সোনারগাঁয়ে কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব
দেওয়ান সামছুর রহমান
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমরা যখন মেলায় ঢুকছি তখন বেশ লম্বা লাইন। শুক্রবার বলে ভিড়টা একটু বেশিই। প্রথমেই সুদৃশ্য তোরণ দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাচ্ছে। সোনারগাঁকে যেহেতু এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক কারুশিল্প নগর হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তাই এবারের মেলার একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। আবহমান বাংলার বিলুপ্তপ্রায় লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে প্রতি বছরের মতো এ বছরও বাংলা মাঘ মাসব্যাপী ঐতিহাসিক প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব-২০২০।
বাংলার লোকশিল্প ও লোকজ ঐতিহ্য বিকাশের এক সমৃদ্ধ জনপদ সোনারগাঁ। গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া কৃষ্টি আর ঐতিহ্যকে ধারণ করতে, লোকজ সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে প্রাচীন বাংলার রাজধানী খ্যাত সোনারগাঁয়ে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় মাসব্যাপী লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের। স্বাধীন বাংলার প্রখ্যাত সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ, সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ ও বাংলার বার ভূঁইয়ার অন্যতম বিখ্যাত ঈশা খাঁর রাজধানী সোনারগাঁয়ের ইতিহাস ছিল অনেক বেশি জ্বলজ্বলে। সময়ের পরিক্রমায় তা ম্লান হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যাওয়া সোনারগাঁকে পুনর্জাগরিত করতে এবং গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে ধারণ ও বাহন করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন।
এ ফাউন্ডেশনের অধীনে লোকশিল্প জাদুঘরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির। এরই অংশ হিসেবে এ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে গত ১৪ জানুয়ারি-২০২০ থেকে ১২ ফেব্র“য়ারি-২০২০ পর্যন্ত মাসব্যাপী এ মেলা ফাউন্ডেশন চত্বরে ‘সোনারতরী’ লোকজমঞ্চে উদ্বোধন করা হয়। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ মেলার উদ্বোধন করেন। মন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনকে আন্তর্জাতিকমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
শান্তস্নিগ্ধ, গ্রাম বাংলার প্রকৃত রূপকে উপলব্ধি করতে, বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির অনেক কিছু দেখতে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর আধুনিকতার মিশেলে এ মেলায় কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে যেতে পারেন। কিছু সময়ের জন্য ফিরে যেতে পারেন আজন্মলালিত শৈশবের স্মৃতি রোমন্থনে। আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতেই প্রতিবছর এ মেলার আয়োজন করা হয় বলে জানালেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক আহমেদ উল্লাহ।
এ মেলায় ১৭২টি চারু ও কারু পণ্যের স্টল রয়েছে। পল্লী অঞ্চলের ৬৪ জন কারুশিল্পী এ মেলাতে অংশ নিচ্ছেন। তাদের জন্য ৩২টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ মেলায় রয়েছে কারুপণ্য উৎপাদন প্রদর্শনীর স্টল, হস্তশিল্প, পোশাক শিল্প, স্টেশনারি ও কসমেটিকস, খাবার ও চটপটির স্টল, মিষ্টির স্টল।
ফাউন্ডেশনের ‘সোনারতরী’ লোকজমঞ্চে প্রতিদিন জারি, সারি, বাউলগান, কবিগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মাইজভাণ্ডারি, লালন সংগীত, হাসনরাজা, মুর্শিদী, পালাগান, গায়ে হলুদের গান, বান্দরবান, বিরিশিরি, কমলগঞ্জের মণিপুরি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। স্থানীয় স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে গ্রামীণ খেলাধুলা, বিবাহের কনে দেখা, নববধূর গায়ে হলুদ, বর যাত্রা, জামাইকে পিঠা খাওয়ানো, গ্রাম্য সালিশি ব্যবস্থাসহ গ্রামবাংলার হাজার বছরের জীবনযাত্রা নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রয়েছে পুঁথি পাঠ, ছড়া পাঠের আসর, লোকজ জীবন প্রদর্শনী, লোকজ গল্প বলা, ঘুড়ি ওড়ানো, পিঠা প্রদর্শনী। এছাড়া মেলায় রয়েছে পুতুল নাচ দেখার ব্যবস্থা। রয়েছে বায়োস্কোপ দেখার ব্যবস্থাও।
দেশের বিভিন্ন স্থানের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের সমারোহ দেখতে পাওয়া যায় এ মেলায়। মাগুরা ও নওগাঁর শোলাশিল্প, চট্টগ্রামের তালপাখা ও নকশিপাখা, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, সিলেট ও মুন্সিগঞ্জের শীতলপাটি, কুমিল্লার তামা-কাঁসা-পিতলের কারু শিল্প, রংপুরের শতরঞ্জি, সোনারগাঁয়ের কাঠের কারু শিল্প, হাতি, ঘোড়া, পুতুল, বাঁশ ও বেতের কারুশিল্প, হাতপাখা, নকশি কাঁথা, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কারুপণ্য, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা শিল্পসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের চত্বর খোলা থাকে মেলায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য। এ ছাড়া সুযোগ রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর পরিদর্শনের। বুধ ও বৃহস্পতিবার জাদুঘর সাপ্তাহিক বন্ধ থাকলেও মেলা চত্বর খোলা রয়েছে প্রতিদিনই। রয়েছে দৃষ্টিনন্দন লেকে ময়ূরপঙ্খী নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। প্রবেশ ফি ৫০ টাকা। ঢাকা থেকে সোনারগাঁয়ের দূরত্ব মাত্র ২৩ কি.মি.। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে মোগরাপাড়া সোনারগাঁ। সেখান থেকে জাদুঘর রিকশায় ১৫-২০ টাকা ভাড়া। অটোতে ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। ছুটির দিনে অথবা অবসর বিকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরে যেতে পারেন সহসাই। আর দেখে যেতে পারেন প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ জনপদকে বর্তমান রূপে।
ছবি মোহাম্মদ মহসীন
