Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

কাঁঠালের রাজধানীতে

Icon

লেখা ও ছবি : সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আগামী দিন সকালে বের হতে হবে নতুন গন্তব্য পানে তাই একটু আগেই শুরু করে দিলাম ঘুমানোর প্রস্তুতি। আগের নির্দেশ মতোই দিবা প্রথম প্রহরেই মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে উঠল। কষ্ট করে নয়ন খুলে দেখি সকাল ছয়টা বাজে, ভাবলাম আরেকটু সময় ঘুমিয়ে নেই। যেই ভাবা সেই কাজ, চলে গেলাম নিদ্রা দেবীর আবেশে। শেষ পর্যন্ত অনিকের ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠতেই হল। এদিকে আমাদের পাইলট মহোদয়ের ফোন চলে এসেছে। ফোন ধরতেই জুলহাস ভাই বলে উঠলেন আমি সেই ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে অপেক্ষা করছি। পাইলট মহোদয়ের কথায় বুঝতে পাড়লাম উনি একটু বিরক্তই। আমি দ্রুত তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আমার অস্থায়ী কুটির থেকে। গাড়িতে উঠতেই জুলহাস ভাই বলে উঠলেন আপনাদের দেরি হবে আগে বুঝলে আরেকটু সময় বাসায় ঘুমিয়ে আসতে পারতেন। ঘড়ির কাঁটায় তখন আটটা, আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। ও বলাই হল না আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য আমার সহধর্মিণীর বাপের বাড়ি, কাঁঠালের রাজধানী বলে খ্যাত গাজীপুরের ছাতিয়ানি গ্রামের দিকে। আমরা চলছি মহাসড়ক পেড়িয়ে গন্তব্য পানে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ঋতু হাজির হয় গরম-নরম-রসালো উপহার নিয়ে। বাংলাদেশের গরম অন্যান্য গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মতো না হওয়ার কারণে পর্যটকদের ভ্রমণে তেমন কষ্ট হয় না। আর কষ্ট হবেই বা কেন? গ্রীষ্ম ঋতু হচ্ছে বাংলাদেশের মধুমাস এবং নানা ধরনের রসালো ফল ও বাহারি ফুলের মাস, পাখির গানের মাস। এ মাসে রসালো এবং সুস্বাদু ফলের ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ করে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মের উপহার রসালো ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কাউ, আনারস, তরমুজ, আতা, লটকন, জামরুল ইত্যাদি। এ সুস্বাদু ফল গ্রীষ্মের তাপকে হালকা করে দেয়। পর্যটকদের শরীর সতেজ করে।

ঈদের পরপর তাই মহাসড়কে নেই এতটা যানজট। মতিঝিল, মহাখালী, টঙ্গী পেড়িয়ে চলছি আমরা। দেখতে দেখতে এসে পৌঁছালাম আড়িখোলা বাজারে। এবার খানিক সময়ের বিরতিতে গেলাম, কারণ সেই সকালে বের হয়েছি এবার পেটে কিছু দেয়ার প্রয়োজন। ঢুকে পড়লাম সাইনবোর্ডবিহীন এক হোটেলে। জনমানবপূর্ণ কোথাও নেই বসার জায়গা। বেশ কিছু সময় অপেক্ষার পর পেলাম বসার জায়গা। বিরক্তি নিয়ে একজন এলেন কী লাগবে। অনিক বলল, ও পরোটা আর ডিম ভাজি খাবে, অন্যরাও অনুরূপ খাবে তাই দুটো করে পরোটা আর ডিম ভাজি দেয়ার কথা বলা হল। কিছু সময় পর বলা হল, দুটো করে পরোটা দেয়া যাবে না কারণ পরোটা তৈরির উপাদান শেষ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত একটি করে পরোটা দিয়েই পেটপূজা শেষ করতে হল। তবে পরোটা বেশ সুস্বাদুই ছিল। সহধর্মিণী সানন্দা খেতে চাইলেন চা তাও নেই। জনৈক একজন বললেন, সামনে একটি দোকানের গরুর দুধের চা বিক্রি করে সেখানে চা খেতে পারেন ভালো লাগবে। গেলাম সেই দোকানে, বসলাম কাঠের বেঞ্চে দেয়া হল গরুর দুধের চা। অসাধারণ স্বাদ, শহুরে জীবনে আমরা যারা কনডেন্স মিল্ক দিয়ে চা খেয়ে অভ্যস্ত তাদের জন্য এই চায়ের স্বাদ অন্যরকম বলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। দোকান থেকে বের হয়ে এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যপানে। চলতি পথে দেখা পেলাম মানুষের বাড়ির উঠানে কাঁঠাল, ঘরে কাঁঠাল, বাইরে কাঁঠাল, গাছে কাঁঠাল, গাছের তলায় কাঁঠাল, চারদিকে শুধু কাঁঠাল আর কাঁঠাল। বাজারজুড়ে কাঁঠালের স্তূপ। মহাসড়কের দু’পাশে স্তূপ আকারে পড়ে আছে হাজার হাজার কাঁঠাল। পাকা কাঁঠালের গন্ধে এখন মৌ মৌ করছে চারদিক। এ সময়ের পরিচিত দৃশ্য এটি। আমরা পৌঁছালাম ছাতিয়ানি গ্রামে, সেখানে সানন্দাদের বাড়িতে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাঁঠাল বাগান দেখতে।

আমরা চলছি পদব্রজে যেদিকে তাকাই শুধুই কাঁঠাল গাছ। গাছে গাছে ঝুলে আছে কাঁঠাল আর কাঁঠাল। পাকা কাঁঠালের গন্ধে অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করছে। আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে, শুধু যে কাঁঠাল গাছ তা না কোথাও কোথাও জাম, বুবি, আম গাছেরও দেখা পেলাম। অনেকেই আবার বাগান থেকে কাঁঠাল কেটে এক পাশে জড়ো করছে বাজারে নিয়ে যাবে বলে। বাগানের মালিক সদ্য পেরে আনা কাঁঠাল উপহার দিলেন। আমার ভ্রমণ সঙ্গী অনিক তো বেজায় খুশি। আমরা এগিয়ে গেলাম কাঁঠালের হাঁটের দিকে। উপজেলার কালীগঞ্জ বাজার, নাগরী বাজার, উলুখোলা বাজার, বক্তারপুর বাজার, ফুলদী বাজার, জাঙ্গালিয়া বাজার, আলাউদ্দিরটেক বাজার, আওয়াখালী বাজার, দোলান বাজার, জামালপুর বাজার, সাওরাইদ বাজারে প্রতিদিনই বসে কাঁঠালের হাট। প্রতিদিন ভোরে বাগান থেকে পাকা কাঁঠাল সংগ্রহ করে পুরুষরা তা বিক্রির জন্য ট্রাক, পিকআপ, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, টমটম, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক ও অটোরিকশায় করে নিয়ে আসেন বাজারে। মৌসুমের প্রতিদিনই ওই বাজারগুলোতে বিক্রি হয় লাখ লাখ কাঁঠাল। দিনে-রাতে প্রায় সব সময়ই চলে এ বেচাকেনা। তবে সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তাই দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা আসেন উপজেলার ওই বাজারগুলোর কাঁঠালের হাটে। আর কালীগঞ্জের কাঁঠাল নিয়ে যান রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোতে। কাঁঠালের এই মৌসুমকে কেন্দ্র করে বাগান থেকে কাঁঠাল বাজারে আনা, কেনাবেচা, গাড়িতে ওঠানো-নামানোসহ এর সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার লোক। আর হাজার হাজার মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয় কাঁঠালের এই মৌসুমকে ঘিরেই। আমরা বাজার থেকে কয়েকটি কাঁঠাল কিনলাম নগরবাসীকে উপহার দেব বলে, কারণ শহরজীবনে নকল খেতে খেতে মানুষ আসল ফলের স্বাদই ভুলে গেছে। গাড়ি বোঝাই করে কাঁঠাল নিয়ে আমরা ফিরে চললাম শহরপানে।

যাবেন কীভাবে

ঢাকা থেকে বিভিন্ন পথে যেতে পারবেন গাজীপুরে ছাতিয়ানি গ্রামে। যাওয়ার প্রথম পথ হল গুলিস্তান থেকে নরসিংদীগামী বাসে উঠে নামতে হবে নরসিংদীর পাঁচদোনায়। সেখান থেকে কালিগঞ্জগামী বাসে উঠে নামতে হবে কাপাসিয়া মোড়ে, সেখান থেকে সিএনজি করে চলে যান ছাতিয়ানি। মহাখালী থেকে যেতে চাইলে আপনাকে উঠতে হবে চলনবিল/ বাদশা বাসে, নামতে হবে কাপাসিয়া মোড়ে। কাপাসিয়া মোড় থেকে সিএনজি করে চলে যান ছাতিয়ানি গ্রামে। খরচ পড়বে ১৩০ থেকে ১৮০ টাকা অথবা গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। খরচ পড়বে ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম