পরিযায়ী পাখি দেখতে...
লেখা ও ছবি- সুমন্ত গুপ্ত
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গত সপ্তাহে কাজের চাপ গিয়েছে ভীষণ রকম। আর প্রতিদিন সেই সকাল আটটায় বাসা থেকে বেরিয়ে নিত্যদিনের যন্ত্রণা যানজট সহ্য করে অফিসে যেতে হয়। আবার অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় আসতে আসতে রাত নয়টা। তখন আর নিজেকে আর পরিবারকে সময় দেয়ার জন্য কোনো সময়ই হাতে থাকে না। তাই শুক্র আর শনিবার দিনটি আমার কাছে সোনার হরিণের মতো। প্রতি সপ্তাহের শুরুর দিন অপেক্ষা করতে থাকি কবে শুক্রবার আসবে আর একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচব। যাই হোক ঘড়ির কাঁটা ঘুরে ঘুরে আবার এসেছে বৃহস্পতিবার। আগামীকাল কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় এ নিয়ে ভাবছি। আর বেশি দূরে কোথাও যাওয়াও যাবে না, কারণ মাসের শেষ তাই পকেটও হালকা। কথা হচ্ছিল আমার সহধর্মিণী সানন্দা গুপ্তের সঙ্গে কোথায় যাওয়া যেতে পারে বলতো। আর বেশি দূরেও যাওয়া যাবে না কাছে-পিঠে যেতে হবে। তখন ও বলল, আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুরে আসতে পারি। শীতের আগমন ঘটেছে বেশ কিছুদিন হতে চলল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গেলে পরে অতিথি পাখির দেখা পাব আমরা।
সবুজ প্রকৃতির মাঝে নির্মল এক জায়গা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শীতের শুরু থেকেই জাবি ক্যাম্পাস পরিযায়ী অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকে। আমি মনে মনে ভাবলাম মন্দ হয় না। কাছের দূরত্ব আর অনেক কিছু দেখতে পারব। রাতে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম সকাল সকাল উঠতে হবে নতুন গন্তব্য পথে যাওয়ার জন্য। সানন্দার ডাকাডাকির চোটে ঘুম থেকে উঠতে হল। চোখ মেলে তাকাতে সানন্দার প্রশ্ন কয়টা বাজে এখন জানো তুমি? আমি জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি সূর্যদেবের আভা এতটা প্রকাশিত না তার মানে খুব একটা বেলা হয়নি। আমি বললাম কয়টা হবে, আর সকাল সাতটা হবে আর কি। বলতেই সানন্দা বলল, ঘড়ির দিকে তাকাও একবার। ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমার চোখ মাথায় উঠার যোগার ঘড়ির কাঁটায় বেলা এগারোটা বাজি বাজি। আমি বললাম, কেমনে কি হল আমি অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম কিন্তু... সানন্দা বলে উঠল আর ভাবতে হবে না দ্রুত তৈরি হয়ে নেও। আমি আর দেরি না করে প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। বারোটার দিকে আমরা আমাদের ডেরা থেকে বের হলাম গন্তব্য পানে যাওয়ার জন্য। বাসা থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছি রিকশার জন্য গুলিস্তান যাব বলে, সেখান থেকে বাসে করে যেতে হবে সাভারে। কিন্তু কোনো রিকশার দেখা নেই। বেশ কিছু সময় পর একজন তিন চাকার মহাজনের দেখা পেলাম। তাকে বলে রাজি করালাম গুলিস্তান নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি, সানন্দা আর অনিক তিনজন উঠলাম এক রিকশায়। একটু কষ্ট হচ্ছিল, এক রিকশায় যেতে কিন্তু কিছুই করার নেই। আমরা পৌঁছলাম গুলিস্তান গিয়েই পেলাম একটি বাস, সাভারে যাবে যাত্রীর জন্য ডাকাডাকি করছে, আমরা চেপে বসলাম বাসে। পনেরো থেকে বিশ মিনিটের ভেতর বাস ছাড়ল গন্তব্য পানে।
নগর জীবনের কোলাহল পেরিয়ে চলছে এগিয়ে আমাদের চার চাকার বাস। মিরপুর, ধানমণ্ডি, ফুলবাড়ি হয়ে চলছে এগিয়ে। মাঝে মাঝে রাস্তায় জ্যাম যাত্রাপথকে দীর্ঘায়িত করছে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা এসে পৌঁছলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে। বাস থেকে নেমেই নিয়ে নিলাম তিন চাকার মানবভ্যান অতিথি পাখি দেখতে যাব বলে। উত্তরের হাওয়া বলে দিচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শীতের প্রকোপ ভালোই পড়েছে। আমরা চলছি এগিয়ে এক অনিন্দ প্রাকৃতিক আবহের ভেতর দিয়ে।
দেখা পেলাম জলাশয়ে অসংখ্য পদ্ম ফুটে রয়েছে। আমাদের ভ্যানের পাইলট বললেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২টির মতো জলাশয় আছে। এর মধ্যে পাখির আনাগোনা বেশি প্রশাসনিক ভবনের সামনে ও পেছনের দুটি জলাশয়, জাহানারা ইমাম হল, প্রীতিলতা হল এবং আলবেরুনী হল সংলগ্ন জলাশয়ে। সবগুলো জলাশয়ে আছে লাল শাপলা। দিনের প্রথম ভাগে শাপলারা ফুটন্ত থাকে। লাল শাপলার এ গালিচার মাঝে অতিথি পাখিদের আনাগোনাও যে কারোর মন ভালো করে দেবে। বর্তমানে ক্যাম্পাসের জলাশয়ে হাঁস-পাখি ‘পাতি সরালি’র প্রাধান্যই বেশি। এ ছাড়া মাঝে মাঝে দেখা মিলবে ছোট পানকৌড়ি, ধলাবুক ডাহুক কিংবা পাতি পানমুরগির। আমরা দেখতে চলে এলাম প্রশাসনিক ভবনের সামনে। নেমেই দেখতে পেলাম অতিথি পাখিরা নির্ভাবনায় মেতে উঠেছে খোশগল্প আর জলকেলিতে। কেউবা আবার ডুব সাঁতারে ব্যস্ত। লেকের কোথাও তারা জুটিবদ্ধভাবে নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। আবার কখনও তারা চক্রাকারে চিৎকার করে উড়ে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাসের মুক্ত আকাশজুড়ে। অতিথি পাখির কলকাকলি আর কিচিরমিচির শব্দে এক মধুময় সুরের আবহ বিরাজ করছে।
আমি ছবি তুলতে লাগলাম একের পর এক। এদিকে অনিক বলে উঠল, সে কুলফি খেতে চায়। তার মতে, শীতের মধ্যে ঠাণ্ডা খেতে মজা বেশি। আমি বিক্রেতাকে বললাম আমাদের তিনজনকে কুলফি দেন, বলতেই প্রত্যুত্তরে বিক্রেতা বলে উঠলেন, তিন রকমের কুলফি স্পেশালটা দিব নাকি। আমি বললাম, খাব যেহেতু স্পেশালটাই দেন। অনিকের কথাই ঠিক শীতের মিষ্টি হাওয়ার মধ্যে ঠাণ্ডা কুলফি খাওয়ার মজাই আলাদা। কুলফি খেয়ে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে। দেখা হল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিথুনের সঙ্গে ও বলল প্রতিবছর উত্তরের শীতপ্রধান দেশ সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, সিনচিয়াং ও ভারত থেকে হাজার হাজার অতিথি পাখি দক্ষিণ এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে আসা পাখিদের ৮-৯ শতাংশ এ ক্যাম্পাসে আসে। মূলত অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বরের প্রথম দিকেই এরা এ দেশে আসতে শুরু করে। মার্চের শেষ দিকে তারা আপন ঠিকানায় ফিরে যায়।
বাংলাদেশের মানুষ শখ করে যাযাবর এসব পাখিকে ডাকে গেস্ট বার্ড/মাইগ্রেটরি বার্ড বা অতিথি পাখি। অসম্ভব বন্ধুসুলভ এ পাখিগুলোর অনেকটাই আমাদের দেশি হাঁস প্রজাতির। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোয় প্রায় ৫০ প্রজাতির অসংখ্য পাখির আগমন ঘটেছে। এদের বেশিরভাগই হাঁস জাতীয় ও পানিতে বসবাস করে। এর মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইফেচার, গার্গেনী, ছোট জিরিয়া, মুরগ্যাধি, কোম্বডাক ও পাতারি অন্যতম। এ ছাড়া মানিকজোড়, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, নাকতা, খঞ্জনা, চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি প্রভৃতি পাখি এ দেশে অতিথি হয়ে আসে প্রতিবছর। অবিরাম তুষারপাতে এবং তীব্র শীতের কারণে ওই সব অঞ্চলে বসবাসরত পাখিরা হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে।
এখানে ছোট-বড় প্রায় ২২টি লেক থাকলেও পাখিরা ক্যাম্পাসের হাতেগোনা মাত্র দু-তিনটি লেকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাদের আবাসস্থান হিসেবে গড়ে তোলে। আমাদের মতো অনেকেই এসেছেন পরিযায়ী পাখি দেখতে। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম, এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল, পেটে তেমন কিছুই দেয়া হয়নি। সানন্দা বলে উঠল, চলো এবার বটতলার দিকে যাই সেখানে গেলে শত পদের ভর্তা দিয়ে দুপুরের পেট পূজাটা সেরে নেই।
যেই বলা সেই কাজ, আমরা পদব্রজে বটতলা পানে এগিয়ে যেতে লাগলাম। স্বল্প সময়ে পৌঁছে গেলাম বটতলায়, মানুষের সমাগম বেশ প্রতিটি খাবারের দোকানে। একটিতে ঢুকে পড়লাম আমরা কিন্তু কোনো আসন খালি না থাকায় কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হল আমাদের। শেষ পর্যন্ত আমাদের আসনের ব্যবস্থা হল। বসতেই আমাদের সামনে হরেক রকমের ভর্তা হাজির করা হল- শিম ভর্তা, বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, টমেটো ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, গাজরের ভর্তা, পুদিনাপাতা ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা আর কত কি- সবগুলোর নামও মনে নেই। যাই হোক প্রায় আট রকমের ভর্তা দিয়েই দুপুরের ভ‚রিভোজ শেষ করলাম আমরা। ভোজন পর্ব শেষ করে এগিয়ে গেলাম আমরা সামনের দিকে সেখানে দেখা পেলাম মিষ্টি পান নিয়ে বসেছেন বিক্রেতা, আমাদের ভ্রমণসঙ্গী অনিক মিষ্টি পান খেতে চায়, তাই তার জন্য মিষ্টি পান নেয়া হল। এরপর সানন্দা বলে উঠল, প্রান্তিক মোড়ের পাশের মাঠে কাপড়ের বাজার বসে, সেখানে চল যাই। ওই জায়গায় ভালো কাপড় পাওয়া যায়, আর দামেও সস্তা। আমরা গেলাম প্রান্তিক মোড়ের পাশের মাঠে সেখানে দেখা পেলাম মানুষের ভিড়ে জমজমাট বাজার। সানন্দা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল প্রতিটি দোকান। দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে গেল যে কীভাবে আমরা টেরই পেলাম না। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সারাটি বেলা কাটিয়ে এবার বিদায় নেয়ার পালা; আমরা ফিরে চললাম নাগরিক যন্ত্রণার শহরে।
কখন যাবেন
মূলত অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বরের প্রথম দিকেই অতিথি পাখিরা বাংলাদেশে আসে। আবার মার্চের শেষ দিকে ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। ক্যাম্পাসে পাখি দেখার সবচেয়ে ভালো সময় শীতের সকাল এবং বিকাল। তাই খুব সকালে গিয়ে সারাদিন কাটাতে পারেন ক্যাম্পাসে। দুপুরে খেয়ে নিতে পারেন ক্যাম্পাসের বটতলাখ্যাত বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়। খুব কম দামে হরেক পদের ভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার সারতে পারবেন।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার গুলিস্তান, ফার্মগেট, কল্যাণপুর কিংবা গাবতলী থেকে নবীনগর, মানিকগঞ্জগামী যে কোনো বাসে চড়ে সহজেই নেমে যেতে পারবেন ক্যাম্পাসের সামনে। ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার জন্য সহজ বাহন তিন চাকার ভ্যান গাড়ি অথবা রিকশা।
