতম ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। রাস্তার দুই পাশে প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। পাইলট গন্তব্যস্থলের রাস্তা চিনে না, তাই গুগল ম্যাপই ভরসা আমাদের। গুগল ম্যাপের দেখানো পথনির্দেশনায় আমরা চলছি এগিয়ে। রাস্তা অনেক ভালো। সেই আগের লক্কড়ঝক্কড় সড়ক আর নেই। এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পর মহাসড়কের ডান পাশে লেখা দেখতে পেলাম ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক। দুই পাশে দুটো হাতি আমাদের স্বাগতম জানাল। কিছুটা পথ এগিয়ে আমরা দেখতে পেলাম আই লাভ ডুলাহাজারা লেখা বোর্ড। এর পাশেই প্রবেশপথ। গাড়ি থেকে নেমে টিকিট কিনে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সামনে ডাইনোসর, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জিরাফের প্রতিকৃতি। সময় ভরদুপুর। গত রাতের যাত্রাপথের ক্লান্তি এখনো ছাড়েনি। এদিকে ভেতরে ম্যাপ দেখে বুঝতে পারলাম, পুরোটা পার্ক হেঁটে দেখা এ ক্লান্ত শরীর নিয়ে সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সবকিছু দেখা অধরাই রয়ে যাবে। কী করা যায় ভাবছিলাম, এরই মধ্যে এক লোক এসে বললেন, বাস লাগবে কিনা...? পুরো পার্ক ঘুরিয়ে দেখাবে। আমি বললাম, কত টাকা লাগবে, বললেন, পুরো বাস ভাড়া নিলে ৩০০ টাকা লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। সে এটিও বলল, বাস ড্রাইভারকে বকশিশ দিলে সব জায়গায় সময় নিয়ে দেখাবে। আমি বললাম অসুবিধা নেই, বকশিশ দেব। কিছুদূর বাস যাওয়ার পরই সহকারী বাস থামিয়ে দেখাতে লাগালেন। আমরা দেখা পেলাম নানা প্রজাতির কচ্ছপের। সবাই ক্লান্ত, তাই ছায়ায় গিয়ে বসে আছে। পাশে অজগরের খাঁচা। এ খাঁচার বিপরীতেই আছে বন্যপ্রাণী হাসপাতাল। এখানে অসুস্থ পশুপাখির চিকিৎসা দেওয়া হয়। মিনিটখানেক পর দেখা পেলাম ইমু পাখির। ইমু পাখির ব্যবহারে বোঝা গেল মানুষের সঙ্গে তার খুব সখ্য। এর পাশেই দেখা পেলাম পেখম তোলা ময়ূরের। এদিক-ওদিক লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বানর, পাশে শিয়ালের খাঁচা। কালো রঙের শিয়ালটি খাঁচার এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরছে। যেন সুযোগ পেলেই পালিয়ে যাবে। এর পাশেই আছে লেজ উলটো বানর। সে যেন সবসময় শিয়ালকে বুদ্ধি দিচ্ছে, কীভাবে পালিয়ে যাওয়া যায়। পাশের খাঁচায় দেখা পেলাম বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এখানে কিছু পাখি খাঁচায় বন্দি, বাকিগুলো প্রাকৃতিকভাবে ছাড়া। এরপর বাসে উঠে এগিয়ে চললাম। বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালিতে ভরা ঘন বন। প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত নির্জন উঁচু-নিচু টিলা, প্রবহমান ছড়া, হ্রদ, বিচিত্র গর্জনের মতো সুউচ্চ ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক বৃক্ষ চিরসবুজ বনের জানা-অজানা গাছগাছালি, ফল-ভেষজ উদ্ভিদ, লতার অপূর্ব উদ্ভিদের সমাহার ও ঘন আচ্ছাদনে গড়ে উঠেছে সাফারি পার্ক। এর ছায়াঘেরা পথ, সবুজ বনানী, জানা-অজানা গাছের সারি, পাখি আর বানরের কিচিরমিচির সবকিছু মিলিয়ে যেন এক অসাধারণ অনুভূতি। লেকের পাশে দেখা পেলাম লোনা পানির কুমির ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরইসঙ্গে সরস পাখির বাস। আমরা এগিয়ে গেলাম সম্মুখ পানে। আমাদের পথ আগলে ধরল হাতি আর তার মাহুত।

কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা পেলাম দশতলা ওয়াচটাওয়ার। কিন্তু ওয়াচটাওয়ার কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ করা। ওয়াচটাওয়ার বন্ধ কেন, জানতে চাইলে জানান, ওয়াচটাওয়ারের রেলিং ভেঙে গেছে, তাই এটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এর পরই দেখা পেলাম লেকের জলে জলহস্তীর। আমাদের গাইড পাশ থেকে কিছু লতাপাতা ছিঁড়ে জলহস্তীগুলোকে ডাকতে লাগল। ডাক শুনে জলহস্তীগুলো আমাদের দিকে আসতে লাগল। তিনি জলহস্তীর দিকে খাবার ছুড়ে দিলেন। খাবার পেয়ে জলহস্তীগুলোকে খুব উচ্ছ্বসিত মনে হলো। এরপর আমরা গেলাম বাঘের খাঁচার দিকে। দেখা পেলাম বাঘের খাঁচার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীকে। তিনি আমাদের বাঘের খাঁচার দিকে নিয়ে গেলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ইশারা দিতেই বাঘ কাছে চলে এলো। আমরাও তার সঙ্গে বাঘের মাথা হাতিয়ে দিলাম। এর সঙ্গে আছে সিংহ মামার খাঁচা। সেখানে গিয়ে ভদ্রলোকটি রাসেল কোথায় বলতেই সিংহ মামা দৌড়ে কাছে চলে এলো। আবার তিনি বললেন, রাসেল এবার গর্জন করে দেখাও তো... বেশ কয়েকবার বলার পর ঠিকই সিংহ মামা গর্জন করে উঠল। যাই হোক, সিংহ মামার কর্মকাণ্ড দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। আরও দেখা পেলাম জেব্রা, গয়াল, হরিণ, চিত্রাহরিণ, প্যারা হরিণ। দেখতে দেখতে কীভাবে যে তিন ঘণ্টা পার করে দিলাম, বুঝতেই পারলাম না। এদিকে আমাদের বিদায়বেলা চলে এলো, আমরা ফিরে চললাম কক্সবাজার শহর পানে।

কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী সৌদিয়া, এস আলম, গ্রিনলাইন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহণ, সোহাগ পরিবহণ, মডার্ন লাইন ইত্যাদি বাসে সরাসরি ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে আসতে পারবেন। শ্রেণিভেদে বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৯০০ থেকে ২০০০ টাকা। ঢাকা থেকে ট্রেনে ভ্রমণ করতে হলে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা-নিশীথা, মহানগর প্রভাতি-গোধূলি ও চট্টগ্রাম মেইলে যাত্রা করতে পারেন। চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ এলাকা অথবা দামপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে এস আলম, হানিফ, ইউনিক ইত্যাদি বিভিন্ন ধরন ও মানের বাসে ২৮০ থেকে ৫৫০ টাকা ভাড়ায় সাফারি পার্কে আসতে পারবেন। এ ছাড়া কক্সবাজার এসে সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রোবাস কিংবা লোকাল বাসে চড়ে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে আসতে পারবেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম