Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

রূপের বর্ষা বর্ষার রূপ

Icon

হাবীবাহ্ নাসরীন

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে

জানি নে,জানি নে

কিছুতে কেন যে মন লাগে না...’

বর্ষা এমনই এক ঋতু, যা যে কাউকে উদাস করে ফেলে। মনের ভেতরে লুকানো নিগূঢ় কোনো দুঃখবোধকে এক নিমিষে জাগিয়ে তুলতে পারে বর্ষা। আবার তা ধুয়েমুছে সাফও করে দিতে পারে। কবির মনেও গভীর ছায়া ফেলে এ ঋতু। তাইতো এই ঋতুকে ঘিরে শত-সহস্র কবিতা লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। বর্ষার রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে তৈরি হয়েছে কত যে কালজয়ী গান। এই ঋতু আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। গ্রীষ্মের নিষ্ঠুর খরতাপের পরে এক পশলা শান্তির বার্তা নিয়ে আসে বর্ষা।

শহরে বর্ষা

আমাদের এই যান্ত্রিক শহুরে জীবনে বর্ষাকে কাছ থেকে অনুভব করার সুযোগ আসে না। আমরা শুনতে পাই না সেই টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার রিমঝিম শব্দ। তবু ভীষণ রৌদ্রে পোড়া পিচঢালা পথ যখন ভিজে যায় শান্তির বর্ষায়, সেই রূপও সাধারণ নয়! সারা দিনের ব্যস্ততার শেষে প্রিয়জনের সঙ্গে বসে গরম গরম খিচুড়ি আর মাংস ভুনা খাওয়ার আনন্দও ঘটে এই বর্ষায়। আমরা, শহরের মানুষরা বর্ষার রূপ উপলব্ধি করতে পারি বা না পারি, বর্ষা ঠিকই আসে তার রূপের ডালি সাজিয়ে। এই সময়ে একটু গ্রামের দিকে গেলেই দেখা মিলবে সেই অনন্য রূপের। মাঠে-ঘাটে, খালে-বিলে থইথই জলের রাশি, যেখানে জল আর সবুজ মাখামাখি করে হাসছে- এমন রূপে কার না নয়ন জুড়ায়!

কবিতায় বর্ষা

বিদ্রোহী ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষাকে চঞ্চলা মেয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় সে সৌন্দর্য বিকশিত হয়। বর্ষায় কদম ফোটে। সে অপরূপ সৌন্দর্যের কথা কবি চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘ওগো ও কাজল-মেয়ে,

উদাস আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে।

কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে

তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।

ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায়-পথে

কাননে কাননে কদম-কেশর ঝরিছে প্রভাত হতে।

তোমার আদরে মুকুলিতা হয়ে উঠিল যে বল্লরী

তরুর কণ্ঠ জড়াইয়া তারা কাদে নিশিদিন ভর।’

কবি অমিয় চক্রবর্তী বর্ষাকে অস্তিত্বের অতলান্তে নিয়ে গেছেন। বৃষ্টি ঝরে মাঠে, ঘাটে, বন্দরে, মরুতে, বনতলে, গূঢ় প্রাণে, শিরায়-শিরায়, মনের মাটিতে। সর্বত্র বর্ষা যেন গ্রাস করে সব অস্তিত্ব, আমাদের প্রাণের ফসল। বর্ষা নামে দিগন্তের দশ দিকজুড়ে। তিনি বলেছেন, ‘অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে, বৃষ্টি ঝরে রুক্ষ মাঠে, দিগন্ত পিয়াসী মাঠে মাঠে, মরুময় দীর্ঘ তিয়াষার মাঠে, ঝরে বনতলে, ঘন শ্যাম রোমাঞ্চিত মাটির গভীর গূঢ় প্রাণে, শিরায়-শিরায় স্নানে, বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে।’

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বর্ষার আকাশকে প্রকাশ করেছেন চমৎকারভাবে। বর্ষায় আকাশের রঙ-রূপ বৈচিত্র্যে ভরপুর থাকে। মাঝে মাঝে রংধনু ওঠে। আকাশে যেন বিভিন্ন বর্ণের মেঘের খেলা চলে। বিভিন্ন সময় মেঘের বিভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়। এ যেন আনন্দের পসরা। আকাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধূসর কৃষ্ণ মেঘপুঞ্জের ঘনঘটা সবাইকে মুগ্ধ করে, কাছে টানে অন্য এক অজানা আকর্ষণে। তিনি বলেছেন- ‘শ্রান্ত বরষা, অবেলায় অবসরেপ্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া; স্বর্ণ সুযোগে লুকোচুরি খেলা করে গগনে গগনে পলাতক আলো-ছায়া।’ কবি শহীদ কাদরীর ভাষায়- ‘বৃষ্টি পড়ে মোটরের বনেটে টেরচাভেতরে নিস্তব্ধ যাত্রী, মাথা নিচুত্রাস আর উৎকণ্ঠায় হঠাৎ চমকে দ্যাখে জল-অবিরল জল, জল, জলতীব্র, হিংস্র, খল।’

বর্ষার ফুল

বর্ষা মানে বাহারি রঙের সুগন্ধি ফুলের সমাহার। বর্ষা যেন আমাদের প্রকৃতিকে আপন মনে বিলিয়ে দেয় এবং এর ফুলের সৌন্দর্য আমাদের করে তোলে বিমোহিত। বর্ষার নানারকম ফুলগুলো ফুটতেও শুরু করেছে। বর্ষার যে ফুলগুলো আমাদের আকৃষ্ট করে তা হল শাপলা, কদম, কেয়া, কলাবতী, পদ্ম, দোলনচাঁপা, চন্দ্রপ্রভা, ঘাসফুল, পানাফুল, কলমি ফুল, কচুফুল, ঝিঙেফুল, কুমড়াফুল, হেলেঞ্চাফুল, কেশরদাম, পানিমরিচ, পাতা শেওলা, কাঁচকলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, উলটকম্বল, কেওড়া, গোলপাতা, শিয়ালকাঁটা, কেন্দার, কামিনী, রঙ্গন, অলকানন্দ, বকুল এবং এ ছাড়া নানা রঙের অর্কিড। বর্ষা ঋতু যেন ফুলের জননী। আবহমান কাল ধরেই আমাদের প্রকৃতিকে বর্ষার ফুল স্বতন্ত্র সৌন্দর্য বিলিয়ে দিয়ে আসছে উদারতায়। বর্ষা ও তার ফুল যেন বাংলার প্রকৃতির আত্মা। বৃষ্টিস্নাত বর্ষার ফুলের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের মন রাঙিয়ে আসছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম