Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

বটবৃক্ষের ছায়ার নাম বাবা

Icon

কেয়া আমান

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভাষা ভেদে শব্দ বদলায়। স্থান ভেদে বদলায় উচ্চারণ। ‘বাবা’, ‘আব্বু’ কিংবা ইংরেজিতে ‘ড্যাড’ বা ‘ফাদার’ যাই বলে ডাকি না কেন-বদলায় না শব্দটির সম্পর্কের গভীরতা। উচ্চারণে ভিন্নতা থাকলেও প্রতিটি দেশে প্রতিটি সন্তানের মাথার ওপর বটবৃক্ষের মতো ছায়ার নামই হচ্ছে ‘বাবা’। সন্তানের মুখের হাসি, সব আবদার পূরণের জন্য জীবনের ছোট-বড় সুখ, আরাম-আয়েশ নির্দ্বিধায় ত্যাগ করা, আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার নাম বাবা। বাবার তুলনা শুধুই বাবা। বাবা চির আপন, চিরন্তন এক সম্পর্কের নাম।

বাবার প্রতি সন্তানের সেই চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। তারপরও একটি বিশেষ দিনে ঘটা করে ভালোবাসার প্রকাশও মন্দ নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব বাবা দিবসের প্রচলন। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন জুন মাসের তৃতীয় রোববারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস হিসাবে নির্ধারণ করেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতি বছর জাতীয়ভাবে বাবা দিবস পালনের রীতি চালু করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্যাটেলাইটের সুবাদে বাবা দিবস এখন ঘটা করে পালিত হচ্ছে আমাদের দেশেও। জুন মাসের তৃতীয় রোববার হিসাবে ২০ জুন বিশ্বের প্রায় ৭৪টি দেশে বাবা দিবস পালিত হবে। বাবা দিবস উপলক্ষ্যে বিশ্বের সব বাবাদের জানাই সম্মান ও শ্রদ্ধা।

দুটি বর্ণের একটি ছোট্ট শব্দ, বাবা। ‘বাবা’ কথাটি ছোট হলেও এর মাঝেই লুকিয়ে আছে সন্তানের সবচেয়ে বেশি নির্ভরতা, øেহ আর সাহস। বাবা হাঁটতে শেখার সময়টাতে ছোট্ট ছোট্ট আঙুল ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সন্তানকে শেখান পথ চলা। ছোটবেলায় আমরা সারা দিনের অভিযোগ, অভিমান সব জমিয়ে রাখি বাবার জন্য। মা বকেছে, বাবার কাছে নালিশ। বাবাও তখন পুরোদস্তুর আপনার পক্ষে! বাবা ছায়া হয়ে সন্তানকে আগলে রাখেন যে কোনো বিপদ-আপদে। বন্ধু হয়ে পাশে থাকেন যে কোনো দুঃসময়ে।

অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কাছে মাকে মনে হয় বেশি আপন, কারণ বেশিরভাগ সময় মা আমাদের চোখের সামনেই থাকেন। বাবা থাকেন বাইরে। দিনের শুরু থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে খেটে যে মানুষটি আমাদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেন, তার অবদান যেন আমরা দেখেও দেখি না। যেন এ-ই স্বাভাবিক। অথচ মায়ের পরে শত আবদার, অনুযোগ পূরণ করার জন্য আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য শত ত্যাগ নিঃস্বার্থভাবে পূরণ করেন যেই মানুষটি তিনি আর কেউ নন, বাবা। দরিদ্র বাবা কিংবা ধনী বাবা বলেও কিছু নেই। সব বাবাই চান সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে সন্তানকে ভালো রাখতে, গড়ে তুলতে।

অনেক পরিবারে বাবার সঙ্গে সন্তানের কিছুটা দূরত্ব দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই মায়ের আঁচল ধরে ঘ্যানর ঘ্যানর করার অভ্যাস আমাদের, দিন শেষে বাবা সামনে এলে তাই মনে হয় রাগী এবং গম্ভীর কেউ! এ ক্ষেত্রে সব আবদার মায়ের মাধ্যমে পৌঁছায় বাবার কাছে। বাবা তার গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন সন্তানের সব অনিশ্চয়তা, প্রতিবন্ধকতা। দুশ্চিন্তার এতটুকু আঁচড় যেন সন্তানকে না ছোঁয়! বাবার ভাবনায় থাকে সেটাই। দূরত্ব কিংবা গাম্ভীর্য, যাই থাকুক না কেন কিংবা প্রকাশভঙ্গি যাই হোক সন্তানের জন্য পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে তুলতে চেষ্টার কোনো কমতি থাকে না বাবার।

তবে বাবাকে নিয়ে সব সন্তানের অনুভূতি সমান নয়। আবার জীবনের নানা বাঁকে সব বাবাও হয়তো পারেন না সন্তানের প্রতি তাদের আবেগটুকু একইভাবে প্রকাশ করতে। তাই কখনো কখনো বাবার অবদানকে আমরা ভুলে যাই। তাকে যথাযথ শ্রদ্ধা, সম্মান করি না। তবুও বাবা কিন্তু সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনা করে যান তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।

বয়স হয়ে গেলে অনেক সন্তান তাদের পিতাকে বোঝা ভাবেন। পিতার বুকফাটা আর্তনাদ না শোনার মতো সন্তানও এই সমাজে আছে।

‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/সবচেয়ে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি/ছেলে আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’-নচিকেতার এ গানের বাস্তবতা মিলবে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। তবে এটা সমাজের গুটিকয়েক সন্তানের চিত্র। বাবার জন্যও আমাদের সন্তানদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কম নয়। বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসার অবিরাম ধারা বয়ে চলে বছরের প্রতিটি দিন।

জীবনের ঘানি টানতে টানতে বাবা এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হন, বার্ধক্য তাকে গ্রাস করে। তখন তিনি হয়ে পড়েন অনেকটা অসহায়, দুর্বল। রোগব্যাধি তাকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। এ সময় বাবা চান সন্তান যেন তার পাশে থাকে সবসময়। সন্তানের কাছ থেকে অবহেলা কিংবা দুর্ব্যবহার পেলে বাবার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাই আমাদের আচার-আচরণে বাবা যেন সামান্যতম কষ্টও না পান আমাদের সেই দিকটি খেয়াল রাখতে হবে। বয়স হলে তার ছোট-বড় প্রয়োজন, আরাম, সুযোগ-সুবিধার কথা মাথায় রাখতে হবে। ব্যস্ততার কারণে সারা দিন না পারলেও যতটা সম্ভব বাবা-মায়ের দেখভাল, খোঁজখবর রাখুন। খাবারের তালিকায় রাখুন বাবার প্রিয় বা পছন্দের খাবারগুলো। একই সঙ্গে শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেসব খাবার থেকে তাকে বিরত থাকতে হবে সেগুলো মেনে চলছে কিনা তারও খোঁজ রাখুন। সারা দিন সম্ভব না হলেও দিন শেষে বাবা-মায়ের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটান, গল্প করুন। অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসা, সেবাশুশ্রষা করুন। প্রেসার, ডায়াবেটিসসহ একটু বয়স হলে সাধারণত যেসব রোগবালাই শরীরে বাসা বাঁধে সেগুলো অবহেলা করবেন না। নিয়মিত বাবা-মায়ের চেকআপ করুন, ওষুধ খাওয়ান। সুযোগ থাকলে বাবার সঙ্গে বাইরে হাঁটতে যান। বন্ধু হয়ে পাশে থাকুন। যেমনটা আপনার ছোটবেলায় তিনি ছিলেন আপনার পাশে। আপনার যত্ন ও ভালোবাসার ছোট ছোট এ প্রকাশগুলো আপনার বাবাকে আনন্দে রাখবে। করোনাকালীন এ সময়টাতে আপনার বয়স্ক বাবার প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হউন। তিনি যেন অপ্রয়োজনে হুটহাট বাইরে না যান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন সেদিন নজর রাখুন। বাসার প্রতিটি সদস্যকেও এই ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিন। যার বাবা এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন কেবল তিনিই জানেন মাথার ওপর থেকে বাবা নামক ছায়াটি চলে গেলে কেমন লাগে, কতটা একা হয়ে যেতে হয়। তাই যাদের বাবা এখনও বেঁচে আছেন তারা বাবার প্রতি আরও বেশি যত্নবান হউন, তিনি যেন বিন্দুমাত্র কষ্টও না পান সেদিকে খেয়াল রাখুন।

ভালোবাসলেও, যত্ন নিলেও কিংবা নিয়মিত ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও নানা জড়তা আর দ্বিধায় বাবাকে হয়তো কখনো বলা হয়ে উঠেনি ‘ভালোবাসি বাবা’। জড়তায় প্রতিদিন বা কখনো না পারলেও আসছে বাবা দিবসে একটু ঘটা করেই বাবাকে জানাতে পারেন তার প্রতি হৃদয়ের গহিনে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার কথা। তাকে দিতে পারেন বিশেষ কোনো উপহার। বাবার জন্য কেনা উপহারটি র‌্যাপিং করে তার ওপর লাগাতে পারেন রঙিন রিবন। আর উপহারে লিখে দিতে পারেন ‘বাবা তোমায় ভালোবাসি’। আপনার দেওয়া সেই উপহারটি যত কম দামিই হউক না কেন তা আপনার বাবার কাছে হয়ে উঠবে মহামূল্যবান। কারণ উপহারটির সঙ্গে মিশে থাকবে আপনার ভালোবাসার প্রকাশ। মুখে কিছু না বললেও ভালোবাসা, গর্বে ছল ছল করে উঠবে বাবার দু’চোখ।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম