Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

প্রকৃতি

বর্ষায় ফুটেছে মধুমঞ্জরি

Icon

চয়ন বিকাশ ভদ্র

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রায় সারা বছরই মধুমঞ্জরি ফোটে, তবে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মধুমঞ্জরি ফুল ফোটার প্রধান মৌসুম। শুকনো প্রাণহীন লতায় প্রাণ জেগেছিল এ বৈশাখে। সৌন্দর্যের সবটুকু নিয়ে ফুটেছিল ফুল। বর্ষা আসছে। ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্রের তীরের ছোট কালীবাড়ির গেটের সামনের দেওয়ালের মধুমঞ্জরির প্রস্ফুটন চোখে পড়ল। ডালের আগায় বড় বড় ঝুলন্ত থোকায় সুগন্ধি, সাদা ও লাল রঙের ফুল ফুটে আছে। এর পাতা কিছুটা পাতলা ও খসখসে প্রকৃতির, গঠনে আয়তাকার থেকে ডিম্বাকার, রং সবুজ, এর পাতাগুলো শাখায় জোড়ায় জোড়ায় সুবিন্যস্তভাবে সাজানো থাকে। তাজা ও বাসি ফুলে রঙের ভিন্নতাও এ ফুলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাজা ফুলের রং সাদা, বাসি হলে লাল হয়। ফুলে ক্ষুদ্রাকৃতির পাপড়ি সংখ্যা পাঁচটি, মাঝে পরাগ অবস্থিত, দলনল বেশ লম্বা। ফুলের গন্ধ বেশ মিষ্টি। এ সময়ে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে গাছ। ফুল ফুটন্ত গাছ খুবই নজরকাড়া ও মনোরম। আমাদের দেশে বাসাবাড়ি, বাগান, পার্ক, উদ্যান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাগানে মধুমঞ্জরি ফুলগাছ চোখে পড়ে।

ফুলটির পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘এ লতার কোনো একটা বিদেশি নাম নিশ্চয় আছে-জানিনে, জানার দরকারও নেই। আমাদের দেশের মন্দিরে এ লতার ফুলের ব্যবহার চলে না, কিন্তু মন্দিরের বাইরে যে দেবতা মুক্তস্বরূপে আছেন তার প্রচুর প্রসন্নতা এর মধ্যে বিকশিত। কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন, তার ব্যবহারে এই ফুলকে লাগাব ঠিক করেছি, তাই নতুন করে নাম দিতে হলো। রূপে রসে এর মধ্যে বিদেশি কিছুই নেই, এ দেশের হাওয়ায় মাটিতে এর একটুও বিতৃষ্ণা দেখা যায় না, তাই দিশী নামে একে আপন করে নিলেম এই দিশী (দেশি) নামটিই মধুমঞ্জরিলতা।’

মধুমঞ্জরি কাষ্ঠল, পত্রমোচী, আরোহী উদ্ভিদ। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ নাম দেন মধুমঞ্জরি লতা। বৈজ্ঞানিক নাম Quisqualis indica। এ ছাড়া বাংলায় হরগৌরী, মধুমালতী, লাল চামেলি নামেও এটি পরিচিত। মধুমঞ্জরি প্রায় সারা দেশেই সহজলভ্য। অনেকে এ ফুলটিকে মাধবী বলে ভুল করেন। ঢাকার শিশু একাডেমি, বলধা গার্ডেন ও রমনা পার্কে এ উদ্ভিদ রয়েছে।

পাতা ছয় থেকে নয় সেমি লম্বা, শিরা সামান্য রোমশ, পত্রবিন্যাস বিপ্রতীপ। এর বৃদ্ধির জন্য গ্রিল বা গেটের ব্যবস্থা থাকতে হয় যাতে ভর করে বেড়ে উঠতে পারে গাছ। এর লতা বেশ শক্তমানের হয়, বিশেষ করে বয়স্ক গাছের লতা। গাছের দৈর্ঘ্য ইচ্ছা অনুযায়ী ছাঁটাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমবেশি করে রাখা যায়। বাড়ির গেট বা ঘরের ওপর বেশ জেঁকে বসে। শীতে পাতা কমে যায়। বছরে কয়েক দফা ফুল ফোটে। ঘন সবুজ পাতার মাঝখানে ঝুলন্ত সাদা-লাল ফুল সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সন্ধ্যায় নতুন ফুল ফোটে আর হালকা সুবাস ছড়ায়। বসন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় প্রচুর ফুল ফোটে।

গোড়ার শিকড় থেকে চারা গজায়। সাধারণত কলমে চাষ হয়। এ উদ্ভিদটির আদি নিবাস ফিলিপাইন, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া। পরবর্তী সময়ে বার্মা, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে এ উদ্ভিদের প্রবর্তন করা হয়েছে এবং প্রকৃতিতে অভিজোজিত হয়েছে। বার্মার রাজধানীর সাবেক নাম ছিল রেঙ্গুন। তাই এর ইংরেজি নাম রেঙ্গুনক্রিপার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মধুমঞ্জরিকে নিয়ে লিখেন-

‘তব প্রাণে মোর ছিল যে প্রাণের প্রীতি

ওর কিশলয় রূপ নেবে সেই স্মৃতি,

মধুর গন্ধে আভাসিবে নিতি নিতি

সে মোর গোপন কথা।

অনেক কাহিনি যাবে যে সেদিন ভুলে,

স্মরণ চিত্ত যাবে উন্মুলে;

মোর দেওয়া নাম লেখা থাক ওর ফুলে

মধুমঞ্জরী লতা।’

রবীন্দ্রনাথ বিদেশ ভ্রমণের সময়েও এ পুষ্পলতাটির জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন। ১৯২৬ সালে রোম থেকে ফ্লোরেন্স যাওয়ার পথে শান্তিনিকেতনে ফেরার কথা ভেবে লিখেছিলেন :

‘কিন্তু পৌঁছব যখন তখন শিউলি ফুলের পালা-মালতীর পরিশিষ্ট দেখতে পাবো। ইতিমধ্যে আমার মধুমঞ্জরীর হয়তো বর্ষাধারায় শ্রীবৃদ্ধি হবে।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম