|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মাতৃভাষার বিষয়টি একটু অদ্ভুত। যে ভাষা অন্য দেশের মানুষ শত ব্যাকরণ শিখেও ঠিক করে বলতে পারে না, সে ভাষাই মাতৃভাষা হলে একজন দুবছরের শিশুও নির্ভুলভাবে বলে যায়। দেশের বুকে জন্ম নিয়ে তারই আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আর বড় হতে হতে ভাষার সবটুকু রং ও রূপ শিখে নেওয়ার আনন্দ অবর্ণনীয়। মাতৃভাষায় কথা বলে যে পরিতৃপ্তি, তা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় মেলে না। প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার সবচেয়ে প্রিয় ভাষা হলো মাতৃভাষা। যেমনটা ঠিক আমাদের কাছে। বাংলায় কথা বলে আমরা যতটা প্রশান্তি পাই, খুব কম জিনিসেই সেই প্রশান্তি মেলে। যেমন মায়ের প্রিয় কোল, বাবার ভরসার কাঁধ, ভাইবোন, বন্ধুর বন্ধন। মন খুলে হাসি-কান্না, সবই তো এ বাংলাভাষায়!
বাংলাকে ভালোবেসে
বর্তমান প্রজন্ম বাংলার প্রতি উদাসীন, এমন অভিযোগ করতে শোনা যায় অনেককে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার যুগে কেউ এখন আর একটিমাত্র ভাষার কাছে আটকে থাকতে চান না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আরও অনেক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইংরেজি তো শিখছেনই, সেই সঙ্গে রপ্ত করছে আরও অনেক ভাষা। কিন্তু আমাদের বাংলা? বাংলা কি তবে অবহেলিত হচ্ছে? এমনটা মনে করছেন না প্রজন্মের তরুণরা। তাদের কথায়, বাংলা না থাকলে আমাদের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যাবে। পৃথিবীর যেখানেই যাই এবং যত ভাষায় কথা বলি না কেন, সবকিছুর আগে আমাদের পরিচয় হলো, আমরা বাংলাদেশি। দিন শেষে মন খুলে দুটি কথা বলার জন্য বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষা নেই আমাদের।
যখন বিদেশে
ইউএসএ প্রবাসী লেখিকা মুনীরা প্রীতু। তার প্রথম সন্তান ইফিয়ান ওয়ারিফের বয়স চার বছর। ইফিয়ানকে খুব ছোটবেলা থেকেই বাংলাভাষার শিক্ষা দিয়ে এসেছেন মুনীরা। যেহেতু সন্তানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিদেশের মাটিতে, তাই দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি শেখানোর সবটা দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন মুনীরা ও তার স্বামী। মুনীরা বলেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই ইফিয়ানকে গল্প শোনাই। আমাদের বাংলাভাষায় শিশুর উপযোগী অনেক গল্প রয়েছে। সেগুলোই একে একে শুনিয়েছি তাকে। সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে এ গল্প শোনানোর কৌশলটাই। বাংলাদেশে আমাদের যেসব আত্মীয়স্বজন রয়েছেন তাদের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলি যতটা সময় সম্ভব। এ অভ্যাস ইফিয়ানকে বাংলায় কথা বলতে দ্রুত অভ্যস্ত করেছে। কারণ বাংলা শুনতে শুনতে ইফিয়ানও চমৎকারভাবে বাংলা বলতে শিখেছে। এমনকি আমাদের আমেরিকার বাড়িতেও কোনো ধরনের ইংরেজি বলা হয় না। আমরা চেষ্টা করি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে। এখানকার বাংলা কমিউনিটিতে যত ধরনের অনুষ্ঠান হয়, সব জায়গায়ই ইফিয়ানকে দিয়ে ছড়া আবৃত্তি করানোর চেষ্টা করি। এতে তার বাংলাচর্চা সহজ হয়। যে কোনো উৎসব যেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বসন্ত উৎসব, বাংলা নববর্ষ ইত্যাদিতে ইফিয়ানকে উৎসব অনুযায়ী পোশাক পরিয়ে সাজিয়েছি। অনেক সময় দিয়েছি তাকে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি শেখাতে। এখন সে চমৎকারভাবে গুছিয়ে বাংলায় কথা বলতে পারে। দেশ সম্পর্কেও অনেক কিছু জানে সে।’
বাংলাকে ধারণ করতে চাইলে
বাংলাভাষা থেকে যদি প্রজন্ম দূরে সরে যেতে থাকে, সে দায় অগ্রজরা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। তাই সময় থাকতেই সচেতন হতে হবে। আমাদের এ সমৃদ্ধ ভাষা আরও বেশি সমৃদ্ধ যাতে হয়, সে চেষ্টা করে যেতে হবে। শিশু যখন বুঝতে শিখবে তখন থেকেই তাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বাংলা শেখাতে হবে। অনেক শিক্ষার্থীকেই দেখা যায়, মাতৃভাষা বলে বাংলাকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলস্বরূপ তারা বাংলায় দক্ষতা অর্জন করতেও পারছে না। মাতৃভাষা হওয়ার পরও বাংলাকে ভালোভাবে না জানা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সবার আগে বাংলা শিখে এরপর অন্যসব ভাষার দিকে মন দিতে হবে। মাতৃভাষাই যদি না জানেন, অন্য কোনো ভাষা আপনাকে আপন করে নেবে না।
শিশু কীভাবে শিখবে
শিশুর সঙ্গে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার পাশাপাশি খেলার ছলে তাকে বাংলা ব্যাকরণ ও ভাষার ব্যবহার শেখাতে পারেন। কেবল কথা বলাই নয়, কীভাবে বললে ভাষার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, সে কথাও তাকে বলুন। শিশুর জন্য সহায়ক নানা ধরনের বই কিনতে পাবেন। আবার এ সংক্রান্ত অনেক অ্যাপ রয়েছে। ইউটিউব খুঁজলে ভিডিও-ও পাবেন অনেক। তাই শিশু যেটুকু সময় স্মার্টফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ব্যয় করছে, সেটুকু তাকে ভাষার দক্ষতা শেখানোর কাজে ব্যয় করতে পারেন। অন্যান্য ভাষার বদলে বাংলাভাষায় তৈরি বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্টুন ও ভিডিও তাকে দেখতে দিতে পারেন। লেখাতে পারেন হাতের লেখা। এতে শুদ্ধ বানান লেখার চর্চা হবে। কথা প্রসঙ্গে তাকে একটি-দুটি করে শব্দের মানে জিজ্ঞেস করুন। না পারলে ক্ষিপ্ত হবেন না। তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন। এতে সে ভাষার সঠিক প্রয়োগ শিখতে পারবে।
বই পড়তে দিন
বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। শিশুকে ছোট থেকেই বই পড়ার অভ্যাস করান। এতে তার কল্পনার জগৎ অনেক সমৃদ্ধ হবে। সে নিজে থেকেই অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শিখবে। অনেক বিষয়ে সে ধারণা লাভ করতে পারবে। তাই যেসব বই পড়লে সে উপকৃত হবে, সেগুলোই পড়তে দিন। শিশু যেন একজন ভালো পাঠক হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। কেবল পাঠ্যবই নয়, এর বাইরেও শিশুর আগ্রহের বইগুলো তাকে কিনে দিন। সে যত বেশি বই পড়বে, তত বেশি তার জানার পরিধি বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে ভাষার প্রতি তার ভালোবাসাও।
